শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত: ৩/১৪/৪) ঈশ্বরের আনন্দ পেলে সংসার কাকবিষ্ঠা হয়ে যায়। আমি আগে সব ছি করে দিছলাম। বিষয়ী সঙ্গ তো ত্যাগ করলাম, আবার মাঝে মাঝে ভক্ত সঙ্গ-ফঙ্গও ত্যাগ করেছিলাম। দেখলুম পট পট করে মরে যায়, আর শুনে ছটফট করি। এখন তবু একটু লোক নিয়ে থাকি।
রবীন্দ্রসংগীত (২৫ বছর বয়সে লেখা।) রবীন্দ্রনাথ সংসারে থেকেও ঈশ্বরের আনন্দ পেয়েছিলেন বলেই, যৌবনে মানুষ যখন সাংসারিক আনন্দে একেবারে মেতে থাকে, তখন তাঁর কলম থেকে বের হয়েছে এইসব কালজয়ী গান—
তাঁহার প্রেমে কে ডুবে আছে
চাহে না সে তুচ্ছ সুখ ধন মান
বিরহ নাহি তার, নাহি রে দুখতাপ,
সে প্রেমের নাহি অবসান।
***
দুখ দূর করিলে, দর্শন দিয়ে মোহিলে প্রাণ।
সপ্তলোক ভুলে শোক তোমারে চাহিয়ে—
কোথায় আছি আমি দীন অতি দীন।
(নরেন্দ্রনাথ, পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ, এই গানটি শ্রীরামকৃষ্ণকে ১১ মার্চ, ১৮৮৫ সালে গেয়ে শোনান এবং শ্রীরামকৃষ্ণ গানটি শুনে সমাধিস্থ হয়েছিলেন।)
***
দাও হে হৃদয় ভরে দাও।
তরঙ্গ উঠে সুধাসাগরে,
সুধারসে মাতোয়ারা করে দাও।
যেই সুধারস পানে ত্রিভুবন মাতে তাহা মোরে দাও।
***
তব প্রেম সুধারসে মেতেছি।
ডুবেছে মন ডুবেছে
কোথা কে আছে নাহি জানি—
তোমার মাধুরী পানে মেতেছি,
ডুবেছে মন ডুবেছে।
চাহে না সে তুচ্ছ সুখ ধন মান
বিরহ নাহি তার, নাহি রে দুখতাপ,
সে প্রেমের নাহি অবসান।
সপ্তলোক ভুলে শোক তোমারে চাহিয়ে—
কোথায় আছি আমি দীন অতি দীন।
(নরেন্দ্রনাথ, পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ, এই গানটি শ্রীরামকৃষ্ণকে ১১ মার্চ, ১৮৮৫ সালে গেয়ে শোনান এবং শ্রীরামকৃষ্ণ গানটি শুনে সমাধিস্থ হয়েছিলেন।)
তরঙ্গ উঠে সুধাসাগরে,
সুধারসে মাতোয়ারা করে দাও।
যেই সুধারস পানে ত্রিভুবন মাতে তাহা মোরে দাও।
ডুবেছে মন ডুবেছে
কোথা কে আছে নাহি জানি—
তোমার মাধুরী পানে মেতেছি,
ডুবেছে মন ডুবেছে।
আরও পড়ুন:
সুসময় রায় চৌধুরী, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, পর্ব-৪: শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…
শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত: ৩/১৪/৫) “যারা ‘সংসারে ধর্ম’ ‘সংসারে ধর্ম’ করছে, তারা একবার যদি ভগবানের আনন্দ পায় তাদের আর কিছু ভালো লাগে না, কাজের সব আঁট কমে যায়, ক্রমে যত আনন্দ বাড়ে কাজ আর করতে পারে না। কেবল সেই আনন্দ খুঁজে বেড়ায়! ভগবানের আনন্দের কাছে বিষয়ানন্দ আর রমনানন্দ! একবার ভগবানের আনন্দের আস্বাদ পেলে সেই আনন্দের জন্য ছুটোছুটি করে বেড়ায়, তখন সংসার থাকে আর যায়।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৯: রাজবাড়ির সান্নিধ্যে নারীর উড়ান
সব লেখাই বিজ্ঞানের: শব্দদূষণ প্রতিরোধ করবে এই গ্রিন মাফলার, জানতেন?
“ঈশ্বরের আনন্দ পেলে আর কিছু ভালো লাগে না। তখন কামিনী-কাঞ্চনের কথা যেন বুকে বাজে। (ঠাকুর কীর্তনের সুরে বলিতেছেন ) “আন লোকের আন কথা কিছু ভাল ত লাগে না!” তখন ঈশ্বরের জন্য পাগল হয়, টাকা-ফাকা কিছুই ভালো লাগে না!”
শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত: ৩/১৪/৭) “…ভগবানের আনন্দের সন্ধান পায় নাই, তাই ‘সংসার, সংসার’ করছে। …ভগবানের আনন্দের আস্বাদ না পেলে সে আনন্দের কথা বুঝতে পারে না। পাঁচ বছরের বালককে কি রমণ-সুখ বোঝানো যায়? বিষয়ীরা যে ঈশ্বর ঈশ্বর করে সে শোনা কথা।”
সংসারীরা যদি কখনও সত্যি ঈশ্বরের আনন্দ পায়, তখন তাঁর মনের কি অবস্থা হয়? রবীন্দ্রসংগীত—
“বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে।
সব গগন উদবেলিয়া—মগন করি অতীত অনাগত
আলোকে উজ্জ্বল জীবনে চঞ্চল একি আনন্দ তরঙ্গ।
তাই, দুলিছে দিনকর চন্দ্র
তারা,
চমকি কম্পিছে চেতনাধারা
আকুল চঞ্চল নাচে সংসার, কুহরে হৃদয়বিহঙ্গ।”
***
রহি রহি আনন্দতরঙ্গ জাগে।
রহি রহি প্রভু, তব পরশ মাধুরী
হৃদয়মাঝে আসি লাগে।
***
“চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না
সংসার গহনে নির্ভয় নির্ভর নির্জনসজনে সঙ্গে রহো।
অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল
জরাভারাতুরে নবীন করো ওহে সুধাসাগর।”
***
“হৃদয়বাসনা পূর্ন হল আজি মম পূর্ণ হল
শুন সবে জগতজনে।
কী হেরিনু শোভা, নিখিলভুবননাথ
চিত্তমাঝে বসি স্থির আসনে।”
***
“শূন্য প্রাণ কাঁদে সদা—প্রাণেশ্বর,
দীনবন্ধু, দয়াসিন্ধু,
প্রেমবিন্দু কাতরে কারো দান।
করো না সখা, করো না
চিরনিস্ফল এই জীবন।
প্রভু জনমে মরণে তুমি গতি,
চরণে দাও স্থান।”
***
“কী সুর বাজে আমার প্রাণে
আমিই জানি, মনই জানে।
কিসের লাগি সদাই জাগি, কাহার কাছে কী ধন মাগি–
তাকাই কেন পথের পানে।
দ্বারের পাশে প্রভাত আসে,
সন্ধ্যা নামে বনের বামে।
সকাল-সাঁঝে বংশী বাজে,
বিকল করে সকল কাজে—
বাজায় কে যে কিসের তানে।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (কথামৃত: ৩/১৪/৭) “…ভগবানের আনন্দের সন্ধান পায় নাই, তাই ‘সংসার, সংসার’ করছে। …ভগবানের আনন্দের আস্বাদ না পেলে সে আনন্দের কথা বুঝতে পারে না। পাঁচ বছরের বালককে কি রমণ-সুখ বোঝানো যায়? বিষয়ীরা যে ঈশ্বর ঈশ্বর করে সে শোনা কথা।”
সংসারীরা যদি কখনও সত্যি ঈশ্বরের আনন্দ পায়, তখন তাঁর মনের কি অবস্থা হয়? রবীন্দ্রসংগীত—
সব গগন উদবেলিয়া—মগন করি অতীত অনাগত
আলোকে উজ্জ্বল জীবনে চঞ্চল একি আনন্দ তরঙ্গ।
তাই, দুলিছে দিনকর চন্দ্র
তারা,
চমকি কম্পিছে চেতনাধারা
আকুল চঞ্চল নাচে সংসার, কুহরে হৃদয়বিহঙ্গ।”
রহি রহি প্রভু, তব পরশ মাধুরী
হৃদয়মাঝে আসি লাগে।
সংসার গহনে নির্ভয় নির্ভর নির্জনসজনে সঙ্গে রহো।
অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল
জরাভারাতুরে নবীন করো ওহে সুধাসাগর।”
শুন সবে জগতজনে।
কী হেরিনু শোভা, নিখিলভুবননাথ
চিত্তমাঝে বসি স্থির আসনে।”
দীনবন্ধু, দয়াসিন্ধু,
প্রেমবিন্দু কাতরে কারো দান।
করো না সখা, করো না
চিরনিস্ফল এই জীবন।
প্রভু জনমে মরণে তুমি গতি,
চরণে দাও স্থান।”
আমিই জানি, মনই জানে।
কিসের লাগি সদাই জাগি, কাহার কাছে কী ধন মাগি–
তাকাই কেন পথের পানে।
দ্বারের পাশে প্রভাত আসে,
সন্ধ্যা নামে বনের বামে।
সকাল-সাঁঝে বংশী বাজে,
বিকল করে সকল কাজে—
বাজায় কে যে কিসের তানে।”
আরও পড়ুন:
