মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ ও মাধুরীলতা

রবীন্দ্রনাথ প্রবলভাবে ছিলেন সময়-সচেতন। দু’অর্থেই তাঁর এই সচেতনতা। তাঁর লেখায় রয়েছে সময়ের চিত্রমালা। সাহিত্য-আয়নায় ফুটে ওঠা সব সময়ের ছবি অবশ্য সুখকর নয়। বিষাদ-মলিন ছবি যেমন আছে, তেমনই আছে আনন্দমুখর ছবি। এ তো গেল রচনাকর্মে তাঁর সময়-সচেতনতার প্রসঙ্গ। দৈনন্দিন জীবনেও তিনি ছিলেন সময়-সচেতন। কালক্ষয় নয়, চলমান সময়কে প্রতি মুহূর্তেই কাজে লাগিয়েছিলেন। সময় মেপে, ঘড়ি মিলিয়ে চলেছেন, জীবনে চলার পথে কখনও অকারণে সময় নষ্ট করেননি রবীন্দ্রনাথ।

কেমন ছিল কবির ঘড়ি, যে ঘড়ি কবিকে সময় জানাত? সময় দেখে, সময় মেনে ছন্দে ছন্দে আনন্দে রবীন্দ্রনাথ পা ফেলতেন, পৌঁছোতেন সাফল্যের মিনারে !

রবীন্দ্রনাথের ছিল কত গভীর ঘড়ি-প্রীতি, ঘড়ির সচলতা ও সক্রিয়তা রক্ষা করার জন্য কতখানি ছিলেন নিষ্ঠাবান, ‌রথীন্দ্রনাথের লেখায় রয়েছে সে-বিবরণ!

রবীন্দ্রনাথের লেখার চাপ বচ্ছরভর। ঘরের দরজা বন্ধ করে পারলে সারাক্ষণই লেখেন! কবির লেখার ঘরে কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। সন্তানসন্ততিদের জন্য যতই ভালোবাসা থাকুক না কেন, এ-ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট কঠোরতা ছিল। লেখার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে রথীন্দ্রনাথ-মাধুরীলতারা কম বকাঝকা খাননি ! লেখার ঘরে প্রবেশের এই বাধা-নিষেধ অবশ্য রোববার থাকত না। কবিই ডাকতেন। কবির ডাকের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা রথীন্দ্রনাথ-মাধবীলতারা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লেখার ঘরে হাজির হতেন।

কেন এই ডাকাডাকি, তেমন গুরুতর কিছু নয়, প্রতি রোববার কবি নিজের হাতে তাঁর ঘড়িতে দম দিতেন। ডাকতেন, এই দম নেওয়া দেখতেন। দেখে ছেলেমেয়েরা আহ্লাদিত হত, খুশির রং লাগত মুখে। সেই রং কবির মুখও ছড়িয়ে পড়ত।

রোববার সকালে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে দম দিতেন সোনার পকেটঘড়িতে। এই ঘড়িটি প্রাত্যহিক ব্যবহারের। ঘড়িটি কবির বিয়ের, জড়িয়ে আছে ‌ ‌ সুখস্মৃতি। বিয়েতে যৌতুক পেয়েছিলেন। অপূর্ব সে-ঘড়ি, ভারি দৃষ্টিনন্দন। দু’দিকে ডালা, বোতাম টিপলেই সেই ডালা মুহূর্তে খুলে যেত‌। ডালার ভেতরে খোদাই করে ইংরেজিতে লেখা রবীন্দ্র-নামের‌ দুটি আদ্যাক্ষর, R ও T.

চরম সংকটের দিনে, শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম বাঁচাতে নিরুপায় হয়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই সাধের ঘড়িটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিনেছিলেন জ্যেতিরিন্দ্রনাথ-বান্ধব অক্ষয় চৌধুরির স্ত্রী শরৎকুমারী। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে লাহোরে। রবীন্দ্রনাথ তাই সকৌতুকে তাঁকে বলতেন ‘লাহোরিণী’। ঠাকুরবাড়ির ‘ভারতী’তে তিনি লিখতেন, কখনও স্বনামে, কখনও-বা বেনামে।

শরৎকুমারীর মনে রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিল সম্ভ্রমের আসন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাস ‘শুভ বিবাহ’ নিয়ে প্রশংসিত আলোচনা করেছিলেন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। দীর্ঘ আলোচনা, প্রবন্ধের মতো করে লেখা। রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসটির মধ্যে লেখিকার ‘ক্ষমতার প্রচুর পরিমাণে প্রকাশ’ লক্ষ করেছিলেন।

শরৎকুমারী চৌধুরানী

ঘড়িটি যে একান্তই নিরুপায় হয়ে কবি বিক্রি করছেন, তা শরৎকুমারীর অজানা ছিল না। বিপন্ন প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই ঘড়িটি কিনেছিলেন।

