কবি লিখেছিলেন, ‘‘বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে, মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনা তো নেই। শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখো তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই।”
আমরা যাঁর মৃত্যুদিবস পালন করি তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যু এসেছে এত অথচ তিনি রয়েছেন জীবিত বরাবর। সশরীরে বা অশরীরে। তাঁর অনুভবের প্রতিটা মৃত্যুই ছিল একের থেকে এক ভারবহ। সকলেই ছিলেন তাঁর প্রিয়তর থেকে প্রিয়তম।
স্ত্রীকে একবার চিঠিতে লিখেছিলেন —
এক জ্যোতিষী নাকি তাঁকে গণনা করে বলেছে, আয়ু ষাট কি বাষট্টি বছর। ‘‘আমার ভারী ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে। যা হোক তুমি তাই নিয়ে যেন বেশি ভেবো না। এখনো কিছু না হোক, ত্রিশ চল্লিশ বছর আমার সংসর্গ পেতে পারবে।’’
এই চিঠি লেখার এগারো বছরের মাথায় চলে গেলেন মৃণালিনী দেবী। মৃত্যুর আলিঙ্গন অদ্ভুত আদুরে। কখন আলগোছে জড়িয়ে ধরবে কাকে কে বলতে পারে। শোক স্তব্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের তেরো বছর বয়সে, এক দাসীর “ওরে তোদের সর্বনাশ হল রে” এই আর্তনাদে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। তিনতলায় থাকতেন মা সারদাদেবী, প্রায়ই ভুগতেন তিনি। নতুন বৌঠান কাদম্বরী, অতিদ্রুত সরিয়ে নিয়ে গেল দাসীকে। প্রদীপের মৃদু আলোয় ঘুম চোখে বুকের ভিতরটা দমে গিয়েছিল তাঁর। পরদিন শুনলেন মায়ের মৃত্যুসংবাদ। ভালো বুঝে উঠতে পারেননি, এই মৃত্যুটা ঠিক কি। বারান্দায় এসে দেখলেন, সুন্দরভাবে সাজানো শায়িত মায়ের দেহ।
সেই মা যার সঙ্গে সম্পর্কের বর্ণনায় লিখেছিলেন—
“তার চেয়ে মা আমি হব মেঘ, তুমি যেন হবে আমার চাঁদ দু হাত দিয়ে ফেলব তোমায় ঢেকে, আকাশ হবে এই আমাদের ছাদ।”
সকালের আলোয় সেই মায়ের সুন্দর প্রিয় মুখ দেখে তাঁর মনেইনি “মৃত্যু ভয়ংকর”…
তাঁর মনে হয়েছিল বরং মৃত্যু ”সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত”। শুধু শ্মশান যাত্রার দিকে এগিয়ে গেল যখন সকলে হুহু করে উঠেছিল মন। জীবনস্মৃতিতে আছে সেই মুহূর্তের কথা, ‘‘এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।’’
কাদম্বরী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন কবির সাহিত্যের অনুপ্রেরণা। তার জ্যোতিদাদার বউ নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, নয়বছর বয়সেই বাড়িতে বউ হয়ে আসেন। সমবয়সী হওয়ায় তাঁরা অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে ছিলেন ছোট থেকেই। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় মাকে হারানোর শোক তিনি ততটা বুঝতে পারেননি, কাদম্বরী দেবী মায়ের অভাবটা বুঝতে দেননি।
আমরা যাঁর মৃত্যুদিবস পালন করি তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যু এসেছে এত অথচ তিনি রয়েছেন জীবিত বরাবর। সশরীরে বা অশরীরে। তাঁর অনুভবের প্রতিটা মৃত্যুই ছিল একের থেকে এক ভারবহ। সকলেই ছিলেন তাঁর প্রিয়তর থেকে প্রিয়তম।
স্ত্রীকে একবার চিঠিতে লিখেছিলেন —
এক জ্যোতিষী নাকি তাঁকে গণনা করে বলেছে, আয়ু ষাট কি বাষট্টি বছর। ‘‘আমার ভারী ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে। যা হোক তুমি তাই নিয়ে যেন বেশি ভেবো না। এখনো কিছু না হোক, ত্রিশ চল্লিশ বছর আমার সংসর্গ পেতে পারবে।’’