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৬: তোমার গানের এই ময়ুরমহলে
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর
মাহিমাচরণ (কথামৃত: ৪/১২/২) মহাশয়, মানুষ কেন বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়? শ্রীরামকৃষ্ণ— তাঁকে লাভ না করে বিষয়ের মধ্যে থাকে বোলে। তাঁকে লাভ করলে আর মুগ্ধ হয় না। বাদুলে পোকা যদি একবার আলো দেখতে পায়—তা হলে আর তার অন্ধকার ভালো লাগে না।”
রবীন্দ্রসংগীত—
“পেয়েছি সন্ধান তব অন্তর্যামী,
অন্তরে দেখেছি তোমারে।
চকিতে চপল আলোকে,
হৃদয়শতদলমাঝে,
হেরিনু এ কী অপরূপ রূপ।”…
***
“মহারাজ, এ কী সাজে
এলে হৃদয়পুরমাঝে
চরণতলে কোটি শশী
সূর্য মরে লাজে।
গর্ব সব টুটিয়া
মূর্ছি পড়ে লুটিয়া
সকল মম দেহ
বীনাসম বাজে।
এ কী পুলকবেদনা
বহিছে মধুবায়ে।
কাননে যত পুষ্প ছিল
মিলিল তব পায়ে।
পলক নাহি নয়নে,
হেরি না কিছু ভুবনে—
নিরখি শুধু অন্তরে
সুন্দর বিরাজে।”
***
“মধুর রূপে বিরাজ
হে বিশ্বরাজ
শোভন সভা নিরখি
মন প্রাণ ভুলে।
নীরব নিশি সুন্দর,
বিমল নীলাম্বর,
শুচিরুচির চন্দ্রকলা চরণমূলে।”
***
“কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু—
জাগাইলে অনুপম সুন্দর শোভা হে হৃদয়েশ্বর।
সহসাফুটিল ফুলমঞ্জরী
শুকানো তরুতে,
পাষানে বহে সুধাধারা।”
***
“আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো
আমার নয়ন হতে আঁধার
মিলাল মিলাল।
সকল আকাশ সকল ধরা
আনন্দ হাসিতে ভরা,
যে দিক-পানে নয়ন মেলি
ভালো সবই ভালো।”… —চলবে।
রবীন্দ্রসংগীত—
অন্তরে দেখেছি তোমারে।
চকিতে চপল আলোকে,
হৃদয়শতদলমাঝে,
হেরিনু এ কী অপরূপ রূপ।”…
এলে হৃদয়পুরমাঝে
চরণতলে কোটি শশী
সূর্য মরে লাজে।
গর্ব সব টুটিয়া
মূর্ছি পড়ে লুটিয়া
সকল মম দেহ
বীনাসম বাজে।
এ কী পুলকবেদনা
বহিছে মধুবায়ে।
কাননে যত পুষ্প ছিল
মিলিল তব পায়ে।
পলক নাহি নয়নে,
হেরি না কিছু ভুবনে—
নিরখি শুধু অন্তরে
সুন্দর বিরাজে।”
হে বিশ্বরাজ
শোভন সভা নিরখি
মন প্রাণ ভুলে।
নীরব নিশি সুন্দর,
বিমল নীলাম্বর,
শুচিরুচির চন্দ্রকলা চরণমূলে।”
জাগাইলে অনুপম সুন্দর শোভা হে হৃদয়েশ্বর।
সহসাফুটিল ফুলমঞ্জরী
শুকানো তরুতে,
পাষানে বহে সুধাধারা।”
আমার নয়ন হতে আঁধার
মিলাল মিলাল।
সকল আকাশ সকল ধরা
আনন্দ হাসিতে ভরা,
যে দিক-পানে নয়ন মেলি
ভালো সবই ভালো।”…
* সুসময় রায় চৌধুরী (Susamay Roy Chowdhury) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইরাজি সাহিত্যে সাম্মানিক ও সাংবাদিকতায় এমএ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ: ১. শিক্ষায় জীবন গঠন ও আনন্দলাভ—শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ, ২. শ্রীরামকৃষ্ণ-আলোয় সবার জীবন, ৩. শ্রীরামকৃষ্ণের কথা রবীন্দ্রনাথের গান—প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। আরও কয়েকটি খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায়। প্রকাশিতব্য: ১. জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য—ঈশ্বরলাভ, ২. কে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণ?, ৩. কে তুমি বিবেকানন্দ?, ৪. জন্মানতরবাদ—ভারতীয় শাস্ত্র ও ঋষি, মহামানবেরা।