রবিবার ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

বিকেল থেকে আকাশের মুখ ভার। সন্ধে থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। রাত আটটা নাগাদ উঠে পড়লাম অফিস থেকে। একটু নীলাঞ্জনের বাড়ি নিউটাউন যেতে হবে। নীলাঞ্জন আমার অফিসের সিনিয়র ম্যানেজার। আমার থেকে বয়সে একটু বড়। খুবই বিশ্বস্ত, কাজের মানুষ। একসপ্তাহ আগে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে। হসপাতাল থেকে কাল বাড়ি ফিরেছে। একবার যেতেই হবে ওর বাড়ি। আমার অফিস সল্টলেকে। গাড়িতে নিউটাউন যেতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু বৃষ্টির জন্য প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে গেল ওর বাড়ি পৌঁছতে।

নীলাঞ্জনের সঙ্গে কথা বলে প্রায় সাড়ে দশটায় বেরলাম। একে বৃষ্টি তারপর কলকাতার রাস্তায় তো যানযট লেগেই আছে। আমার বেলেঘাটার বাড়ি পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগবে কে জানে। কোনওরকমে চিংড়িঘাটায় পৌঁছতেই এগারোটা বেজে গেল। এরমধ্যেই আমার গিন্নি সুচেতার দু’বার ফোন এসে গিয়েছে। জানিয়েছি দেরি হবে।

আবার জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না প্রায়। সাউথ ক্যানাল রোডটা ধরলাম। এই রাস্তায় এখন লোকচলাচল নেই বললেই চলে। ফাঁকা রাস্তা ধরে মনের সুখেই এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ দেখি রাস্তার বাঁদিকে এক মহিলা দাঁড়িয়ে ক্রমাগত হাত নেড়ে চলেছেন। আমি মনে মনে ঠিক করলাম গাড়ি থামাবো না। এত রাতে কে কোন মতলবে আছে কে জানে? পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে থমকে গাড়িটাকে সাইড করতে বাধ্য হলাম। ঊর্মি না? হ্যাঁ, ঊর্মিই তো। কুড়ি বছর পর দেখা। কিন্তু ওকে আমি চিনব না হয় কী করে? তুই এখানে? উঠে আয় গাড়িতে। একেবারে ভিজে গেছিস যে? ঊর্মি গাড়িতে উঠতে উঠতেই বলতে শুরু করল বেশ তো না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলি, থামলি কেন? হেসে ফেললাম। এক রকম ঝগড়াটি রয়ে গিয়েছিস। এত রাতে এখানে কী করে? ঊর্মি আবার রাগ রাগ মুখ করে আমায় ধমক দিল, গাড়িটা স্টার্ট কর বাড়ি যেতে হবে না? আমিও বাধ্য ছেলের মতো গাড়ি স্টার্ট করলাম। ঊর্মি ওখানে কাছেই এক সহকর্মীর বাড়ি এসেছিল। নিজের গাড়িটা আনেনি। সেই সহকর্মীই তাঁর গাড়িটা দিয়েছিলেন ফেরার জন্য। কিন্তু গাড়িটা একটু এসেই খারাপ হয়েছে। এত রাতে ক্যাবও পায়নি। অগত্যা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ির অপেক্ষা করছিল। কতদূর যাবি? জিজ্ঞেস করতেই আবার সেই ঝাঁঝালো উত্তর— নামিয়ে দিস শিয়ালদা বা কোথাও একটা বাস পেয়ে চলে যাব। কথায় কথায় জানলাম হাওড়ার আন্দুলে একটা বাংলো টাইপ বাড়ি কিনেছে বছর খানেক আগে। বললাম, বিয়ে করেছিলি তো শুনেছিলাম। হো হো করে হেসে বলল। সে সব কবে চুকে বুকে গিয়েছে। তারপর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে উঠল তা বলে ভাবিস না তোর ঘাড়ে চেপে বসব। আমিও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম ‘সে আর আমার চেয়ে কে ভালো জানে’?
সত্যিই ঊর্মিকে আমার চেয়ে ভালো কেউ কি জানতে পারে? ঊর্মি আর আমার বাড়ি ছিল এপাড়া আর ওপাড়া। ছোট বেলায় একই স্কুলে পড়তাম দু’জনেই। আমি ছোট থেকেই খুব শান্ত, চুপচাপ। কী কথা বলব ভেবেই পেতাম না। ঊর্মি ছিল খুব ডাকাবুকো টাইপের। একসঙ্গে কত কথা যে বলতে পারত। খুব বন্ধুত্ব ছিল দু’জনের। ক্লাস শেষ হলে খেলাধূলো করার চেয়ে বেঞ্চে দু’জনে পা দুলিয়ে বসে গল্প করতাম বেশি। অন্য বন্ধুরা ওর সঙ্গে গল্প করলে রাগ হতো খুব। তারপর হঠাৎ একদিন ও অন্য স্কুলে চলে গেল। খুব কষ্ট হয়েছিল। অভিমান হয়েছিল তার চেয়েও বেশি। ক্লাস ইলেভেনে আবার দু’জনের দেখা। একই স্কুল, একই কোচিং। একসঙ্গে বসা, টিফিন খাওয়া, একসঙ্গে অঙ্ক করা। ঊর্মি চিরকালই ভালো স্টুডেন্ট। যেমন পড়াশোনায়, তেমনই আঁকায়, লেখায়, কথা বলায় তুখর। কিন্তু ভীষণ খামখেয়ালি। যখন যা করতে ইচ্ছে হয়, তাই করে। কোনও বিষয়ই তলিয়ে ভাবে না। ভেবে চিন্তে সময় নষ্ট করা ওর স্বভাবে ছিল না। কিন্তু ততদিনে যে ওই জেদি, খামখেয়ালি মেয়েটা আমার খুব কাছের হয়ে গিয়েছে।

