বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

 

সিন্নি: পর্ব-৯

১৯৬৫ সালে ইসমাইল মার্চেন্ট প্রযোজিত ছবি শেক্সপিয়ারওয়ালা। ছবির আবহসঙ্গীত রচনা করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। নিজের ছবি ছাড়া শেক্সপিয়ারওয়ালা আর নিত্যানন্দ দত্ত পরিচালিত বাক্সবদল ছবিতে সত্যজিত রায় আবহসঙ্গীত রচনা করেন। শেক্সপিয়ারওয়ালার সিনেমাটোগ্রাফি করেছিলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী সুব্রত মিত্র। নায়ক চরিত্রে ছিলেন শশী কাপুর ছিলেন উৎপল দত্ত। মিসেস ব্রাউন চরিত্র ছিলেন জেনিফার ক্যান্ডেল, কিন্তু এই ছবিতে তাঁকে যথাযোগ্য পরিচিতি দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে শশী কাপুরের ঘরণী হলেন জেনিফার। যতই গোয়েন্দাগিরি করুক সিনেমার সঙ্গে যোগসূত্রটা কিছুতেই ত্যাগ করতে পারে না ধৃতিমান।
বিদ্যুৎ কতকগুলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ খবর দিল। পড়শিদের সন্দেহ রীনার বাড়ির পুরোহিত কল্যাণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে তার সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয়। শুনলে খুবই আশ্চর্য লাগে। কিন্তু কল্যাণ সেই অর্থে পূজারী ব্রাহ্মণ নন। ছোটবেলা থেকে রীনাকে পড়াতেন, পরে বোন তৃণাও কল্যাণবাবুর কাছে পড়তে শুরু করে। কল্যাণবাবু কর্পোরেশনের চাকুরে খেলাধুলা করতেন। সুঠাম চেহারা বয়েস বোঝা যায় না, শুধু একটা বা দুটো বড় দূর্গাপুজা করেন বছরে একবার। বহুদিন এ বাড়িতে আসা-যাওয়া। এখন বছর ৪২ বয়েস রীনার বাবা প্রণববাবুর থেকে বছর নয়েকের ছোট রীনার থেকে ঠিক ২১ বছরের বড়।

অথচ পড়শিদের সন্দেহ সত্যি হলে কোনও এক অদ্ভূত নিয়মহীন বেপরোয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে এই দুই অসমবয়সী নারীপুরুষ। কল্যাণ ভট্টাচার্য নিঃসন্তান। স্ত্রী দীপিকার সঙ্গে তার দূরত্ব স্পষ্ট। দীপিকা রুগ্ন বছরের অনেকটা সময় তার বাপের বাড়ি চন্দননগরে কাটে। ঘোষভিলার সঙ্গে কল্যাণ ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক। দীপিকা না থাকলে অনেকসময় ঘোষভিলা থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার আসে। স্ন্যাকবারের ফিসফ্রাই চাওমিন নয় বাড়ির রান্না করা খাবার। এই বাতাবরণে রীনার সম্পর্কের কথা হয়ত আন্দাজ করতে পারেননি প্রণববাবু বা তাঁর স্ত্রী শিউলি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-২৯: ঘুমের ওষুধ কি সিন্নিতে মেশানো ছিল?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া

রীনার কতটা সাড়া ছিল বা ছিল না সেটা এখন আন্দাজ করা কঠিন। বিদ্যুৎ আরও খবর পেয়েছে রীনা আর তৃণাকে আলাদা সময়ে পড়াতেন। তৃণাকে ভোরবেলা অফিস যাওয়ার আগে। আর রীনা পড়ত রাত আটটার পর কল্যাণ ভট্টাচার্য অফিস থেকে ফেরার পর সোম থেকে শনি একই রুটিন। রবিবার ছুটি। ক্লাস নাইনে ওঠার পর কল্যাণ পড়াতে শুরু করেন সাইন্স গ্রুপ আর ইংরিজি। বিএসসি কেমিস্ট্রি অনার্স পাস করেও চাকরি পাচ্ছিলেন না আচমকা কলকাতা কর্পোরেশনের অ্যাকাউন্টস ক্লার্ক বাবা সুবিনয় ভট্টাচার্য অফিসেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন কম্প্যাসনেট গ্রাউন্ডে বড় ছেলে কল্যাণ চাকরি পেল তখনও এমন চাকরি হতো।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