এই চিঠি লেখার এগারো বছরের মাথায় চলে গেলেন মৃণালিনী দেবী। মৃত্যুর আলিঙ্গন অদ্ভুত আদুরে। কখন আলগোছে জড়িয়ে ধরবে কাকে কে বলতে পারে। শোক স্তব্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের তেরো বছর বয়সে, এক দাসীর “ওরে তোদের সর্বনাশ হল রে” এই আর্তনাদে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। তিনতলায় থাকতেন মা সারদাদেবী, প্রায়ই ভুগতেন তিনি। নতুন বৌঠান কাদম্বরী, অতিদ্রুত সরিয়ে নিয়ে গেল দাসীকে। প্রদীপের মৃদু আলোয় ঘুম চোখে বুকের ভিতরটা দমে গিয়েছিল তাঁর। পরদিন শুনলেন মায়ের মৃত্যুসংবাদ। ভালো বুঝে উঠতে পারেননি, এই মৃত্যুটা ঠিক কি। বারান্দায় এসে দেখলেন, সুন্দরভাবে সাজানো শায়িত মায়ের দেহ।
সেই মা যার সঙ্গে সম্পর্কের বর্ণনায় লিখেছিলেন—
“তার চেয়ে মা আমি হব মেঘ, তুমি যেন হবে আমার চাঁদ দু হাত দিয়ে ফেলব তোমায় ঢেকে, আকাশ হবে এই আমাদের ছাদ।”
সকালের আলোয় সেই মায়ের সুন্দর প্রিয় মুখ দেখে তাঁর মনেইনি “মৃত্যু ভয়ংকর”…
তাঁর মনে হয়েছিল বরং মৃত্যু ”সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত”। শুধু শ্মশান যাত্রার দিকে এগিয়ে গেল যখন সকলে হুহু করে উঠেছিল মন। জীবনস্মৃতিতে আছে সেই মুহূর্তের কথা, ‘‘এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।’’
কাদম্বরী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন কবির সাহিত্যের অনুপ্রেরণা। তার জ্যোতিদাদার বউ নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, নয়বছর বয়সেই বাড়িতে বউ হয়ে আসেন। সমবয়সী হওয়ায় তাঁরা অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে ছিলেন ছোট থেকেই। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় মাকে হারানোর শোক তিনি ততটা বুঝতে পারেননি, কাদম্বরী দেবী মায়ের অভাবটা বুঝতে দেননি।
পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য, আকাশ বাতাস চন্দ্র সূর্য গাছ ফুল পাখি সব যেমন ছিল তেমনই। এই সুন্দর সত্যগুলোর মতই সত্য ছিল তাঁর মনের আকাশ জুড়ে, প্রাণের ভুবন জুড়ে, আত্মার ছোঁয়ায় যিনি ছিলেন, সেই নতুন বৌঠান কাদম্বরী মারা গেলেন। এই অকাল মৃত্যুর সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আমার ২৪ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইয়াছিলো তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদ-শোকের সঙ্গেই মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাথিঁয়া চলিয়াছিলো।”
এই সর্বগ্রাসী মৃত্যুর আঁধার তৈরি করে দিল সর্বকালের সেরা এক কবিকে। কাদম্বরীর অকাল মৃত্যুতে যেন অন্ধকারের জাল ছিঁড়ে রবি খুঁজে বেড়ালেন এক আলোর দিশা। ‘‘… সেই অন্ধকারকে অতিক্রম করিবার পথ অন্ধকারের মধ্যে যখন দেখা যায় না তখন তাহার মতো দুঃখ আর কী আছে?”
জীবনের মধ্যে থেকে মৃত্যুকে আর দুঃখকে সহজে বরণ করার কথা তিনি বারবার বলেছেন। পুত্রকে লিখলেন, ‘‘দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না। আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ…।’’
বন্ধু অ্যান্ড্রুজকে লিখছিলেন প্রায় একই কথা, “I feel that I am on the brink of a breakdown”.
