শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

গুগলবাবা বলছেন বরের জুতো লুকিয়ে রাখার প্রথা নাকি বাঙালি বিয়েতে বহুদিন ছিল। জ্ঞানীগুণী মানুষ বা গুগলবাবার মতো সর্বজ্ঞানীরা যখন কিছু বলেন তখন প্রাথমিকভাবে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত সেটা মেনে নিতে হয়। যদিও ঠিকানা খোঁজার ব্যাপারে গুগলম্যাপ কেমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায় সেটা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। তবু সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য না থাকায় ধরে নিতে হল যে, বাঙালি বিয়েতেও এমনটা ছিল। কিন্তু অনেক ভেবেও কিছুতেই মনে করতে পারছি না ছোটবেলায় যে এতগুলো বাঙালি বিয়েবাড়িতে গিয়েছি সেখানে কোথাও কখনও বরের জুতো লুকোনো হয়েছে বলে। বড়বেলায় এসে ১৯৯৪ সালে ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ সিনেমা দেখার পর থেকেই সম্ভবত এই রীতি এত জমজমাটভাবে বাঙালি বিয়েতে ঢুকে পড়েছে।

হ্যাঁ, এটা অবশ্যই হিন্দিবলয়ের বিয়েতে একটি অত্যন্ত চালু অনুষ্ঠান। আমাদের মধ্যে যে রীতিটার কথা মনে পড়ছে সেটা বিয়ে এবং বৌভাত দুক্ষেত্রেই হত। কণের বাড়িতে বিয়ের পরদিন সকালে ‘বাসর-জাগানি’র জন্য কম বয়েসী হুল্লোড়করা শালিরা একটা অর্থমূল্য দাবি করতেন এবং মানে গোটারাত ধরে বরকণের জীবনের শ্রেষ্ঠক্ষণকে নাচেগানে মনোরঞ্জন করবার একটা পারফরম্যান্স ফি গোছের ব্যাপার। আর উলটো দিকে নতুন বউকে নিয়ে বর নিজের বাড়ি ফেরার পর কচি দেওর-ননদের দল নতুনবৌদির বাড়িতে পা দেওয়ার আচার অনুষ্ঠানের পর, ঘরে ঢোকার মুখে দরজা আটকাতেন, ক্লান্ত শ্রান্ত নতুন বউয়ের কষ্ট কমাতে টাকাটা দ্রুত পাওয়া যেত। সেই পাওনা টাকায় বৌভাত মিটলে বরকণের সঙ্গে বাড়িশুদ্ধ সক্কলে মিলে সিনেমা বা কলকাতায় পেশাদার মঞ্চের থিয়েটার দেখতে যাওয়া হতো। কনের বাড়িতে এই উৎসবটা হতো আর ক’ দিন বাদে ধুলো-পায়ে বরকণে ফিরে এলে। সংগত কারণেই সেখানে কোথাও ‘দুলহে কি শালিয়োঁ / ও হরে-দোপাট্টে ওয়ালিয়োঁ/ জুতে দে দো/ প্যয়সে লে লো’ গানে সুর করে কাঊকে নাচতে দেখিনি। যাই হোক যে যুগের যে চাহিদা…।
সম্প্রতি আমার এক সন্তানসম আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। এই বিয়েবাড়িগুলোতে গেলে বোঝা যায় যে আমাদের বয়স বেড়ে গেছে। একমুহূর্তের একাকীত্বে সিনেমার ফ্ল্যাশকাটের মতো অনেকগুলো বছর যেন পিছিয়ে যাই… সাদাকালোয় সেই আমিই তখন মা-বাবার সঙ্গে কোন বিয়েবাড়িতে গিয়ে নেচে বেড়াচ্ছি, পরের পর ভেজিটেবল চপ বা মোচার চপ খেয়ে যাচ্ছি। তখন ভেজ ননভেজ এত ধরনের স্ন্যাকস থাকতো না। চা-খাওয়া বারণ তাই দেদার বরফ দেওয়া রঙিন শরবত খাচ্ছি। ভুরিভোজ শেষ হয়ে গেলে হয়তো আইসক্রিম খাচ্ছি বা মিষ্টি পান খাচ্ছি। একাধিক…