ভুলেও শরৎকুমারী ব্যবহার করেননি, দমটুকু দিতেন মাত্র, সযত্নে ঘড়িটি আগলে রেখেছিলেন। অনেক বছর পর, ঘটনাচক্রে ঘড়িটি ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের বিবাহ-অনুষ্ঠানে অনেকের মতো শরৎকুমারীও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। পরম যত্নে আগলে রাখা কবির ঘড়িটি ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছিলেন শরৎকুমারী। বিয়ের দিনে রথীন্দ্রনাথের হাতে একটি ছোট বাক্স তুলে দিয়েছিলেন।

কী আছে ছোট্ট বাক্সটিতে, স্বভাবতই কৌতূহল জাগ্ৰত হয় রথীন্দ্রনাথের মনে। দ্রুত বাক্সটি খুলে ফেলেন। খুলে বিস্ময়ের আর সীমা থাকে না! যে ঘড়িটি পিতৃদেব বিক্রি করে দিয়েছিলেন, এই সুযোগে সেটি ফিরিয়ে দিয়েছেন শরৎকুমারী! রথীন্দ্রনাথের মনে পড়ে ছেলেবেলার স্মৃতি। লেখার ঘরে বাবা ঘড়িতে দম দিচ্ছেন, না, মনের কোণে জেগে থাকা সে-ছবিতে ধুলো জমেনি, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও ঝলমলে উজ্জ্বল। স্মৃতিবিজড়িত ঘড়িটি ফিরে পেয়ে রথীন্দ্রনাথের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিল। এখন ঘড়িটি সযত্ন সংরক্ষিত রয়েছে শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রভবনের মিউজিয়ামে।

সোনার পকেট-ঘড়িতে দম দেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ দম দিতেন আরেকটি ঘড়িতে। সেটি দ্বারকানাথের ক্যারেজ ক্লক। ঘড়িটি তৈরির ব্যবস্থা করলেও দ্বারকানাথের ব্যবহার করার সুযোগ হয়নি। ঘটনাটি খুলে বলা যেতে পারে।

দ্বারকানাথ তখন বিলেতে। বিলেতের ঘড়ি-কারিগর ম্যাককেবের নাম তিনি স্বদেশে বসেই শুনেছিলেন। ঘড়ি-কারিগর ম্যাককেবের সেকালে জুড়ি ছিল না। অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। তাঁর খ্যাতি দেশান্তরেও ছড়িয়ে ‌পড়ছিল। দ্বারকানাথ তাঁর কথা জানতেন। ও-দেশে গিয়েই ম্যাককেবের খোঁজ করছিলেন। ঘড়িশিল্পীকে ঘড়ি তৈরির বরাত দিয়েছিলেন। আগাম টাকাও দিয়েছিলেন।

ঘড়ি তৈরি করে যাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি, তিনি ঘড়ি তৈরি করে দেবেন, এসব ভেবে দ্বারকানাথ পুলকিত হয়েছেন। কত ভাবনা, কত পরিকল্পনা। না, সে-ঘড়ি শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথের হাতে পৌঁছোয়নি। ঘড়ি তৈরি শেষ হওয়ার আগেই দ্বারকানাথ প্রয়াত হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল তাঁর বিলেতে।

যত্ন করে ম্যাককেব ঘড়ি তৈরি করে পড়লেন মহাবিপদে! আগাম টাকা দেওয়া সেই ক্রেতা গেলেন কোথায়! অনেক খোঁজাখুঁজি। আপাদমস্তক সৎ মানুষ। টাকা আগাম নিয়েছেন, অথচ তাঁকে ঘড়ি দেবেন না, তা আবার হয় নাকি! শুরু করলেন খোঁজাখুঁজি। শেষে ম্যাককেব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শরণাপন্ন হলেন! চেষ্টা করেও দ্বারকানাথের ওয়ারিশের সন্ধান পাওয়া গেল না। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যে দ্বারকানাথের পুত্র, এই তথ্যটুকু শুধু জানতে পারেন। কী আর করবেন, নিরুপায় হয়েই ম্যাককেব ওই ঠিকানায় ঘড়িটি পাঠিয়ে দিলেন।

রবীন্দ্রনাথ

ঘড়িটি হাতে নিয়ে মহর্ষিদেবের বিস্ময়ের শেষ থাকেনি। মানুষটির সততা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। পরে তিনি এই ঘড়িটি যোগ্যজনকেই দিয়েছিলেন। পিতার কাছ থেকে উপহার হিসেবে ঘড়িটি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথ মহর্ষিদেবের কাছ থেকে তাঁর পিতৃদেবের এই ঘড়ি পাওয়া নিয়ে লিখেছেন, ‘বাবার কাছে এইজন্য ঘড়িটার বিশেষ মূল্য ছিল, তিনি খুব যত্ন করে নিজের কাছে রেখেছিলেন, নিজেই নিয়মিত তাতে দম দিতেন।’

রবীন্দ্রনাথ সত্যিই যত্নে রেখেছিলেন সে-ঘড়িটি। প্রতি রোববার নিয়ম করে দম দিতেন। যে হাতে কলম ধরেন, সে হাতে ঘড়ির চাবি। অন্যরকম এই দৃশটি রথীন্দ্রনাথ ও মাধুরীলতা রীতিমতো উপভোগ করতেন। তাঁদের কাছে ‘এটি একটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানের মতো ছিল।’

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content