বুধবার ৭ মে, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

রাজনীতিশাস্ত্রে ন্যায় ও অন্যায়ের ভেদ অতি সূক্ষ্ম। বিশেষত রাজ্যের পরিচালনা কিংবা আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নে ন্যায় ও অন্যায় নিতান্তই আপেক্ষিক। ভূমির উপর নিয়ন্ত্রণ যখন রাজকীয় শক্তির মূলকথা, তখন অধিকৃত ভূভাগকে রক্ষা করতেও রাজাকে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়, করতে হয় প্রয়োজনে যুদ্ধ। যুদ্ধে আঘাত হানার পাশাপাশি আত্মরক্ষা করা যোদ্ধার প্রাথমিক কর্তব্য। দরকারে পশ্চাদপসরণ করে শক্তিবৃদ্ধি করে পুনরায় আক্রমণ অথবা শত্রুকে আবদ্ধ করে তাকে দুর্বল করা, অতর্কিত আঘাতে তাকে ছত্রভঙ্গ করা কিংবা তাকে বিপথগামী করে, পরস্পরের ভেদসাধন করাও যুদ্ধকৌশলের অন্তর্গত।

আবার, জীবনের যুদ্ধেও সমান ভাবেই প্রাসঙ্গিক এটি। সেখানেও জয়-পরাজয়ের দ্বন্দ্ব, সংঘাতের ভীষণভ্রূকুটি। শত্রুর আঘাতে পতনের সমূহ সম্ভাবনা এখানে প্রতি পদে পদে। আর রক্তমাংসের শরীরবিশিষ্ট জীব কেবল এখানে শত্রু নয়, শত্রু ইন্দ্রিয়াসক্তি, কাম, লোভ, ক্রোধাদি, কখনও বা অহংকার। জীবনের রণাঙ্গনে ব্যক্তি নিজেই নিজের শত্রু হয়ে উঠতে পারে।

কীভাবে শত্রুর আকস্মিক আক্রমণ অতিক্রম করা যাবে? জাতকমালার এই কাহিনীতে তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।
বোধিসত্ত্ব সেবার বানররূপে জন্মলাভ করে আশি হাজার বানরের অধিপতি হয়ে হিমালয়ের পার্বত্যপ্রদেশে বাস করছেন। অদূরেই একটি প্রত্যন্ত গ্রাম, সেখানে লোকজনের বাস অনিয়মিত। কখনও গ্রামবাসীরা সেখানে থাকে, কখনও থাকে না। গ্রামটির মধ্যস্থলে একটি সুবৃহৎ ডালপালায় ঘেরা মিষ্টি গাবের গাছে ছিল। তিন্দুকবৃক্ষ। গ্রাম যখন শূন্য থাকতো তখন বানরের দল মহানন্দে সেই ফল ভক্ষণ করতে আসতো।

সেরকমই একবার গাছে ফল ধরেছে। এতোই ফল ধরেছে যে ফলভারে আনত শাখাগুলি নেমে এসেছে মাটির কাছাকাছি। গ্রামবাসীরা তখন সেখানে বাস করছে। তারা ফলবতী বৃক্ষটিকে বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখে দ্বারদেশে পাহারার ব্যবস্থা করেছিল।

অভীষ্ট ফললাভ অনায়াস নয় যে!

বানরের দল খবর পেল, একটি বানরকে প্রেরণ করে বৃক্ষ ও গ্রামের বর্তমান অবস্থা জানলো তারা। সংবাদ পেয়ে সোত্সাহে তারা স্থির করল, শুভস্য শীঘ্রম্! তারা অধিপতি বানরেন্দ্র বোধিসত্ত্বের কাছে গিয়ে সঙ্কল্প জানালো।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-২৩: তিত্তিরজাতক: পাপ ও আত্মজিজ্ঞাসা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯২: শ্রীমার সঙ্গে এক মেমসাহেবের কথোপকথন

বোধিসত্ত্ব সব শুনে বললেন, এখন সেখানে যাওয়া উচিতকর্ম নয়। মনুষ্যকুলের মায়ার শেষ নেই। বানররা প্রতিযুক্তি দিল, “তবে রাত্রিকালে যাওয়াই যুক্তিসঙ্গত, তখন মনুষ্যকুল সুপ্ত থাকে।”

বানরেন্দ্র সম্মত হলেন। বানরকুল হিমালয় থেকে অবতরণ করে সেই গ্রামের অদূরে একটি প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ডের উপর শুয়ে থাকলো। রাত্রি নামলে, গ্রামবাসীরা ঘুমিয়ে পড়লে তারা গাছে উঠে মহানন্দে ফলভক্ষণ শুরু করলো। এটি অভীষ্ট অর্জনের পথে অবলম্বিত কৌশলের উদাহরণ। এরপর বাধা আসবে।

সেই রাত্রে শৌচকর্মের জন্য গৃহ থেকে বাইরে এল, সে গ্রামের মধ্যভাগে গিয়ে বানরদের দেখতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ যথাস্থানে জানালো। গ্রামের লোকজন যে যা হাতের কাছে পেল, ধনুর্বাণ, লাঠি, ঢিল নিয়ে গাছ ঘিরে ফেলল। প্রভাত হলেই তারা বানরদের যথোপযুক্ত শিক্ষা দেবে। তাদের দেখে আশি হাজার বানরের প্রাণ মৃত্যুভয়ে কম্পমান হল। তারা আসন্ন বিপন্নতার আশঙ্কায় ভীত হয়ে বোধিসত্ত্বের শরণাগত হল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৮: গার্হস্থ্যজীবনে জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রের ভাবমূর্তি, তাঁর দেববিগ্রহে উত্তরণের একটি অন্যতম কারণ?

