
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ভাগ্নি সরলা রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মদিন পালন করেছিলেন। কবি সেদিন ছিলেন মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। সরলা নীরবে নিঃশব্দে নিভৃতে কবির ঘরে পৌঁছে পায়ের কাছে রেখেছিলেন মালা আর ফুল। মালাটি ছিল বেলফুলের। বেলফুলের মৃদু সৌরভে সেই গ্রীষ্ম-সকাল নিশ্চিত ভিন্নতর ব্যঞ্জনা পেয়েছিল। সরলা দেবীর ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইতে জানিয়েছেন, ‘সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।’
কবির জন্মদিন প্রথম-প্রথম পারিবারিক পরিমণ্ডলেই পালিত হত। জন্মোৎসব উদযাপনের আনন্দঘন মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ অতীতকাতর হয়ে জানিয়েছিলেন, এক সময় সকাল হতে না হতে প্রিয়জনরা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতেন, ‘আজ তোমার জন্মদিন।’ ফুল তুলে পরম আন্তরিকতায় ঘর সাজাত তাঁরা। সে সব কথা বলতে বলতে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, ‘আত্মীয়দের সেই আনন্দ-উৎসবের মধ্যে মনুষ্যজন্মের একটি বিশেষ মূল্য সেদিন অনুভব করতুম।’
কবির জন্মদিন প্রথম-প্রথম পারিবারিক পরিমণ্ডলেই পালিত হত। জন্মোৎসব উদযাপনের আনন্দঘন মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ অতীতকাতর হয়ে জানিয়েছিলেন, এক সময় সকাল হতে না হতে প্রিয়জনরা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতেন, ‘আজ তোমার জন্মদিন।’ ফুল তুলে পরম আন্তরিকতায় ঘর সাজাত তাঁরা। সে সব কথা বলতে বলতে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, ‘আত্মীয়দের সেই আনন্দ-উৎসবের মধ্যে মনুষ্যজন্মের একটি বিশেষ মূল্য সেদিন অনুভব করতুম।’
পরিবারের গণ্ডির বাইরে বৃহত্তর অঙ্গনে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন প্রথম পালিত হয়েছে তাঁরই হাতে গড়া শান্তিনিকেতনে, প্রকৃতির মাঝখানে, আশ্রমিক পরিবেশে। ঊনপঞ্চাশ পেরিয়ে পঞ্চাশে পদার্পণ করবেন কবি। আশ্রমে তাঁর জন্মদিন পালিত হবে, এই মর্মে আশ্রমবাসী ছাত্র, শিক্ষক ও প্রিয়জনরা এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, সে সংবাদ জানার পর রবীন্দ্রনাথ চমকিতই হয়েছিলেন, সেই সঙ্গে বিচলিতও। বিচলিত হওয়ার কারণ একটাই, সংকোচ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৫: রবীন্দ্রনাথ আশুতোষ চৌধুরির বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৭: একাকিত্বের অন্ধকূপ/২: অন্ধকারের উৎস হতে
জন্মদিন পালনের সংবাদ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন আকস্মিক। শান্তিনিকেতন থেকে কবি জোড়াসাঁকো এসেছিলেন। যাবেন সমুদ্র-দর্শনে, পুরীতে। সে যাত্রা বাতিল হয়। পুরী যাবার পরিকল্পনার কথা অবশ্য জোড়াসাঁকোতে প্রচারিত হয়নি। আশ্রমেও গোপন ছিল। বিদ্যালয়ে গ্রীষ্মাবকাশ শুরু হওয়ার পর, ১৩ বৈশাখ ১৩১৭ কলকাতায় এসেছিলেন কবি। রাতের দিকে ট্রেন পৌঁছেছিল হাওড়ায়। পরের দিন মেয়ো হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের কাছে কবি এক দৃষ্টিহীন ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন। জানা যায়, মানুষটি ‘দৈবদুর্বিপাকে ঘুরিতে ঘুরিতে… আশ্রমে আসিয়া’ উপস্থিত হয়েছিলেন। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের আরও কিছু কর্মসূচি ছিল। সিটি কলেজে গিয়েছিলেন। সপরিবারে বালিগঞ্জেও গিয়েছিলেন। সেসবের উল্লেখ আছে ‘ক্যাশবহি’তে। হাতের কাজ মিটিয়ে পুরী যাওয়ার কথা থাকলেও যেতে পারেননি। কী কারণে, কেন শান্তিনিকেতনে ফিরে যেতে হয়েছিল, তা স্পষ্ট করে জানাননি রবীন্দ্রনাথ। অচ্যুতচন্দ্র সরকারকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘পুরী যাওয়া হইল না। যেখানে আমার চরম গতি সেইখানে চলিলাম—অর্থাৎ বোলপুরে।’

