সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


 

সিন্নি: পর্ব-১১

এই একটা কথায় কল্যাণ ভট্টাচার্য ভেঙে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন এ বার আর পুলিশকে লুকিয়ে কিছু লাভ নেই। এরা সব খবরাখবর নিয়ে তারপরে জেরা করতে শুরু করেছে। আর সময় নষ্ট না করে কল্যাণ ভট্টাচার্য জবানবন্দি দিতে রাজি হলেন। একটু সময় চাইলেন। মুখ হাত ধুয়ে জল খেলেন। শ্রেয়া তাকে চা খাওয়ালেন। তারপর কল্যাণ ভট্টাচার্য বলতে শুরু করলেন।
কল্যাণ প্রথম যখন রীনাকে পড়াতে শুরু করেন তখন সম্পর্কটা ছাত্রী শিক্ষকের মতোই ছিল। রীনা ফার্স্ট ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করল। বাড়িতে হইহই, খাওয়াদাওয়া। ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হবে। কল্যাণ ঘোষবাবুকে বললেন রীনাকে ভালো কোনও কোচিং ক্লাসে ভর্তি করাতে যেখান থেকে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ট্রেনিংটাও হবে আবার ইলেভেন টুয়েলভের কোচিংটাও পাওয়া যাবে। কিন্তু ছাত্রী রীনা বেঁকে বসল। বলল সে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে না, ডাক্তার হবার মতো গভীর ধৈর্য তার নেই। আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর চাকরির বাজার ভালো নয়। সে আর্টস নিয়ে পড়বে। মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে সায়েন্স পড়ে না, এমন ছাত্র-ছাত্রী খুঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু রীনার যুক্তি ছিল অকাট্য, মাধ্যমিকের টিক মারা বিদ্যে দিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে উতরনো যাবে না। আর সায়েন্স নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকটা টাল খেয়ে বেরিয়ে গেলেও গ্রাজুয়েশনে ভরাডুবি সুনিশ্চিত। নিজেকে নিয়ে অত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার মতো ইচ্ছে তার নেই। রীনার মা শিউলি বা বাবা প্রণববাবুও মেয়েকে জোর করেননি। নিজেদের ইচ্ছে তার ওপর চাপিয়েও দেননি। খুব স্বাভাবিকভাবেই বুদ্ধিমান রীনা ইলেভেনে খুব ভালো রেজাল্ট করল, আর সেদিনই কল্যাণ এক সম্পূর্ণ অন্যরকম রীনার মুখোমুখি হল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৩১: কল্যাণকে প্রশ্ন শ্রেয়ার, আপনি কি রীনাকে বিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল

এর আগে কল্যাণ ও তার স্ত্রী দীপিকার টলোমলো দাম্পত্যজনিত রুক্ষ সম্পর্ক কল্যাণকে বিব্রত বিরক্ত করে রাখত। ঘোষভিলায় পড়াতে আসার সময়টুকু অন্যরকম থাকতো কল্যাণ। দীপিকার ক্রমাগত অসুস্থতা সন্তানধারণে অক্ষমতা তাদের সুস্থ স্বাভাবিক দাম্পত্যে আরও বড় বাধা হয়ে উঠছিল। আবার এই ক্রমাগত বাধাই কল্যাণকে সংসারে অমনোযোগী করে তুলছিল। শারীরিক অক্ষমতা অসুস্থতায় জর্জরিত দীপিকা আবার স্বামীর সাংসারিক অমনোযোগ সহ্য করতে পারতো না। অশান্তির সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ শুরু হল। একেবারে রবিঠাকুরের মালঞ্চের গল্পের মতো। রীনা তার অজান্তেই কল্যাণ ও দীপিকার কাহিনির মধ্যে তৃতীয় বাহু হয়ে ঢুকে পড়ল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৭: সারদা মা ও তাঁর রাধু

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

খুব নিয়ম করে দীপিকার ঘোষ-ভিলাতে যাওয়া-আসা ছিল না। ক্লাস ইলেভেনে খুব ভালো রেজাল্ট করবার পর প্রণববাবু ঘটা করে বড় মেয়ের জন্মদিন করলেন। নিজে বাড়ি বয়ে গিয়ে কল্যাণ ও দীপিকাকে রীনার জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করে এলেন। সস্ত্রীক না যাবার উপায় নেই। কিন্তু সমস্যা শুরু হল জন্মদিনের উপহার নিয়ে। কল্যাণ এতদিন ধরে পড়াচ্ছে, মাইনে দিতে ঘোষবাবু কখনও কার্পণ্য করেননি। মাঝেমধ্যে সামান্য ক্যাডবেরি চকলেট ছাড়া রীনা বা তৃণাকে কিছুই দেয়নি কল্যাণ। এদিকে দীপিকার কোনও বাড়বাড়িতে সায় নেই। শেষমেশ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লেখা লোটা-কম্বল কিনে দেওয়া হল। দীপিকা এদিন প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সাজাগোজা করল। গয়না পরল। কোথাও একটা অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে যেন যুদ্ধে নেমেছে দীপিকা। জন্মদিনের সন্ধেবেলা রীনাকে বহুবছর পর চাক্ষুষ করে দীপিকা মানসিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলো। দীপিকা লক্ষ্য করতে লাগল কল্যাণকে টেনে নিয়ে গিয়ে রীনা তার বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। কোন গতিকে রাতের খাবারটুকু খেয়ে দীপিকা বাড়ি যেতে চাইল।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৪: অপরাজিতা রাধারাণী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

বাড়ি ফিরে সে রাতের ভয়ংকর অশান্তির ফলে দীপিকা পরদিনই চন্দননগরে তার বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। গোটা রাত ধরে দীপিকা ভাবছে কল্যাণ নিশ্চয়ই ভুল স্বীকার করে তার চন্দননগর যাওয়াতে বাধা দেবে। আর উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে শুয়ে কল্যাণ ভাবতে লাগলো এই একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে এত বড় অশান্তি করতে পারে দীপিকা? মুখ দিয়ে যখন যাবার কথা বলেছে সে-ও বাধা দেবে না। সুতরাং যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাঝের দূরত্বটা বাড়তে শুরু করল। ভুল বোঝাবুঝি ব্যাপারটা এমনই সামান্য তুচ্ছ কারণ দিয়েই সব ভুল বোঝাবুঝির শুরু। আর পারস্পরিক তীব্র অধিকার বোধ থেকেই সেই সামান্য ভুলটাকে ভাঙাবার খেয়াল কারওই থাকে না। ক্রমাগত ভুলের পাহাড় জমতে থাকে। তারপরে একদিন মাঝের সেই পাহাড়ের গায়েই ফাটল ধরে তারা আলাদা হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?

ভরের নিত্যতা সূত্রের মতোই দাম্পত্যে অশান্তি থেকে তৈরি হওয়া দূরত্ব বাড়ছে, আর দুই অসমবয়স্ক নারী-পুরুষের মধ্যে নিষিদ্ধ আকর্ষণ বাড়তে শুরু করল।
 

ঘোষ পরিবার হত্যারহস্য–পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ৬ জুন ২০২৪

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content