
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।
টলস্টয় একবার তুর্গেনিভকে বলেছিলেন, কিছু লিখতে পারার আগে আমার চাই প্রেমের উত্তাপ। হেমিংওয়েও তেমনটিই বিশ্বাস করতেন। প্রেমে না পড়লে সেরা লেখার জন্ম হয় না। তিরিশের দশকে তাঁর বন্ধু কালাহন এসব মন্তব্যর সূত্র ধরেই এক তত্ত্ব খাড়া করেছেন, প্রতিটি বিখ্যাত বই লেখার জন্য আর্নেস্টের একজন করে মহিলা লাগে। কালাহানের কথায় খানিক সত্যতা থাকলেও জীবনী লেখক কারলস বেকার কিন্তু হেমিংওয়ের একাধিক বিয়েকে তাঁর লেখক সত্বার সঙ্গে মেলাননি। হেমিংওয়ের বিয়েগুলো ব্যর্থ হয়েছে মহিলা সম্পর্কে তাঁর নিজের কিছু পূর্বনির্ধারিত অনড় ধারণার জন্য। এছাড়া ছিল তার প্রচণ্ড আত্মশ্লাঘা।
সবার ওপরে তিনি যে পরিবারে বড় হয়েছেন সেটির ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক দুর্বল চিত্ত শিকার—প্রেমী বাবা ও প্রচণ্ড দাপুটে মায়ের সংস্পর্শে বড় হয়েছেন হেমিংওয়ে। মা ছিলেন অপেরা গায়িকা। হেমিংওয়েকে চেলো বাজানো শিখতে বাধ্য করেন। প্রায় ছ’ বছর ধরে ইচ্ছের বিরুদ্ধে চেলো বাজাতে হয়। তাঁর এক বন্ধু মন্তব্য করেছেন— “Hem was the only man I ever knew who really hated his mother.”
হেমিংওয়ে তাঁর মায়ের প্রতি ঘৃণার কথা বলেছেন। লিখেছেন, তাঁর জীবনের প্রথম মানসিক ক্ষতর সৃষ্টি হয়েছে সেই দিন, যেদিন তিনি আবিষ্কার করেন যে তাঁর বাবা একটি কাপুরুষ। মা বাবাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেন। ১৯২৮ সালে বাবার শেষকৃত্য হয়ে যাবার পর ছেলেকে বাবার আত্মহত্যায় ব্যবহৃত বন্দুকটি পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীকালে স্ত্রীদের ওপর কর্তৃত্ব ফলানো, তাঁদের দমিয়ে রাখার প্রয়াস, তাঁদের নিকৃষ্ট মনে করা—এসবই সেই প্রথম জীবনের মানসিক ক্ষতর বহিঃপ্রকাশ। মাকে পরাজিত করে বাবাকে উদ্ধার করার সুপ্ত বাসনাই এর অনুপ্রেরণা।
হেমিংওয়ে তাঁর মায়ের প্রতি ঘৃণার কথা বলেছেন। লিখেছেন, তাঁর জীবনের প্রথম মানসিক ক্ষতর সৃষ্টি হয়েছে সেই দিন, যেদিন তিনি আবিষ্কার করেন যে তাঁর বাবা একটি কাপুরুষ। মা বাবাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেন। ১৯২৮ সালে বাবার শেষকৃত্য হয়ে যাবার পর ছেলেকে বাবার আত্মহত্যায় ব্যবহৃত বন্দুকটি পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীকালে স্ত্রীদের ওপর কর্তৃত্ব ফলানো, তাঁদের দমিয়ে রাখার প্রয়াস, তাঁদের নিকৃষ্ট মনে করা—এসবই সেই প্রথম জীবনের মানসিক ক্ষতর বহিঃপ্রকাশ। মাকে পরাজিত করে বাবাকে উদ্ধার করার সুপ্ত বাসনাই এর অনুপ্রেরণা।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৫: এ কেমন রঙ্গ জাদু, এ কেমন রঙ্গ…/৩

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৮: রান্নার জ্বালানি নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?
