বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

তখনও কলকাতা শহরে ফ্ল্যাটের এত রমরমা ছিল না৷ উত্তর কলকাতার পাশাপাশি দক্ষিণ কলকাতাতেও বাড়ি ছিল অনেক৷ ছিল নতুন বাড়ি, পুরনো বাড়ি, টানা বারান্দা, চোকলা খসে পড়া দেওয়ালে বাসি হয়ে আসা নীলছোপ আর তার সঙ্গে, রবিবার দুপুরে মাংসভাত সহযোগে ঘড়ঘড় করে একটানা বাজতে থাকা পুরনো রেডিওতে হৃদয়পুরের গান। তখন এফএম চ্যানেল বাড়ছে ধীরে ধীরে৷ রাতের অনুষ্ঠানে আমার এফএম-এ বাজত স্বর্ণযুগের গান আর সম্বল বলতে ছিল কিছু ক্যাসেট। শচীন দেব বর্মন, আশা ভোঁসলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, লালন সাঁই-এর গান ভরা থাকত সেই সমস্ত ক্যাসেটে৷ আর বাচ্চাদের নিদেনপক্ষে অমিতাভ, শাহরুক, আমির এইটুকুই ছিল পৃথিবী। এর মাঝেই প্রতিদিন দুপুরে খাটের কার্নিসে মাথা রেখে দাদু শুনত ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’৷ শুনতে শুনতে দিদার কোলে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুলঘুলিতে বৃদ্ধ ঘুঘুর একটানা ডাক যেন মিলিয়ে যেত অনেক দূরে। অনেক দূরে মানচিত্ররহিত সেই হেমন্তের অরণ্যে অকারণ ঘুরে বেড়ানো সেই পোস্টম্যানটির দেশে মিলিয়ে যেতে যেতে কখন যেন ঘুঘুটিও শান্ত হয়ে যেত, আর আমার চারপাশে মায়াঘন তন্দ্রার শীতল স্পর্শ আমায় ঘিরে রাখত সারাটা দুপুর।

দাদুর মৃত্যু হয়েছে বিশ্বায়ন নামক এক দুর্বিষহ রোগাক্রান্ত পৃথিবীতে। দাদুর মৃত্যুর পরে পুরনো জঞ্জালের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম সেই ক্যাসেটটি—’সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেরা দশ’ ভঙ্গুর, রিল জড়ানো অবস্থায়। তারপর কতদিন সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে একলা বাড়ির সব আলো নিভিয়ে বসে শুনেছি—

‘ছল ছল আঁখি মোর জলভরা মেঘে যেন ছাওয়া
জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া।’


যদি দাদু একবার আসে… না দাদু কখনও আসেননি। ফেরা যে বড় সহজ কথা নয়, তা তখন থেকেই বুঝতে শিখেছি। সেই মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে দু-বছর। কোনও এক প্রেমদিবসের ভিড় জর্জরিত শহরে, প্রেমাক্লান্ত তরুণ-তরুণীরা যখন অবেলার ঘুমে বসন্ত বুনছে আর একলা মানুষরা আসন্ন রাত্রির ভয়ে ইনসমনিয়ার ওষুধ হাতড়াচ্ছে ঠিক তখনই আছরের দিনাবসানের সুরকে সঙ্গে নিয়ে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়লেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সকলের আহ্লাদভরা ঝুলিতে ছুটির উপহার পৌঁছে দিতে দিতে নিজেই শেষমেশ বেরিয়ে পড়লেন ‘আনন্দ ঝরনা’র সন্ধানে।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ সালে ৪ অক্টোবর। বাবার নাম নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও মা ছিলেন হেমপ্রভা দেবী। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের এই শিষ্যা সংগীত জীবনের পথচলা শুরু করেছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের হাত ধরে। পরবর্তীকালে পণ্ডিত সন্তোষকুমার বসু, অধ্যাপক এটি কানন এবং অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর অধীনে দীর্ঘদিন সংগীতচর্চা করেছিলেন তিনি। এরপরেই ১৯৫০ সালে শচীন দেব বর্মনের আহ্বানে মুম্বইতে পাড়ি দেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। দুই বছরের মধ্যে মোট ১৭টি হিন্দি ছবিতে আধুনিক গান গেয়েছিলেন তিনি। তবে প্রাণের শহর কলকাতাকে ছেড়ে বেশিদিন সেখানে পড়ে থাকতে পারেননি। ১৯৫২ সালে একপ্রকার কাউকে কিছু না জানিয়েই কলকাতায় ফিরে আসেন গায়িকা। ১৯৬৬ সালে বাঙালি কবি শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মুম্বই থেকে ফিরেই বাংলা চলচ্চিত্র জগৎকে উপহার দিয়েছেন একের পর এক হিট গান। মহানায়ক উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমায় নেপথ্য গায়িকা হিসেবে তাঁকেই বেছে নিতেন সংগীত পরিচালকরা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন তৎকালীন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক জুটি। ১৯৭১ সালে ‘জয়জয়ন্তী’ এবং ‘নিশিপদ্ম’ ছবির গানের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

তবে কেবলমাত্র বিনোদন জগতেই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ৭১-এ যখন জাতীয় জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তোলপাড় সমগ্র বাংলাদেশ, সেই সময় লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বার্থে, তাদের সঙ্গে প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়ে তোলার মহাযজ্ঞে শামিল হন তিনিও। আরও অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে গণ আন্দোলনে যোগ দেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই সময় একাধিক দেশাত্মবোধক সংগীতের নেপথ্যে কণ্ঠ ছিল তাঁর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি উপলক্ষে গেয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে প্রথম বিদেশি শিল্পী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সংগীত জগতে এই দীর্ঘ পথচলার পর ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বোচ্চ সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’-এ ভূষিত করেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। এক দশক পেরিয়ে ২০২২ সালে জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রদানের প্রস্তাব রাখে। তবে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

আমাদের ধীরস্থির অযান্ত্রিক জীবনের শেষ সুরটুকু ধরে রেখেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আজও তার বিদায়বেলায় যদি আবার সুযোগ পাওয়া যায় তবে মুঠোফোনে ইউটিউব কালেকশানস-এ নয়। প্রাচীন হয়ে যাওয়া অপাংক্তেয় ভাঙাচোরা টেপ রেকর্ডারগুলোতে বেজে উঠুক, বাজতেই থাকুক—’এ শুধু গানের দিন/ এ লগন গান শোনাবার।’

এ লগন যথার্থই অমর, শিল্পীর সুরমাধুর্যে এ লগন অক্ষয় হয়ে থাকবে সংগীতের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায়৷ বাংলা গান যতদিন বেঁচে থাকবে, শৈশবের মধুর স্মৃতিগুলি যতদিন টাটকা থাকবে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্তদের মাঝে ততদিন অমর হয়ে থাকবেন।

Skip to content