জগদানন্দ রায়।
যেখানে ‘চরম গতি’, কর্মচঞ্চলতা, সেখানে রয়েছেন পরমপ্রিয় ছাত্র-শিক্ষকরা। তাঁরা কবির জন্মদিন পালন করবেন, চলেছে সে প্রস্তুতি। আশ্রমে পৌঁছে কবি তা লক্ষ করেছিলেন। ১৩১৭-র ২৫শে বৈশাখ সকালে প্রাণের আনন্দে পালন করা হয়েছিল কবির জন্মদিন। ফুল-মালা, প্রণাম শ্রদ্ধার্ঘ্য, কবির মরমি বক্তৃতার মধ্য দিয়ে সকালটি বড়ো মনোরম হয়ে উঠেছিল। সন্ধ্যায় নাট্যাভিনয়ের ব্যবস্থা। ‘বিসর্জন’ অভিনয়ের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত অভিনীত হয়েছিল ‘প্রায়শ্চিত্ত’। মূলত আশ্রম-শিক্ষকরা নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যাঁর জন্মদিবস উদযাপনের আয়োজন, তিনি নিজের হাতে নাট্যকুশীলবদের সাজিয়ে দিয়েছিলেন। আশ্রম-বিদ্যালয়ের ছাত্র গিরিজানাথ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘গুরুদেব সকলকে সাজাইয়া দিলেন। জগদানন্দবাবুকে সাজাইয়া গুরুদেব বলিলেন, মানিয়েছে যেন কার্তিকের মতো।… সকলকে সাজাইয়া দিয়া গুরুদেব নিজে গিয়া দর্শকের সঙ্গে আসনে উপবেশন করিলেন। প্রায়শ্চিত্ত নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর গান খুব সুন্দর হইয়াছিল।’
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১৩: ভাবনা উইদাউট ভদ্কা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১৩: একটি হিংসা অনেক প্রতিহিংসা, জিঘাংসা, হত্যা এবং মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে সর্বত্র
জন্মদিনকে কেন্দ্র করে আনন্দের প্রকাশ সম্পূর্ণতা পেয়েছিল ক্রীড়া-ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। শেষ-পাতে ছিল একটু-আধটু খেলাধুলো। অভিনয়ের পর খেলাধুলার আয়োজন হয়েছিল। গিরিজানাথের লেখা থেকেই জানা যায়, শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে ‘দড়ি টানাটানি’ খেলা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘এই নাও আমি মাঝখানে রইলুম।’
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৭: শ্রীমার কথায় ‘ঠাকুরের দয়া পেয়েচ বলেই এখানে এসেচ’

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৫: সর্বত্র বরফ, কোত্থাও কেউ নেই, একেবারে গা ছমছম করা পরিবেশ
প্রিয় ছাত্র, প্রিয় শিক্ষক ও প্রিয় আশ্রমিকদের সেই আয়োজন, জন্মদিন উদযাপন কবিকে মুগ্ধ করেছিল। মুগ্ধতার সঙ্গে আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কবি আবেগময় কণ্ঠে দিয়েছিলেন দীর্ঘভাষণ। দ্বিধা-সংকোচের কথা বলেছিলেন। কণ্ঠে গোপন থাকেনি প্রাপ্তির আনন্দ। বলেছিলেন, ‘আজ তোমরা যখন আমাকে এই জন্মোৎসবের সভা সাজিয়ে তার মধ্যে আহ্বান করলে তখন প্রথমটা আমার মনের মধ্যে সংকোচ উপস্থিত হয়েছিল। আমার মনে হল, জন্ম তো আমার অর্ধশতাব্দীর প্রান্তে কোথায় পড়ে রয়েছে, সে যে কবেকার পুরানো কথা তার আর ঠিক নেই— মৃত্যুদিনের মূর্তি তারচেয়ে অনেক বেশি কাছে এসেছে- এই জীর্ণ জন্মদিনকে নিয়ে উৎসব করবার বয়স কি আমার?’

