বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ তখন খ্যাতির শিখরে। তাঁর চলা, বলা দেখে কে বলবে পৃথিবীর সেরা সাহিত্য-সম্মান পরাধীন দেশের এই কবি অর্জন করেছেন! খুবই সাদামাঠা জীবনযাপন। অহমিকা-দম্ভ কখনও স্পর্শ করেনি তাঁকে। কত সাধারণ মানুষ তাঁর কাছে আসত। সকলের সঙ্গেই কবি গল্পগাছা করতেন। এ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এই আলাপচারিতায় কোনও বাধানিষেধ ছিল না। অবারিত দ্বার। ফলে কবির সঙ্গে দেখা করতে, কাজে-অকাজে অনেকেই চলে আসত। এমনকি মাথায় সমস্যা আছে, তেমন কেউ কেউ কখনো চলে এসেছে। অনেক সময় তেমন মানুষজনকে নিয়ে বিপাকেও পড়তে হয়েছে। রানী চন্দের লেখায় আছে, ‘একবার এক পাগল এলো, — কিছুতেই সে আর গুরুদেবকে ছাড়ে না। অথচ কি যে তার বলবার কথা তা সে জানে না।’
কী ঘোরতর সমস্যা রবীন্দ্রনাথের। তখন লেখার সময়, লেখায় যে ডুব দেবেন, মগ্ন হয়ে লিখে যাবেন, তার জো রইল না। উটকো উৎপাতে বিপন্নতা। রানী লক্ষ করেছিলেন, কবির মুখ কেমন যেন ‘করুণ’, বড়ো অসহায় দেখাচ্ছিল তাঁকে। না, এরপরও সাক্ষাৎপ্রার্থীকে বিতাড়িত করেননি তিনি। শেষে অবশ্য নিজে থেকেই পাগল বিদায় নিয়েছিল। সেদিন সন্ধেবেলায় রবীন্দ্রনাথ মজা করে বলেছিলেন, ‘সবারই সময় অসময় আছে, — নেই কেবল আমারই। আমার নিজের বলে দিনের একটুখানি সময়ও আমি পাইনি কখনো।’ কবির এই মন্তব্যে কৌতুকের সঙ্গে বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

এ যাবৎ কোনও বাধা-নিষেধ ছিল না। ওই পাগলের উৎপাতের পর সকলেই নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, এই শিথিলতার কোনো মানে হয় না। উটকো লোকের সঙ্গে ফালতু বকে সময় চলে গেলে লিখবেন কখন! এসব ভেবে কবিকে না বলেই তাঁর সেক্রেটারি কবির সাক্ষাৎলাভের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন করলেন। বাইরে থেকে যে কেউ এসে যখন-তখন গুরুদেবের কাছে যেতে পারবে না। সাক্ষাতের সুনির্দিষ্ট সময় থাকবে। সময় মেনে দেখা করতে হবে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৮: শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলেন দ্বারকানাথ

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা

দু’দিন বই তো নয়! দু’দিন বেশ লোকজন আটকানো গেল। রবীন্দ্রনাথ নির্বিঘ্নে লেখা ও পড়ার কাজ করলেন। তিন দিনের দিন কেমন যেন সবকিছু পাল্টে গেল। কোথা থেকে একটা লোক এসে সেদিন বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করছিল। কবির চোখ এড়িয়ে যায়নি। নজরে পড়তেই তাঁর মনে হল, লোকটা নির্ঘাত দেখা করতে এসেছে। সে কারণেই এমনভাবে ঘোরাঘুরি করছে। বাড়ির ভেতরে যে ঢুকবে, দেখা করবে, তার তো আর উপায় নেই। একথা ভেবে রবীন্দ্রনাথ একটু দুঃখই পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেক্রেটারিকে ডাকলেন। ডেকে যা বললেন, তা সত্যিই অভিভূত হওয়ার মতো। কবি বললেন, ‘তোরা কি ভাবিস আমি একটা কেউকেটা — নবাব বাদশা? আমার কাছে আসতে হলে সেপাইশান্ত্রী পেরিয়ে তবে আসতে হবে?’