‘ছিন্নপত্রাবলী’তে লিখেছিলেন, “ব্যক্তি হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা কত উৎকট, যার মধ্যে কোনও সান্ত্বনা নেই। কিন্তু ‘‘বিশ্বজগতের হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা অতি সুন্দর ও মানবাত্মার সান্ত্বনাস্থল।’’ অপঘাতে মৃত্যুকে নিজে খুবই ভয় পেতেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন তিনি একথা, ‘‘শান্তিপূর্ণ মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় করিনি। ভয় করি অপঘাত মৃত্যুকে। যদি মৃত্যুর পূর্বে হাসিমুখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি, তবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করবো না।’’
মেজসন্তান রেণুকা দেবীর বারো বছর সাত মাসের জীবন ছিল, তিনি আলোচিত শুধু তার জীবনের অন্তিম লগ্নটুকুর জন্য। সদ্য পত্নিবিয়োগ যন্ত্রণা কাটিয়ে ওঠার আগেই ছুটে বেড়াচ্ছেন শান্তিনিকেতন, আলমোড়া, কলিকাতা। আরও একটা মৃত্যুযন্ত্রণার আতঙ্কে তিনি। বন্ধু রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মাঝেমধ্যেই খোঁজ নিতেন রেণুকার।
একদিন বেশ খানিকটা কথপোকথের পর বন্ধু জানতে চাইলেন, রেণুকার শরীর কেমন আছে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘আজ সকালে সে মারা গিয়েছে।’’ রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন রামেন্দ্রসুন্দর। তার পর নিঃশব্দে চলে গেলেন। একটি চিঠিতে ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘‘যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্ত্বার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও পিছনে না টানে।’’
এই সর্বগ্রাসী মৃত্যুর আঁধার তৈরি করে দিল সর্বকালের সেরা এক কবিকে। কাদম্বরীর অকাল মৃত্যুতে যেন অন্ধকারের জাল ছিঁড়ে রবি খুঁজে বেড়ালেন এক আলোর দিশা। ‘‘… সেই অন্ধকারকে অতিক্রম করিবার পথ অন্ধকারের মধ্যে যখন দেখা যায় না তখন তাহার মতো দুঃখ আর কী আছে?”
জীবনের মধ্যে থেকে মৃত্যুকে আর দুঃখকে সহজে বরণ করার কথা তিনি বারবার বলেছেন। পুত্রকে লিখলেন, ‘‘দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করেছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না। আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ…।’’
বন্ধু অ্যান্ড্রুজকে লিখছিলেন প্রায় একই কথা, “I feel that I am on the brink of a breakdown”.
‘ছিন্নপত্রাবলী’তে লিখেছিলেন, “ব্যক্তি হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা কত উৎকট, যার মধ্যে কোনও সান্ত্বনা নেই। কিন্তু ‘‘বিশ্বজগতের হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা অতি সুন্দর ও মানবাত্মার সান্ত্বনাস্থল।’’ অপঘাতে মৃত্যুকে নিজে খুবই ভয় পেতেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন তিনি একথা, ‘‘শান্তিপূর্ণ মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় করিনি। ভয় করি অপঘাত মৃত্যুকে। যদি মৃত্যুর পূর্বে হাসিমুখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি, তবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করবো না।’’
