বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

বোধিসত্ত্ব সেবার বারাণসীর কাশীগ্রামে জন্মগ্রহণ করলেন ব্রাহ্মণকুলে। বয়ঃপ্রাপ্তির পর সংসারে তাঁর মন টিকল না। বিষয়বাসনা ত্যাগ করে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলেন, ক্রমে লাভ করলেন ধ্যানবল, হিমালয়ের এক বিজন বনভূমিতে ধ্যানস্থ হলেন অবশেষে।

সেসময় বারাণসীর রাজা ছিলেন ব্রহ্মদত্ত। রাজা গভীর রাত্রিতে একদিন চারটি ভীতিপ্রদ মহাশব্দ শুনে অমঙ্গলের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন, ক্রমে ব্রাহ্মণগণ এলেন, বিচার-বিশ্লেষণ করে রাজাকে জানালেন যে এই শব্দগুলি বেজায় অকল্যাণ ও বিপদপাতের লক্ষণ, অতয়েব রাজা সর্বচতুষ্ক যাগের অনুষ্ঠানে সম্মত হলেন, ব্রাহ্মণগণের পরামর্শে একটি যজ্ঞশালা নির্মাণ করিয়ে সেখানে অসংখ্য পশু এনে বেঁধে রাখলেন।

যুগে যুগে এমনটাই ঘটেছে। আগেও অনেক রাজাই এমন ভীত হয়ে অজস্র পশুবধ করে প্রাণের বিনিময়ে শান্তির সন্ধান করেছেন।
রাজা কি কি শব্দ শুনেছিলেন? সর্বচতুষ্ক যাগ-ই বা কীদৃশ?
রাজা যে চারটি ভয়ংকর অক্ষর শ্রবণ করছিলেন সেই রাতের গভীরে, তারা যথাক্রমে ‘দু’, ‘ষা’, ‘না’, ‘সে’। কী যে এদের অর্থ, কীই বা তাত্পর্য, কেনই বা রাজা এগুলি শুনলেন তা বোধগম্য হলো না। তবে নির্ণীত হল এই যে, সর্বচতুষ্ক যাগে সকল অমঙ্গলের বিনাশ ঘটবেই। হাতি, ঘোড়া, ষাঁড়, মানুষ এমনকী ছোটখাট পাখি—চারটি করে যজ্ঞীয় প্রয়োজনে বধ করতে হবে।

মৈত্রীভাবনায় প্রাণিত বোধিসত্ত্ব দিব্যদৃষ্টিতে বারাণসীর এই কাণ্ড প্রত্যক্ষ করে অবিলম্বে সেখানে যাবেন বলে মনস্থ করলেন। তিনি এই চারটি মহাশব্দের নিগূঢ়ার্থ উপলব্ধি করেছিলেন। বারাণসীতে আবির্ভূত হয়ে ওই অসংখ্য প্রাণিমেধকে নিবৃত্ত করাই তাঁর উদ্দেশ্য এবং সেই লক্ষ্যে আপন ঋদ্ধিবলে গগনপথে বারাণসী পৌঁছে রাজোদ্যানে অবতরণ করলেন এবং উদ্যানের মঙ্গলশিলাপট্টে হিরণ্যপ্রতিমার তুল্য শোভাময় হয়ে উপবিষ্ট হয়ে রইলেন।

এই সময় নেপথ্যে অন্য নাটিকার অনুষ্ঠান ঘটেছিল। পুরোহিতের প্রধান শিষ্য এতো পশুবধের নিদানে সন্দিহান হয়ে গুরুকে প্রশ্ন করলেন, “প্রাণের বিনিময়ে স্বস্ত্যয়ন কি বেদোপদিষ্ট, বেদে তো এ সব নেই।”
আরও পড়ুন:

প্রজাতন্ত্র

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৯: কী ছিল চিঠিতে, উত্তর লিখতে গিয়ে উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের হাত কেঁপেছিল

গুরু বিরক্ত হয়ে তর্জন করলেন, “থামো বাপু, নিজের কাজটুকু করো। তোমার কাজ রাজার কাছ থেকে ধন সংগ্রহ করা। তুমি সেটাই মন দিয়ে করো। এত যে মত্স্য-মাংসাদি আহার্যের আয়োজন এতে তুষ্ট হয়ে এক্কেবারে চুপ হয়ে থাকো।”

শিষ্য মনে মনে স্থির করলো যে এদের সহায়ভূত হয়ে সে কাজ করবে না। সে সেখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে রাজোদ্যানে এল, সেই সন্ন্যাসীকে দেখে প্রণিপাত জানালে তিনি মিষ্টবচনে তাকে আপ্যায়িত করলেন, তারপর সেই শিষ্য বোধিসত্ত্বের সমীপে একান্তে আসীন হল।

সন্ন্যাসী জানতে চাইলেন “বত্স, তোমাদের রাজা যথাধর্ম রাজ্যশাসন করেন তো?”

শিষ্য জানাল, রাজা তা করেন বটে, তবে ইদানিং এক মহাভয়ে আক্রান্ত হয়ে তিনি পশুঘাতনে স্বস্ত্যয়ন করবেন। ঐ শব্দগুলির ব্যাখ্যা বোধিসত্ত্বের তুল্য শীলবান মহাপুরুষের দ্বারাই অনুষ্ঠেয়। নয় কি?