রানী চন্দ।

রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্পর্কে যা বলেছেন, তা তাঁর মহত্ত্বেরই পরিচয় দেয়। উচ্চতায় তিনি আকাশ ছুঁয়েছিলেন, খ্যাতির শিখরে তখন তাঁর অবস্থান, অথচ কতখানি বিনয়ী! বানানো বিনয় নয়, ভেতর থেকে উঠে আসা, সত্যিই আমাদের অভিভূত করে।

দেখাসাক্ষাৎ নিয়ে বিধিনিষেধ জারি করায় রবীন্দ্রনাথ যে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, তা তাঁর কথাতেই ফুটে উঠছিল। সাধারণজনের জন্য তাঁর কাতরতা গোপন থাকেনি। কবি আরও বলেছিলেন,’আহা, বেচারারা — দূর দূর হ’তে আসে, কি-না, আমায় একটু দেখে যাবে, কি প্রণাম করবে, না হয় দুটো কথা বলবে। তার জন্য এত কী কড়াক্কড়ি?’

খেদোক্তি নয়, রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে এরপর রাণী চন্দ শুনেছিলেন নির্দেশের সুর। একটু কঠোর গলাতেই বলেছিলেন তিনি,’দোর আমার খোলা থাকবে। যার যখন মন চায় আসবে আমার কাছে। কাউকে বাধা দিসনে যেন তোরা আর কখনো।’
কবি এ কী বলছেন! এভাবে সবার জন্য সারাক্ষণ বাড়ির দরজা খোলা রাখলে লিখবেন কখন! যাঁদের উদ্দেশে এসব বলা, তাঁরা মনে মনে ‘হায়-হায়’ করে উঠলেও মুখে কিছু বললেন না। কবির মুখের ওপর কথা, না, কখনোই নয়। কবির সেক্রেটারি এটুকু বুঝলেন, সত্যিই সবার জন্য সারাক্ষণ দরজা খোলা রাখলে কবির ক্ষতিই হবে!
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৯: আলোকলতা তিলোত্তমারা যুগে যুগে পুরুষের উজ্জীবনী শক্তির আধার

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৬: হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে

সেকথা ঠারেঠোরে বোঝানোর চেষ্টা করে অবশ্য কাজের কাজ কিছু হল না। রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্তে অবিচল। বুঝিয়ে দিলেন, হোক একটু-আধটু ক্ষতি। দেখা করতে এসে কেউ দেখা করতে পারবে না, এটা হতে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ ডাকে আসা সব চিঠিই দেখতেন। তখন চিঠিই ছিল যোগাযোগের মাধ্যম। মানুষ চিঠিতেই মনের কথা, দরকারের কথা, অদরকারের কথা সব ব্যক্ত করত। রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিনই ডাকে আসা চিঠির ঝাঁপি নিয়ে বসতেন। একটা-দুটো চিঠি নয়, অনেকানেক চিঠি। কত রকমের চিঠি। চিঠিতে থাকত রকমারি আর্জি, বিচিত্র দাবি। আবার কাজের কথাও থাকত। পাগলের উৎপাত বন্ধ করার জন্য মানুষের প্রবেশাধিকার খর্ব করা হলেও চিঠির পাগলরা রয়েই যায়। রবীন্দ্রনাথ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ‘ডক্টরেট’ পেয়েছিলেন। স্বভাবতই নামের আগে ‘ডাঃ’ লিখতে কোনও অসুবিধা ছিল না। তিনি হয়তো লিখতেন না, অন্যরা কখনো-সখনো লিখে দিতেন। অনেক জায়গায় ‘ডাঃ’ যুক্ত করে তাঁর নাম ছাপাও হয়েছে। তা দেখে কেউ দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ চেয়ে কবিকে চিঠি লিখেছে। বলে নেওয়া ভালো, তখন ডক্টরেটের ক্ষেত্রেও ‘ড.’ না লিখে ‘ডাঃ’ লেখা হত।