বর্তমানে ফিরে আসার পর খেয়াল হলো চুলদাড়ি বহুদিন পেকে গেছে আমিই এখন সেই বিয়ের আসরে বরকর্তা হিসেবে বসে আছি। কন্যাপক্ষের গুরুজনেরা আমাদের যথেষ্ট খাতিরযত্ন করছেন। বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। ঠিক কি বেঠিক জানি না তবে আমাদের বাঙালি সংস্কার ও রীতি অনুযায়ী বরের মা-বাবা ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান দেখেন না। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা একটু দূরে অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বসে আছেন। বহুদিনই আলাদা বাড়ি, লন বা হোটেল ভাড়া করে বিয়ে বা বৌভাতের অনুষ্ঠান করা হয়। এসব জায়গায় আজকাল বর বা কনে বসার আলাদা সাজানো মঞ্চ, অতিথিদের বসার জায়গা বিয়ের আসর খাবারের জায়গা সমস্তকিছুর নিখুঁত ব্যবস্থা থাকে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৯: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /১

মুভি রিভিউ: উলঝ ছবিতে জাহ্নবী কাপুরের অভিনয়ে আশ্চর্য হবেন

এ বার বরসজ্জা ছেড়ে বরকে গরদের ধুতি-জোড় পরতে হবে। বরকে নিয়ে আমি গেলাম পোশাক পরিবর্তনের জন্য আর ঠিক তখনই আবিষ্কার হলো আমার পাশেই বরের ছেড়ে যাওয়া ঝকঝকে দামি নাগরাটি উধাও! এটার ব্যাপারে আমার কোন অতিরিক্ত সতর্কতা ছিল না। যাইহোক এই জুতো-লুকোনোর টাকাটা বিয়েতে প্রয়োজনীয় কণে’র লজ্জাবস্ত্রের শাড়ির মতোই আজকাল সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের সঙ্গেও ছিল। বরের ছোট্ট ট্রলিব্যাগে তার বরসজ্জার দামি পাঞ্জাবি ধুতি রাখা হল বের করা হল সিদুঁরদানের নতুন গামছা আর লজ্জাবস্ত্রের শাড়ি। বিয়ে মিটল। বরকণে এবার বিয়ের আসর থেকে ভিতরে গিয়ে বসবে। কিন্তু যেতে তো হবে খালি পায়ে?

না, বরের আনন্দিত সহৃদয় শ্বশুরমশাই তাৎক্ষণিক বন্দোবস্ত হিসেবে একটা সাইজমতো চটি জোগাড় করে ফেলেছেন। বন্ধুবান্ধব শালা-শালী পরিবৃত নববিবাহিত বরকনেকে ঘিরে তখন ক্যামেরাম্যানরা ছবি তুলছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬২: মঠ-মন্দির তৈরি করার চিন্তা বেশি করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ

হঠাৎ আমাদের বরপক্ষেরই বয়স্ক কিন্তু ফিটফাট একজন দাদাগোছের আমার কাছে এসে বরের ট্রলিব্যাগটা চেয়ে নিয়ে গেলেন। আমি ভাবছি কী ব্যাপার এখন তো আর ট্রলিব্যাগের কোনও কাজ নেই। আবার নিমেষের মধ্যে আগাথা ক্রিস্টির গল্পের বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারোর মতো তিনি চুপিচুপি ট্রলিব্যাগটা আমায় দিয়ে চাপাস্বরে বলে গেলেন
—হাতছাড়া করবেন না!
—কেন ?
উত্তরে চোখটা বুজিয়ে শুধু মাথা নাড়লেন। আর যাবার আগে বরের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলে চলে গেলেন।

বরকর্তা হিসেবে একটা নিটোল বিয়ের সুচারু ব্যবস্থাপনার পর সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে ভুরিভোজের ঠিকানায় পা বাড়িয়েছি, তখন কন্যাপক্ষের এক যুবক এসে বললেন—
—কাকু ট্রলিব্যাগটা দিয়ে দিন। গাড়িটা যাচ্ছে ব্যাগটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আমি ওঁকে চিনি। সকালে কন্যাপক্ষের গায়েহলুদ নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। হাতের ট্রলি ব্যাগ নিয়ে আর খেতে বসব কি করে? নিশ্চিন্তে ব্যাগটা দিয়ে দিলাম। যুবক চলে যেতেই ছুটে এলেন এরকুল পোয়ারো-
—একী ট্রলিব্যাগটা?!
—ব্যাগটা তো নিয়ে গেল?
—কে?
—এই রে! নামটা তো… কিন্তু মুখ চিনি। সকালে এ বাড়ির গায়ে-হলুদ
নিয়ে এসেছিল?
—আপনি আমার সঙ্গে আসুন!
—কোথায়?
—ছেলেটাকে দেখাবেন!
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