শিষ্যটির মুখ থেকে বোধিসত্ত্ব বিস্তারিত জানলেন। তারপর বললেন, “বত্স! আমি তোমাদের রাজাকে চিনি না, তিনিও আমাকে চেনেন না। তবে ওই শব্দগুলির অর্থ আমি জানি। রাজা এখানে এসে জিজ্ঞাসা করলে আমি তাঁকে সেই অর্থের উপদেশে তাঁর সন্দেহ নিরাকৃত করতে পারি।”

শিষ্য তৎক্ষণাৎ রাজার কাছে গিয়ে নিবেদন করল, রাজা সত্বর সেখানে এলেন, প্রণিপাত জানিয়ে জানতে চাইলেন যে ঐ শব্দগুলির মর্মার্থ কি সন্ন্যাসী যথার্থই জানেন?
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৫: সুন্দরবনের পাখি — মাছরাঙা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৮: প্রতিভা দেবী—ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

বোধিসত্ত্ব তখন রাজাকে শ্রবণ করালেন এক অভিনব পূর্বকথা। তিনি জানালেন যে, ওই শব্দের উত্স নরকবাসী প্রাণীর। যারা এই শব্দ করেছে তারা পার্থিব জন্মে পরস্ত্রীতে আসক্ত ছিল। এই ব্যাভিচারের পরিণামে তারা কর্মফলের অনুসরণ করে নরকের গাঢ় ক্ষাররসযুক্ত লৌহকুম্ভীতে জন্ম নিয়েছে। সেখানে তপ্ত জলে তারা সিদ্ধ হয়েছে। কুম্ভীর মুখ থেকে তলদেশে গিয়ে সেখান থেকে আবার প্রতিগত হয়ে মুখে ফিরে আসতে তাদের ষাটহাজার বছর সময় লেগেছে। এখন মুখে ফিরে এসে তারা বাইরে দৃষ্টিপাত করে তারা নিতান্তই দুঃখিত হয়ে আপন আপন মনোভাব ব্যক্ত করতে চেয়েছে, কিন্তু তাদের দুষ্কার্যের ফলস্বরূপ তারা একেকটি অক্ষর উচ্চারণ করার পরেই আবার লৌহকুম্ভীতে নিমগ্ন হয়েছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৪: শিকারী ও ‘শিকার’

মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

যেমন, ‘দু’ এই শব্দে নরকবাসী সেই জীব আসলে বলতে চেয়েছিল দুষ্কার্য করে করে অতিবাহিত হয়েছে জীবন। প্রভূত সম্পদ থাকতেও সে দান করেনি, প্রাণপণে ভোগ করে করেও আত্মতৃপ্তিও ঘটেনি।

আবার ‘ষা’ শব্দে আরেকজন বলতে চেয়েছে ষাটহাজার বর্ষ ধরে এই যাপিত নরকযন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হচ্ছে। কবে এর শেষ, কবে এই অসহনীয় মহাদুঃখভারের অবসান?”

‘না’ শব্দে আরেকজন যেন পূর্বজনের জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়। সে যেন বলতে চায় নাই অন্ত এই দুঃখের, ভাবনাও অনন্ত, কাণ্ডাকাণ্ডহীন মহাপাপের যে দুঃসহ দুঃখ তা অনন্ত।

“সে” শব্দে শেষজন বুঝি বলতে চেয়েছিল আশার বাণী। সে বলতে চেয়েছিল সেই আমি নরকযন্ত্রণার শেষে একদিন নবজন্মের পরিত্রাণ পেয়ে এই ভীষণ স্থান ত্যাগ করবো। সেই জন্মে শীলপ্রাপ্ত হয়ে নিয়ত কুশলকর্ম করে জীবন অতিবাহিত করব।

এসব কথা তারা বলতে চেয়েছিল, আপন আপন কর্মফল অনুধাবন করে। তারা মহাপাতক, এ তাদের হাহাকারের শব্দ। রাজা যেন ভীত না হন, এতে তাঁর কোনও ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

রাজা এরপর নিরুদ্বিগ্ন হয়ে সুবর্ণভেরী বাজিয়ে সকল আবদ্ধ প্রাণীর মুক্তি দিলেন। ভেঙে ফেললেন যজ্ঞকুণ্ড। বোধিসত্ত্ব এই মহাকর্মের অনুষ্ঠান করে স্বস্থানে ফিরলেন একদিন, ক্রমে ধ্যানবলে লাভ করলেন ব্রহ্মলোক।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৯: আলোকলতা তিলোত্তমারা যুগে যুগে পুরুষের উজ্জীবনী শক্তির আধার

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০০: চোর মাচায়ে শোর

এই কাহিনিতে তিনটি অংশ। একটি দিকে হিংসা-অহিংসার দ্বন্দ্ব ও অহিংসার জয়। অপর দিকে নরকবাসী জীবগণের আর্তি, অনুশোচনা এবং শুভবোধের জন্ম। এই শুভবোধ একদিন হয়তো তাদের পুনর্জন্ম ঘটাবে আলোকিত পৃথিবীর বুকে। এই উপলব্ধি হয়তো তাদের উত্তীর্ণ করবে একদিন মরজগৎ থেকে মোক্ষে। আর এই দুয়ের মাঝে জেগে থাকেন সেই অনির্বাণ মহাপুরুষ, যাঁর নির্বাণপথের প্রস্তুত হচ্ছে ক্রমে ক্রমে, সেই হিরণ্যকান্তি যুগপুরুষ অপেক্ষা করেন জিজ্ঞাসার। উপদেশ দেন। শিষ্য প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ন ও সেবায় জেনে নেন মূল সত্য। তিনি পরম করুণাধার হয়ে বরাভয় দেন, নির্ভয় করেন, অসংশয়িত করেন। ভয় থেকে অভয়ে উত্তীর্ণ করেন, আত্মজাগরণ ঘটিয়ে আত্মশক্তিতে নিজেকে অতিক্রমের শিক্ষাই তিনি দিয়ে যান বারংবার।
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content