শনিবার ১ মার্চ, ২০২৫


সুভাষচন্দ্র বসু।

সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে গিয়েছে বহুদিন। গত সহস্রাব্দের শেষলগ্নেই। তারপর নতুন সহস্রাব্দ এল, দুনিয়া আর দিনকাল বদলে গেল কত– সকলেই ‘পুরনো দিন’ বলতে যা বোঝে তা ঝড়ের বেগে পিছনে ছুটছে, আজ যেটা মনে হয় এই তো গতকালের কথা বুঝি, আগামিকাল-ই তা যুগের ওপারে চলে গিয়েছে এমন বোধ হবে। এই চলমান সময়ে, গতিময় মূল্যবোধের পৃথিবীতে তেইশে জানুয়ারি আসে বাংলার বুকে।

সত্যি কথা বলতে কী, জানুয়ারি মাসটাতেই শীত যা কিছু থাকবে। এই সময়ে পিকনিক, স্পোর্টস, কালচারাল নানা অ্যাক্টিভিটি, নানান উত্সব, ছাড় ও কেনাকাটা, প্রজাতন্ত্র, ব্যাডমিন্টন ও কমলালেবুর মাঝে জ্বলজ্বল করছে তেইশে জানুয়ারি। অনেকে এই দিন স্পোর্টস করে, কেউ কেউ ড্রয়িং কম্পিটিশন, দিনটা রবিবার হলে বাজারে ভিড় থাকে বেশি, কেউ কেউ পিকনিকে, ক্লাবে ক্লাবে দেশাত্মবোধক গান, পতাকা উত্তোলন, লজেন্স বিতরণ।
আজ নেতাজির জন্মদিন। সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মজয়ন্তী পালনের মধ্য দিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা চলে আসে। প্রথমটাই হল, মহাভারতের যুদ্ধের শেষে যেমন তিনজন বেঁচে ছিলেন, একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তির পরেও তাঁদের শেষটা নিয়ে তেমন স্পষ্ট কিছু নেই আর কী, সেরকম ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে দীর্ঘ অধ্যায়, স্বাধীনতা অর্জনের যে প্রক্রিয়া ও স্বাধীনতোত্তর ভারতবর্ষ, স্বাধীনতার নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে আজও যেটা অটুট, তা হল নেতাজির অন্তর্ধানরহস্য। শেষটা জানা নেই। ইতিহাসের নানা রহস্য ও সংকট থাকে। সিন্ধুলিপি আজ পর্যন্ত অমীমাংসিত। ধরি ধরি করেও ধরতে না পারার মতো এমন অনেক বিষয় জেগে আছে রাষ্ট্র ও সমাজের বুকে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৬৫: বাথটাব/১৭

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮২: মা সারদার ভক্ত যোগেন মায়ের কথা

একজন মানুষের ‘নেতাজি’ হয়ে ওঠা, কিংবদন্তি রচনা করার রহস্যঘন যাত্রাপথ পার করে যুগপুরুষ হয়ে ওঠা ও প্রবাহে প্রবেশ করার যে রোমহর্ষক কাহিনী তাতে লেগে থাকা অশ্রুজল, আত্মত্যাগ, হার না মানা মনবৃত্তি এবং আরও আরও অনেক কিছুর মূলে যে দেশপ্রেম তা আজকের ভারতবর্ষে বসে অনুমান করা জেন ওয়াইদের পক্ষে খুব অনায়াসসাধ্য হবে না। কারণ, দিনকাল বদলে গিয়েছে। নেতা এখন সুলভ। কিন্তু তামাম দেশ নেতাজি বললে একজনকেই ভাবে বটে।

নেতাজির নামে মিষ্টির দোকান, পাড়া, রাস্তা, মোড়ে মোড়ে নেতাজির দৃপ্ত মূর্তি, ঘোড়ার পিঠে, আঙুল উঁচিয়ে তিনি জাতিকে নিশানা দেখাচ্ছেন, চলো, এগিয়ে চলো। থামা যাবে না। হলই বা সেই ঘোড়াটা ব্যর্থ অনুকরণ, হলোই বা নেতাজির মুখগুলো একেবারে কাঁচাহাতের নির্মাণ, তিনিও তো জেতেন নি শেষটায়, কিংবা হেরে গিয়ে জিতে গেছেন শেষটায়। সুভাষ ঘরে ফিরেছিল না ফেরেনি তার থেকেও জাতীয় জীবনে এই অর্জিত অক্ষুণ্ণ সম্মানটুকু এই মরজগতের নশ্বরজীবনে বিশেষ দামি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৮: রামানুজ ভরত ও লক্ষ্মণ, আনুগত্যের প্রকাশে দু’জনেই অনন্য