হেমিংওয়ের প্রথম প্রেমও একটি মানসিক আঘাত। ১৯১৮ সালে যুদ্ধে আহত হয়ে যখন মিলান এর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সেখানে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা। এগনেস ফন কুরস্কি ছিলেন রেড ক্রস এর নার্স। এগনেস সন্মন্ধে বিশদ ভাবে কিছু জানা যায় না। তবে তিনি হেমিংওয়ের জীবনে একমাত্র মহিলা যাঁর কাছে তিনি নিজেকে সমর্পণ করতে শিখেছিলেন। তাঁর যত্নের কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করেছিলেন, প্রথম কোনও মহিলাকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তারপর আবার যুদ্ধের সময় যখন তাঁরা বিচ্ছিন্ন হলেন তখন খবর এল এগনেসের বাগদানের। ইতালিয়ান এক সামরিক অফিসার এর সঙ্গে। এগনেসের প্রত্যাখ্যানে মানসিক ভাবে আবার বিধ্বস্ত হলেন হেমিংওয়ে। মেয়েদের প্রতি এক প্রবল বিদ্বেষ জন্মালো আবার।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৭: পাতি সরালি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৬: মা সারদার প্রথম মন্ত্রশিষ্যা ছিলেন দুর্গাপুরীদেবী
এই মানসিক ক্ষত থেকে আত্মরক্ষার ও একাকীত্ব থেকে রক্ষা পাওয়ার এক অদ্ভুত নিয়ম এলো তার পরবর্তী জীবনে। একটি বিয়ের কিছুদিন পর ই পরবর্তী কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ফেলতেন। তারপর সেই সম্পর্ক মোটামুটি নিশ্চিত হলে আগের বিয়ে ভেঙে ফেলতেন, বউকে বিয়ে ভাঙার সুযোগ দিতেন না। একবার নয়। চার চারবার এমনটি হয়েছে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১২: প্রশাসক রামচন্দ্রের সাফল্য কী আধুনিক কর্মব্যস্ত জীবনে সফল প্রশাসকদের আলোর দিশা হতে পারে?

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৫: সর্বত্র বরফ, কোত্থাও কেউ নেই, একেবারে গা ছমছম করা পরিবেশ
প্রথম স্ত্রী হ্যাডলি। হেমিংওয়ের চেয়ে আট বছরের বড়। তাঁর নিজস্ব মোটা অংকের আয় ছিল। দেখতে বেশ শক্তপোক্ত ও স্বাবলম্বী। হেমিংওয়ে তাঁর সুঠাম সুন্দর চেহারা, যুদ্ধে বীরত্বের রেকর্ড, লেখালেখি, এ সব দিয়ে তাঁকে মুগ্ধ করলেন। ১৯২০ সালে তাঁদের প্রথম দেখা। তারপর বিয়ে ও প্যারিসে সংসার পাতা। বছর দু’ তিনেকের মধ্যেই শুরু হল অশান্তি। সূত্রপাত খরচাপাতি নিয়ে। প্রচুর দাম দিয়ে হেমিংওয়ে একটি পেইন্টিং কিনলেন। হ্যাডলি কিন্তু ছবিটির গুণমান, সৌন্দর্য নিয়ে আপত্তি জানাননি। তাঁর আপত্তি হেমিংওয়ের খরচ করার বিবেচনা নিয়ে। বিশেষত যেখানে তাঁর নিজের আয় খুব কম। আরও কিছু কারণ জুড়লো এর সঙ্গে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৭: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি
১৯২২ এ গ্রিস ও টার্কির যুদ্ধে গেলেন হেমিংওয়ে। হ্যাডলি সে সময় তাঁর অপ্রকাশিত লেখালেখি ভর্তি এক সুটকেস রাস্তায় হারিয়ে ফেলেন। এটি হেমিংওয়ের ওপর এক প্রচণ্ড মানসিক আঘাত। তৃতীয় কারণ ও একটি জুড়লো। হ্যাডলি সন্তানসম্ভবা হলেন। জেনেই চটে উঠলেন হেমিংওয়ে। হ্যাডলিকে এর জন্য দোষারোপ করতে লাগলেন ও পরিষ্কার বলে দিলেন যে সন্তানের দায়িত্ব নেবেন না। গার্টরুড স্টেইন লিখেছেন, সকালবেলা হেমিংওয়ে বাড়ি এলেন সারাদিন ঘুরলেন ফিরলেন, রাত দশটায় হঠাৎ ঘোষণা করলেন, “I am too young to become a father”.—চলবে।
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।