নিজের যোগত্যার উপযুক্ত চাকরি না পেয়ে বহুদিন মনমরা ছিলেন কল্যাণ কিন্তু মন খারাপ হলেই তো আর কর্পোরেশনের সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেওয়া যায় না। কল্যাণ ঠিক করল ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষাতে বসবে রীতি মতো ভালোভাবে তৈরি হয়েও পরীক্ষায় শিকে ছিঁড়ল না। কর্পোরেশনের চাকরির সুবাদে পড়াশোনা সময়টা অনেক পেত কিন্তু ডব্লিউবিসিএস-এ সুযোগ না পেলেও এই সময় কল্যাণের বিয়েটা হয়ে গেল। তার বিধবা মা তখনও বেঁচে। ছোট ভাই কলকাতায় চাকরি বাকরি না পেয়ে গুজরাত চলে গেল। আর সেখানে গিয়ে সে পেয়ে গেল এক সফল জীবন। এই করতে করতেই সংসারের রেললাইনে সোজা পথ চলতে শুরু করল কল্যাণ। ডব্লিউ বিসিএস-এর উদ্যম তখন হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার নিজের শিক্ষাটা সে কোচিং ক্লাসে ব্যবহার করতে শুরু করল। ঘনিষ্ঠ বন্ধু এক কোচিং ক্লাস খুলেছিল আর সেখানেই চাকরির সময়টুকু বাদ দিয়ে কল্যাণের রমরমা টিউশন ক্লাস। ভালোই চলছিল, কিন্তু পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রির এক চক্রে পড়ে বন্ধুর টিউশন ক্লাসে তালা পড়ল। কল্যাণ আর এই ঝামেলার মুখোমুখি হয়নি, খুব বেছেবুছে একটা দুটো কি টিউশন করত। বাজারের চলতি মাইনের তুলনায় অনেক বেশি টাকা চাইত। এ ভাবেই ঘোষভিলাতে কল্যাণ ভট্টাচার্যের শুভপ্রবেশ। তারপর ৮ বছর কেটে গিয়েছে ১৩ বছরের রীনা চোখের সামনে ২১ বছরের যুবতী হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ সময়ের সান্নিধ্য দু’জনের মধ্যে প্রায় দু’ যুগ বয়সের ব্যবধানকে হয়ত-বা ঘুছিয়ে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান

কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে ট্রেন টিকিটের সেই এম-২৫টি কে?

বিদ্যুৎ জানাল এখানেই কহানি মে টুইস্ট রীনার চেয়ে দু’ ক্লাস উঁচুতে পড়তো প্রলয় শিকদার পাড়ার ছেলে চেনাশোনা রীনাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। প্রলয় বরাবর লেখাপড়ায় ভালো কিন্তু আচমকা বাবার মৃত্যুতে সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল। তারাতলা মোড়ে নিউ আলিপুর থেকে খুব জোরে ডায়মন্ডহারবার রোডে ঘুরতে থাকা বাসের সামনের দরজা থেকে টুপ করে খসে পড়ে পিছনের চাকায় পিষে গেল প্রলয়ের বাবা। সংসারে একমাত্র রোজগেরে পুরুষ বাড়িতে প্রলয়ের ঠাকুমা প্রলয়ের মা প্রলয়ের ছোটভাই সকলে ওই ক্লাস টেনে পড়া প্রলয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। পড়াশোনা ছেড়ে প্রলয় শিকদার বাবার ইলেকট্রিকের ব্যবসা কাঁধে তুলে নিল। সহৃদয় পাড়ার লোকজন ডেকে কাজ দিতেন একটু একটু করে সংসারটাকে ঘুরে দাঁড় করিয়ে ফেলল প্রলয়। ঘোষভিলাতেও অবাধ যাতায়াত ছিল প্রলয়ের। এরপরটুকু বিদ্যুতের শুধুমাত্র অনুমান কোনও হাতে গরম প্রমাণ নেই। খুব সম্ভবত অসম বয়স্ক ছাত্রী শিক্ষকের মধ্যে জীবন সংগ্রামে পিছিয়ে পড়া পাড়ার পুরনো বন্ধু ঢুকে পড়েছিল।

বললেই তো হবে না প্রমাণ তো চাই। —চলবে।
 

ঘোষ পরিবার হত্যারহস্য: পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ২৩ মে ২০২৪

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content