রানীর বই।

নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্য কাকে ধরবে, কোথায় তদবির করবে, কী কৌশলে পাওয়া যাবে, এসব জানতে চেয়েও রবীন্দ্রনাথকে কেউ কেউ চিঠি লিখেছে। এমন সব অবান্তর কথায় ভরা চিঠির পাশাপাশি অনেক অনেক চিঠি আসত,যার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। কেউ হয়তো প্রেরিত বই -সম্পর্কে মতামত জানতে চাইত। আবার এমনও ঘটেছে, কন্যাদায়গ্ৰস্ত কোনও পিতা কন্যার জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজে দিতে কবিকে অনুরোধ করেছে। আরও কত আবদার, সেই আবদারে মিশে থাকত কবির প্রতি নির্মল ভালোবাসা। কেউ চাইত বিয়ের পদ্য, বিবাহ-উপলক্ষে বিলি করা হবে, সে পদ্য লিখে দিতে হবে কবিকে। রবীন্দ্রনাথের বিড়ম্বনার শেষ ছিল না।
আরও পড়ুন:

প্রজাতন্ত্র

মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

রবীন্দ্রনাথ সব চিঠি রোজ পড়তেন, উত্তর দিতেন, তা নয়। গুরুত্বপূর্ণ চিঠি, যে চিঠির উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন, তা আলাদা করে সরিয়ে রাখতেন। অপ্রয়োজনীয় চিঠি নিজের হাতে ছিঁড়ে ফেলতেন । শত শত চিঠি আসত। সব চিঠি খুঁটিয়ে পড়ারও দরকার হত না। বেশিরভাগ চিঠির শুরুটা দেখলেই কী লেখা আছে, তা আন্দাজ করতে পারতেন। চিঠি দেখতে দেখতে সেই চিঠির পেছনে, খামে বা চিঠির ছেঁড়া টুকরোতে রবীন্দ্রনাথ তাৎক্ষণিকভাবে কখনো কবিতাও লিখে ফেলতেন। লিখে যে সযত্নে রেখে দিতেন, তা নয়। লিখে প্রায়শই ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিতেন। দুই ভৃত্য, কখনো বনমালী, কখনো মহাদেব না বুঝে কবিতা লেখা টুকরো-কাগজ অকাতরে ফেলেও দিত। তাদের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই, রানী চন্দের দেওয়া এই তথ্য নিশ্চিত সত্য। এভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা কত যে ছোটো ছোটো কবিতা হারিয়ে গিয়েছে, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০০: চোর মাচায়ে শোর

চিঠির উত্তর লেখা কবির দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই পড়ত। সব চিঠিতে কবির প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থাকত, তা নয়। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে আক্রমণ থাকত, আঘাত করার, আহত করার চেষ্টাও থাকত। এমনই এক ঘটনা চোখে পড়ে যায় রানী চন্দের। একদিন একটি চিঠি পড়ে কবি ভিতরে ভিতরে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তখনই সে চিঠির উত্তরও লিখে ফেলেন। উত্তর লেখার পর এক মিনিটও বিলম্ব নয়, সে চিঠি ডাকবাক্সে ফেলে আসার জন্য সেক্রেটারিকে ডাকলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন। কবি চিঠিটি লিখছিলেন বেশ উত্তেজিতভাবে। তাঁরও হাত কাঁপছিল, রানী চন্দ তা দেখেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা রানীর বই, সেই বই নিয়ে অবনীন্দ্রনাথের চিঠি।

চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলার জন্য সেক্রেটারিকে দেওয়ার একটু পরেই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ভাবান্তর দেখা যায়। উত্তেজনা থিতিয়ে কাঁপুনি থামার পরই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেক্রেটারিকে আবারও ডাকলেন। ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, চিঠিটা ডাকে দিয়ে এসেছে কিনা। দিয়ে আসা হয়নি, একটু পরেই যাবে শুনে তখনই নির্দেশ দিয়েছেন, ‘ফেলে দে ছিঁড়ে।’

কেন ছিঁড়তে বললেন. তাও স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন। উত্তেজিত হয়ে চিঠি লেখার পরমুহূর্তেই কবির মনে হয়েছিল, এমন কর্কশ ভাষায় চিঠি পেলে, যাকে লেখা, সে বেচারা খুব দুঃখ পাবে।

বোঝা যায়, কতখানি সহৃদয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content