মেজসন্তান রেণুকা দেবীর বারো বছর সাত মাসের জীবন ছিল, তিনি আলোচিত শুধু তার জীবনের অন্তিম লগ্নটুকুর জন্য। সদ্য পত্নিবিয়োগ যন্ত্রণা কাটিয়ে ওঠার আগেই ছুটে বেড়াচ্ছেন শান্তিনিকেতন, আলমোড়া, কলিকাতা। আরও একটা মৃত্যুযন্ত্রণার আতঙ্কে তিনি। বন্ধু রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মাঝেমধ্যেই খোঁজ নিতেন রেণুকার।
একদিন বেশ খানিকটা কথপোকথের পর বন্ধু জানতে চাইলেন, রেণুকার শরীর কেমন আছে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘‘আজ সকালে সে মারা গিয়েছে।’’ রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেলেন রামেন্দ্রসুন্দর। তার পর নিঃশব্দে চলে গেলেন। একটি চিঠিতে ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘‘যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্ত্বার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও পিছনে না টানে।’’
দৌহিত্র নীতিন্দ্রনাথ মারা গেলে মেয়ে মীরাকে একটি চিঠি লেখেন কবি। সে-চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘যে রাত্রে শমী গিয়েছিল সে রাত্রে সমস্ত মন দিয়ে বলেছিলুম বিরাট বিশ্বসত্ত্বার মধ্যে তার অবাধ গতি হোক, আমার শোক তাকে একটুও পিছনে না টানে।”
রেণুকার মতোই যক্ষ্মায় শয্যাশায়ী হলেন মাধুরীলতা, রবীন্দ্রনাথের ‘বেলি’। মাধুরীলতা ফুল ভালোবাসতেন। ফুলে ঢেকে মোটরকারে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে। রথীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি দিনলিপিতে লিখেছিলেন, “দিদিকে দেখতে যাওয়ার আগে সে দিন বাড়ির ডাক্তারকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মৃত্যুভয় তাঁর আর নেই, তিনি তৈরি আছেন।” মেয়ের কাছে গিয়েছিলেন সেদিন কিন্তু ততক্ষণে ঘটে যায় তার মৃত্যু। মেয়ের বাড়ির সামনে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন সেই রবীন্দ্রনাথই…।
মৈত্রেয়ীদেবীকে রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘‘আমার জীবনে যতবার মৃত্যু এসেছে, যখন দেখেছি কোনও আশাই নেই, তখন আমি প্রাণপণে সমস্ত শক্তি একত্র করে মনে করেছি, ‘তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম, যাও তুমি তোমার নির্দিষ্ট পথে।’ তাঁর আশি বছরের জন্মদিনে তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, এবার আশি, আর তার মানেই আসি।’’
অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে গাড়িতে শুইয়ে ঘোরানো হল আশ্রম। তখন নতুন আলোর জন্য চার দিকে বসানো হচ্ছিল ল্যাম্প পোস্ট। তাই দেখে বললেন, ‘‘এখন বুঝি পুরনো আলো গিয়ে নতুন আলো আসবে।’’ বৌমা প্রতিমার জন্য একটি চিঠি বলে বলে লিখিয়ে কাঁপা হাতে অতি কষ্টে সই করে লিখেছিলের খালি, “বাবামশাই”
এই শব্দটুকুই তাঁর শেষ লেখা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন—
“কোনো নবীন লেখক যদি সূচনা পর্বে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে নিজস্ব ভাষা সন্ধানের চেষ্টা না করে, রবীন্দ্রনাথেই আপ্লুত হয়ে থাকে, সে অতি মূর্খ। পরিণত বয়সেও যদি কোনো লেখক রবীন্দ্রনাথের থেকে দূরে সরে থাকে, তাঁকে জীবনযাপনের সঙ্গী করে না নেয়, তা হলে সে আরও বড় মূর্খ!”