বিয়েবাড়ির অতিথিদের ভিড় এড়িয়ে তীব্র গতিতে চলেছেন গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো পিছনে পিছনে আমি। একবার গতি কমিয়ে পাশাপাশি চলতে চলতে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন—
—লক করেছিলেন?
—না তো ! খোলা ছিল বুঝি?
—হ্যাঁ যদি কিছু রাখতে হয় তাই আমি আর… ছিছিছি।
—দামি কিছু ছিল? গয়নাগাটি?
উত্তর না দিয়ে চোয়াল শক্ত করে আগাথা ক্রিস্টির গল্পের বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা ছুটছেন সামনের দিকে। দূরে দেখা গেল সেই যুবককে। গেটের পাশের পার্কিং-এ অনেক গাড়ির ভিড় থেকে একটি লাল টুকটুকে গাড়িকে অন্যগাড়ির ‘অন্যায় ছোঁয়া’ বাঁচিয়ে, বের হয়ে আসতে একহাতে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিচ্ছে – তার অন্য হাতে সেই হারানিধি ট্রলিব্যাগ।
—ওই তো!
আর কোনও সুযোগ না দিয়ে পোয়ারো ছুটে গেলেন যুবককে হতচকিত করে ব্যাগের নাম্বার লকটা ঘুরিয়ে দিলেন – তারপর ঘাড় নেড়ে যুবককে ইশারায় বললেন এবার ব্যাগ যেতে পারে। হতভম্ব যুবক ব্যাগটা গাড়িতে তুলে দিল।
এ বার গোয়েন্দা আমার কাছে এসে ফেলুদার মতো হাসিমুখে বললেন
—যাক! এবার নিশ্চিন্ত!
—কিন্তু ট্রলি ব্যাগে ছিলটা কি?
—বরের চুরি যাওয়া জুতো!
—মানে!
আমি আঁতকে উঠি।
—চলুন খেতে খেতে সব বলছি!
খাবার পাতে কাসুন্দি মাখিয়ে ফিশফ্রাইতে কামড় দিয়ে গোয়েন্দা বললেন—
—আপনি তো বিয়ে দিতে ব্যস্ত ছিলেন। আমি কিন্তু দূর থেকে বরের জুতোটা লক্ষ্য করছিলাম। যেই দেখলাম একটা ফচকে ছেলে তুলে নিয়েছে। আমি নিঃশব্দে তাকে ফলো করতে শুরু করলাম। যেখানে ঠাকুররা রান্না করছে তার পেছনে জ্বালানি কাঠ রাখা আছে। সেখানে গিয়ে এসে জুতোটা রাখল। সে চলে যেতেই আমি গিয়ে চোরের উপর বাটপাড়ি করলুম। ওই জুতো বরের ব্যাগে ঢুকিয়েদিলুম।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এর মধ্যে শালীর দল এসে আমাদের পাশের টেবিলেই বসা বরকে ঘিরে ধরেছে তাদের দাবি জুতোর জন্য দশ হাজার টাকা চাই ! দশহাজার শুনে বর বলে উঠল—
—আমি দশ লক্ষ টাকা দেব কিন্তু আমার ওই জুতোটাই চাই। জুতোটা
এনে দাও!
চারদিকে খোঁজ খোঁজ কোথায় পাবে জুতো? সে তো তখন গাড়ি চড়ে বাড়ি পৌঁছে গেছে। কণের বাবা যারপরনাই লজ্জিত। এসে আমাকে বললেন—
—এতরাতে দোকান তো সব বন্ধ আমি কাল সকালেই ওর একটা ভালো জুতো কিনে তবে ওদের বাড়িতে পাঠাবো।
আমার উত্তর নেই। আমি পাতুরির পাতা খুলতে খুলতে তাঁর দিকে বোকার মতো তাকালাম, আড়চোখে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আমাদের সেই গোয়েন্দাদাদা মিটিমিটি হাসছেন।

হাত ধুয়ে দেখি দূরে একটি কম বয়েসী ছেলে প্যান্ডেলের কোণে-কোণে কাপড় সরিয়ে সরিয়ে কী যেন খুঁজছে। আমার হাতে একসঙ্গে দু’তিনখানা মিষ্টিপান ধরিয়ে দিয়ে সেই ফিটফাট দাদা এসে বললেন—
—কে বলুন তো? সেই জুতোচোর! ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশপাথর! ও খুঁজুক! চলুন আমরা এবার রওনা দেবো!
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content