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৪: মৌটুসি

বানরাধিপতি তাদের অভয় দিলেন। এখন তো সবে রাত্রির দ্বিপ্রহর। এই জনসমূহ এখন ভাবছে বানরদের জব্দ করবে, কিন্তু সময় যতো এগোবে তাদের জন্য অন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করলে তারা অনায়াসেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেদিকে ধাবিত হবে। বর্তমান কাজটি ব্যাহত হবে। বোধিসত্ত্ব তাদের আশ্বস্ত করলেন। যাও, নির্ভয়ে ফল ভক্ষণ করো। এখনও প্রচুর ফল অবশিষ্ট আছে। এমনভাবে আশ্বাস না দিলে হয়তো সেই বিপুল বানরকুল ভয়ে অস্থির হয়ে সেখানেই প্রাণ হারাতো।

এখানে নায়কের গুণ ও অবলম্বনীয় পন্থাঃ কেমন হওয়া উচিত তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। নেতা তিনিই হন যিনি নিয়ে যান, উত্তরণের দিকে। তাই প্রকল্পিত বিষয় সফল বা বিফল কোনটি হতে পারে তা নেতার চিন্তায় থাকলেও তা তিনি প্রকাশ করবেন না। তিনি কৌশলী হবেন, যে কৌশল সত্যধর্ম থেকে বিচলিত করবে না কিন্তু প্রাণরক্ষা করবে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১০: অন্ধকারে, চুপিসারে

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৪: রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রিত গল্প

এরপর তিনি সকলকে একস্থানে একত্রিত হতে বললেন। দেখা গেল বানরেন্দ্রের ভাগিনেয় সেনক অনুপস্থিত। তিনি এখানেও আশ্বস্ত করলেন, যদি সেনক ফিরে না আসে তবে উৎকণ্ঠা নিষ্প্রয়োজন। সে অচিরেই মুক্তির উপায় করবে।

নেতাকে হতে হবে বিচক্ষণ, দূরদর্শী। ভাবী বিষয়ের অনুমান করার শক্তি অর্জন করতে হবে। বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণে এই পর্যায়টিকে “রিস্ক” বলা যেতে পারে, যা বৃহত্তর সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করবে, উত্তরণের সহায় হবে। ক্ষেত্রবিশেষে উন্মুক্ত করবে পরিত্রাণের পথ, “এক্সিট রুট” কিংবা “এস্কেপ রুট।”

সেনক দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন তা উপলব্ধি করল তখন সে পূর্ববর্তিগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গ্রামে পৌঁছলো ও ধাবমান জনগোষ্ঠীকে দেখে আসন্ন বিপদের অনুমান করল। তখন সে একটি কুটিরে আগুন জ্বালিয়ে সুপ্ত এক বৃদ্ধাকে দেখে একটি ডালে আগুন ধরিয়ে বায়ুর অনুকূলে গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিল। অচিরেই গ্রামবাসীরা আগুন নেভানোর জন্য ছুটল। বানররাও মুক্তি পেয়ে প্রত্যেকে একটি করে ফল সেনকের জন্য নিতে ভুললো না।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৩: আলাস্কার দক্ষিণে রয়েছে সেই মনোরম গ্লেন হাইওয়ে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭০: বিচারক

কৌশলী পদক্ষেপ উত্তরণের পথ প্রশস্ত করে। তবুও শেষাংশে প্রশ্ন হতে পারে, এই নিষ্ক্রমণের উপায় কতটা ন্যায়সঙ্গত? রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভাবলে, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য এটি উপযোগী। ব্যক্তিগত ন্যায় অন্যায়ের পরিসরে ভাবলেও এখানে অন্যায়ের অবকাশ নেই, কারণ বানরকুল নিষ্পাপ ছিল। এখানে হয়তো বা আদর্শবাদী ধর্ম ও প্রায়োগিক ধর্মের একটা চোরা সংঘাত থেকে যাবে। শাস্ত্রেও তো বলা হয়, শঠে শাঠ্যং সমাচরেত্। জীবনের ঘূর্ণিপথ সর্বদা সরল নয়, সারল্য-ও ন্যায়ের শেষকথা নয়। এই পথ ব্যর্থতায় পালানোর নয়, উত্তরণের। জীবনের কোনও কোনও মোড়ে যে “এক্সিট রুটের” আশ্রয় নিতে হয় এই জাতককথা তার সন্ধান দেয়।—চলবে।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content