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী

সদ্যপ্রয়াত শ্যাম বেনেগালের সুভাষচন্দ্র বসুর জীবননির্ভর চলচ্চিত্রটির কথা মনে পড়ে যেখানে বারবার বিভিন্ন যাত্রাপথের শেষে নতুন অজানা পথে পাড়ি দিচ্ছেন সুভাষচন্দ্র, নেপথ্যে বেজে উঠছে “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।” তাসের দেশ নৃত্যনাট্যের উত্সর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন—
“কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র, স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে “তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।”
এরপরেই শুরু হবে—
“ খরবায়ু বয় বেগে,
চারি দিক ছায় মেঘে,
ওগো নেয়ে, নাওখানি বাইয়ো।
তুমি কষে ধরো হাল,
আমি তুলে বাঁধি পাল–
হাঁই মারো, মারো টান হাঁইয়ো॥”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭০: অনিশ্চিত ফলের পিছনে না ছুটে নিশ্চিত ফল-প্রদায়ক কাজের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৮: শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলেন দ্বারকানাথ

সুভাষচন্দ্র জাতীয়জীবনে সেই টানটাই দিয়েছিলেন, মন্থর, ক্লিষ্ট জীবনে নতুন জোয়ার এনেছিলেন তিনি। সহিংস আন্দোলনের পূর্বসূরী যাঁরা তাঁদের পথ কিংবা সুভাষচন্দ্র যে পথে চলেছেন তার যাথার্থ্য, তাঁর সাফল্য, ব্যর্থতা, প্রভাব নিয়ে ইতিহাস আলোচনা করেছে, করবে। কিন্তু ব্যক্তিমানুষের সমষ্টিতে উত্তীর্ণ হয়ে বিপুল আবেগের সঞ্চার করে, শৃঙ্খলে বারবার ঝঙ্কার তুলে জয়গান রচনার যে দুরন্ত আশার উদ্বোধন তাকে সত্য বলে মানতে শিখিয়ে, কূলকিনারা ছেড়ে কূল না পেয়ে তলের আশায় বা দুরাশায় একলা অভিযাত্রীর ভেলায় সাগরপাড়ির দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। বৃহতের ডাক এলে ক্ষুদ্র ভেসে যায়।

জাতীয়পুরস্কারে ভূষিত ১৯৬৬ সালের সুভাষচন্দ্র চলচ্চিত্রের শেষদৃশ্যে দেখা যায় বিশাল ব্রিটিশ বাহিনী সুভাষচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করতে এসেছে। সুভাষচন্দ্র একটি প্রস্ফুটিত গোলাপ গাছে থেকে তুলে সমবেত ব্যথিত জনতার মাঝে এক কিশোরের সামনে এলেন। স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি ব্রিটিশ সাজে সজ্জিত। সুভাষচন্দ্রকে দেখে সে মাথা নিচু করে নিল। সুভাষ তাকে সর্বদা মাথা উঁচু করে চলার আদেশ দিয়ে গোলাপ তুলে দিলেন হাতে। তারপর চললেন… একলা চলো রে। নেপথ্যে শোনা যাচ্ছিল নজরুল ইসলামের অমর বীরগাথা, “মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না/ বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত।”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮২: সুন্দরবনের পাখি—টিয়া

শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পথের দাবী উপন্যাসে রাসবিহারী বসুর জীবনের যে চিত্রায়ণ ঘটিয়েছেন সব্যসাচীর মধ্য দিয়ে, সেই উপন্যাসের কয়েকটি আবেগঘন বাক্য আজ যেন মন্ত্রের মতোই অভ্রান্ত মনে হয়। এই বাক্যকটির সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের জীবন ও কর্মধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আবিষ্কার করা যায় অনায়াসেই। তাই শেষে এই বাক্যকটিই থাকুক নেতাজিকে উপলব্ধি করার জন্য।

“তুমি ত আমাদের মত সোজা মানুষ নও—তুমি দেশের জন্য সমস্ত দিয়াছ, তাই ত দেশের খেয়া-তরী তোমাকে বহিতে পারে না, সাঁতার দিয়া তোমাকে পদ্মা পার হইতে হয়, তাই ত দেশের রাজপথ তোমার কাছে রুদ্ধ, দুর্গম পাহাড়-পর্ব্বত তোমাকে ডিঙাইয়া চলিতে হয়; কোন বিস্মৃত অতীতে তোমারই জন্য ত প্রথম শৃঙ্খল রচিত হইয়াছিল, কারাগার ত শুধু তোমাকে মনে করিয়াই প্রথম নির্ম্মিত হইয়াছিল সেই ত তোমার গৌরব! তোমাকে অবহেলা করিবে সাধ্য কার! এই যে অগণিত প্রহরী, এই যে বিপুল সৈন্যভার, সে ত কেবল তোমারই জন্য! দুঃখের দুঃসহ গুরুভার বহিতে তুমি পারো বলিয়াই ত ভগবান এত বড় বোঝা তোমারই স্কন্ধে অর্পণ করিয়াছেন! মুক্তিপথের অগ্রদূত! পরাধীন দেশের হে রাজবিদ্রোহী! তোমাকে শত কোটী নমস্কার!”
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content