কবি নিজে লিখেছিলেন, মৃত্যুর পর সবাই যেখানে যায়, সেখানে মানুষের সেবা পৌঁছয় না কিন্তু ভালোবাসা হয়তো বা পৌঁছয়, ‘‘নইলে ভালবাসা এখনো টিকে থাকে কেন?’’ কি অদ্ভুত এই ভালোবাসার ব্যাখ্যা…।
২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথকে হারাবার দিন বিচ্ছেদের দিন যতটা, তার চেয়ে বেশি তাঁকে নতুন করে পাওয়ার দিন। এই বোধও যে রবিরই দান।
“মরিতে না হইলে বাঁচিয়া থাকিবার কোন মর্যাদাই থাকিত না।” কবির এই ভাবনায় বেঁচে থাকার প্রতিটা দিনকে বয়ে চলা। নিত্য ভাবনার যিনি জন্মদাতা, প্রতি অনুরাগের যিনি পূর্বরাগ, সকল রাত্রির যিনি প্রভাত, সমস্ত বেদনার যিনি সুখতারা, প্রতি অনুক্ষণের জন্মদাতা যিনি মৃত্যু তাঁকে ছুঁয়ে নবজন্ম পায়। শত শত মানুষের মনে নতুন করে জন্ম তোমার, মৃত্যুহীন তুমি…।
রেণুকার মতোই যক্ষ্মায় শয্যাশায়ী হলেন মাধুরীলতা, রবীন্দ্রনাথের ‘বেলি’। মাধুরীলতা ফুল ভালোবাসতেন। ফুলে ঢেকে মোটরকারে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে। রথীন্দ্রনাথ তাঁর ইংরেজি দিনলিপিতে লিখেছিলেন, “দিদিকে দেখতে যাওয়ার আগে সে দিন বাড়ির ডাক্তারকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মৃত্যুভয় তাঁর আর নেই, তিনি তৈরি আছেন।” মেয়ের কাছে গিয়েছিলেন সেদিন কিন্তু ততক্ষণে ঘটে যায় তার মৃত্যু। মেয়ের বাড়ির সামনে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন সেই রবীন্দ্রনাথই…।
মৈত্রেয়ীদেবীকে রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘‘আমার জীবনে যতবার মৃত্যু এসেছে, যখন দেখেছি কোনও আশাই নেই, তখন আমি প্রাণপণে সমস্ত শক্তি একত্র করে মনে করেছি, ‘তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম, যাও তুমি তোমার নির্দিষ্ট পথে।’ তাঁর আশি বছরের জন্মদিনে তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, এবার আশি, আর তার মানেই আসি।’’
অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে গাড়িতে শুইয়ে ঘোরানো হল আশ্রম। তখন নতুন আলোর জন্য চার দিকে বসানো হচ্ছিল ল্যাম্প পোস্ট। তাই দেখে বললেন, ‘‘এখন বুঝি পুরনো আলো গিয়ে নতুন আলো আসবে।’’ বৌমা প্রতিমার জন্য একটি চিঠি বলে বলে লিখিয়ে কাঁপা হাতে অতি কষ্টে সই করে লিখেছিলের খালি, “বাবামশাই”
এই শব্দটুকুই তাঁর শেষ লেখা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন—
“কোনো নবীন লেখক যদি সূচনা পর্বে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে নিজস্ব ভাষা সন্ধানের চেষ্টা না করে, রবীন্দ্রনাথেই আপ্লুত হয়ে থাকে, সে অতি মূর্খ। পরিণত বয়সেও যদি কোনো লেখক রবীন্দ্রনাথের থেকে দূরে সরে থাকে, তাঁকে জীবনযাপনের সঙ্গী করে না নেয়, তা হলে সে আরও বড় মূর্খ!”
কবি নিজে লিখেছিলেন, মৃত্যুর পর সবাই যেখানে যায়, সেখানে মানুষের সেবা পৌঁছয় না কিন্তু ভালোবাসা হয়তো বা পৌঁছয়, ‘‘নইলে ভালবাসা এখনো টিকে থাকে কেন?’’ কি অদ্ভুত এই ভালোবাসার ব্যাখ্যা…।
২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথকে হারাবার দিন বিচ্ছেদের দিন যতটা, তার চেয়ে বেশি তাঁকে নতুন করে পাওয়ার দিন। এই বোধও যে রবিরই দান।
“মরিতে না হইলে বাঁচিয়া থাকিবার কোন মর্যাদাই থাকিত না।” কবির এই ভাবনায় বেঁচে থাকার প্রতিটা দিনকে বয়ে চলা। নিত্য ভাবনার যিনি জন্মদাতা, প্রতি অনুরাগের যিনি পূর্বরাগ, সকল রাত্রির যিনি প্রভাত, সমস্ত বেদনার যিনি সুখতারা, প্রতি অনুক্ষণের জন্মদাতা যিনি মৃত্যু তাঁকে ছুঁয়ে নবজন্ম পায়। শত শত মানুষের মনে নতুন করে জন্ম তোমার, মৃত্যুহীন তুমি…।