প্রিয়ম্বদা দেবী।
আয়োজনের পরতে পরতে ছিল প্রাণের স্পর্শ, গভীর আন্তরিকতা। আয়োজকরা কেউই পরিবারের মানুষ নন, তা সত্ত্বেও কত আন্তরিক। অনাত্মীয় হয়েও আত্মীয়। সকলেই তাঁরা ‘আপনার জন’। এই আপন হয়ে ওঠার মধ্য দিয়েই জীবনের সার্থকতা, জন্মদিন পালনের সার্থকতা। কবি তাঁর সেই উপলব্ধি ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে, ‘আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে উৎসব করছ তার মধ্যে যদি এই কথাটি থাকে, তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাক, আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছা হয়ে থাকে, তা হলেই উৎসব সার্থক। আমার এই পঞ্চাশ বৎসর বয়সেও আমাকে তোমরা নূতন করে পেয়েছ; আমার সঙ্গে তোমাদের সম্বন্ধের মধ্যে জরাজীর্ণতার লেশমাত্র লক্ষণ নেই।… আমার সমস্ত দ্বন্দ্ব এবং অপূর্ণতার বিচিত্র অসংগতির ভিতরেও আমি তোমাদের কাছে এসেছি।… একটি মঙ্গললোকের সম্বন্ধে তোমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমি তোমাদের আপন হয়েছি, সেইটে তোমরা হৃদয়ে জেনেছ— এবং সেই জন্যেই আজ তোমরা আমাকে নিয়ে এই উৎসবের আয়োজন করেছ একথা যদি সত্য হয় তবেই আমি আপনাকে ধন্য বলে মনে করব, তোমাদের সকলের আনন্দের মধ্যে আমার নূতন জীবনকে সার্থক বলে জানব।’
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৮: রক্তে ভেজা মাটিতে গড়ে ওঠে সত্যিকার প্রাপ্তি

পঁচিশে বৈশাখ
পঁচিশে বৈশাখের সকালে জন্মদিবস উদযাপনের পর কবি চিঠি লিখতে বসেছিলেন প্রিয়ম্বদা দেবীকে। প্রিয়ম্বদার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সখ্য ছিল। সংসার-জীবনে বিপর্যস্ত প্রিয়ম্বদা রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে জীবনের মাধুর্য খুঁজে পেয়েছিলেন। কবি ছিলেন তাঁর কাছে পরম আশ্রয়। প্রিয়ম্বদা দেবীকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কতখানি আনন্দ পেয়েছিলেন কবি। একসময় পরিবারের গণ্ডিতে জন্মদিন-পালন হলেও পরে ভাঁটা পড়েছিল। কবি বোধহয় ভুলেও গিয়েছিলেন তাঁরও একটা জন্মদিন আছে। মনের কোণে জমে থাকা বেদনা পঞ্চাশতম জন্মদিবসের প্রাতে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল। সেই ভালোলাগা ভাগ করে নিয়েছিলেন প্রিয়ম্বদা দেবীর সঙ্গে। তাঁকে লিখেছেন, ‘আজ এখানে প্রাতে আমার জন্মদিনের উৎসব হয়ে গেল। আমার যে একটা জন্মদিন আছে সে কথা ভুলে গিয়েছিলুম। বহুকাল হয়ে গেল যখন আত্মীয় পরিজনের স্নেহের মধ্যে এই উৎসব হত…। এখন যারা আমার কাছে এসেছে আমাকে কাছে পেয়েছে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার কোনো সম্বন্ধ নেই—তারা কত দেশের কত ঘরের কত ছেলে। তারাই আনন্দ করে আজ সকালে আমাকে নিয়ে উৎসব করেছে—এই আমার আশ্রমের জীবন—এই আমার মঙ্গললোকে নূতন জন্মলাভ। ঈশ্বর আমার এই জন্মকে সার্থক করুন এই প্রার্থনা করি।’

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।
আনন্দমুখর এই জন্মদিবস পালনে কলকাতার মানুষজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব —না, কেউই আসেননি। আসলে কাউকেই ডাকা হয়নি। কবির পঞ্চাশে পদার্পণের সেই দিনটি একান্তই আশ্রমের মানুষজন, ছাত্র-শিক্ষকরা পালন করতে চেয়েছিলেন। সেই আনন্দযজ্ঞে সকলের নিমন্ত্রণ ছিল না। একমাত্র ব্যতিক্রম প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। কলকাতা থেকে এসেছিলেন কবির স্নেহভাজন পরমপ্রিয় প্রশান্ত। সেদিন আশ্রমে গেরুয়া বসন পরা এক অচেনা বৈরাগী কোথা থেকে হাজির হয়েছিল। আশ্রমে পুলিশের গুপ্তচর মাঝেমধ্যেই আসত। আগন্তুক তেমন কেউ নয় তো! আনন্দের দিনে আশঙ্কার কালো মেঘ কারও কারও মনে দেখা দিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ তাকে জব্দ করার নানা ফন্দি আঁটা হয়। বিড়ম্বিত আগন্তুক শেষে বাধ্য হয়েই পালিয়েছিল। তাকে আর কেউ দেখতে পায়নি। আর কোনো অঘটন ঘটেনি। নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে শান্তিনিকেতন-আশ্রমে পালিত হয়েছিল কবির প্রথম জন্মদিন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।