ঊর্মিকে একদিনের বেশি দেখতে না পেলে পাগল হয়ে যেতাম। বন্ধুরা অনেকেই বুঝত সেকথা। আকার ইঙ্গিতে বোঝালেও একজন কোনওভাবেই বুঝত না। আমিও হাল ছেড়েই দিলাম। কারণ, বললে যদি হারিয়ে ফেলি চিরদিনের জন্য। উচ্চমাধ্যমিকে দু’জনেরই বেশ ভালো রেজাল্ট হল। আমি বিবিএ পড়ব। বাবার ইচ্ছে অত বড় ব্যবসা সামলাতে হবে। ঊর্মি জয়েন্ট পেল। ডাক্তারি পড়বে। তখনও বলতে পারছি না আমার মনের কথা। এক বন্ধুর পরামর্শে ঊর্মির কাছের বন্ধু সৌজন্যার সঙ্গে বেশ কিছুদিন বেশি মেলামেশা শুরু করলাম। তাতে ওর কোনও প্রতিক্রিয়াই চোখে পড়ল না। মনকে বোঝালাম ঊর্মি আমায় ভালোবাসে না।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩৬: ছবিঘর অন্ধকার

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১১: আমার নাম, তোমার নাম— তুং নাম, তুং নাম!

ঊর্মি বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে চলে গেল। আমি কলকাতার কলেজ থেকে বিবিএ, এমবিএ করলাম। তারপর বাবার ব্যবসায় জয়েন করলাম। শুনলাম ঊর্মিও ফিরেছে। প্র্যাকটিসও শুরু করেছে। ততদিনে একটা ভালো মোবাইল ফোন কিনেছি। এক রবিবার হঠাৎ ফোন, অজানা নম্বর। ফোন তুলতেই একটা তীব্র ধমক— জাহান্নামে থাকিস? দু’দিন ধরে ফোন করছি, পাচ্ছি না। ততক্ষণে আমি বুঝে গিয়েছি কে ইনি? ঊর্মি দেখা করতে চাইল। কি যেন বলার আছে, কিন্তু বাড়িতে নয়। আমরা অঙ্কের কোচিং যেতাম যেখানে সেখানেই একটা রেস্তরাঁয় বহুদিন পর বসলাম দু’জনে। আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ঊর্মি বলতে শুরু করল — ‘বাবা-মা বিয়ের কথা বলছেন। অনেক ভেবে দেখলাম তোর মতো একটা আহাম্মক ছাড়া আর কাকেই বা বিয়ে করব? কবে বিয়েটা করতে পারবি একটু জানাস তো?’ আমার দম তো বন্ধ হবার উপক্রম। এতো মেঘ না চাইতেই জল। তারপর খানিকক্ষণ কথা বলে বাড়ি ফিরলাম দু’জনে। বাড়িতে জানাতেই মা বাড়িটাকে রণক্ষেত্রে পরিণত করলেন। ও মেয়ে কখনওই এই বাড়ির উপযুক্ত নয়। হতে পারে ভালো পরিবারের। কিন্তু ও মেয়ের হাবভাব মোটেই সংসার করার মতো নয়। মায়ের কথা শুনে আমার মাথায় বজ্রাঘাত। বাবা জানালেন— তাঁরও এই বিয়েতে মত নেই। আমি যেন পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে আলাদা ব্যবসা বা চাকরি খুঁজে নিই। অগত্যা ঊর্মির বাড়ি গিয়ে ওর মা-বাবা আর ওর কাছে সময় চাইলাম। জীবনে কখনও কিছুই চাইনি। ঊর্মিকে ছাড়া। যত তাড়াতাড়ি পারি একটা কাজ যোগাড় করতেই হবে। একটা বাড়ি পেয়েই যাব। চালিয়ে নেব দু’জনে। অন্যদিকে মা-বাবা। আমি প্রায় উদ্ভ্রান্ত। চার-পাঁচদিন পর আমাদের আরেক ছোটবেলার বন্ধু অভির ফোন। জরুরি তলব। অভির বাড়ি গিয়ে শুনলাম ঊর্মি আগের দিন রাতেই দেরাদুনে এক হাসপাতালে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছে। একটা চিঠি রেখে গিয়েছে আমার জন্য। আমার সঙ্গে যে কথা হয়েছিল, তা ও মনে রাখতে চায় না। নিজেকে সামলে উঠতে যে ক’দিন লেগেছিল মনে নেই। বাবা-মা আমার অবস্থা দেখে পুরনো কোন্নগরের বাড়ি ছেড়ে বেলেঘাটায় বাড়ি কিনে চলে আসেন। সল্টলেকে বাবার অফিস শিফট করা হয়। সময় অনেক কিছুই ভুলিয়ে দিল। তার পর বাবার বন্ধুর মেয়ে সুচেতাকে বিয়ে করি। আমাদের মেয়ে তিতলি। অভি পরে খবর দিয়েছিল ঊর্মি এক ডাক্তারকে বিয়ে করেছে। আর কোনও খবর জানা ছিল না।
আজ কুড়ি বছর পর দেখা। ঊর্মি কথা বলে যাচ্ছে—পঞ্চাশেই বুড়ো হয়ে গেছিস যে। আমিও টুকটাক উত্তর দিচ্ছি হেসে। জোর করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম। কেন চলে গিয়েছিলি সেদিন। ঊর্মি একটু চুপ করে গেল। তারপর আবার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল— ছাড় তো। এখন তোর কথা বল। কিন্তু আমারও তখন জেদ চেপেছে মাথায়। বললাম—না, তোকে বলতেই হবে। আমারও জানার অধিকার আছে। ঊর্মি কেমন উদাস গলায় বলে উঠল, সকলে যে বাঁধনে বাঁধা পড়ে না দেবরাজ। বেশ রাগ হল। জোর গলায় বলে উঠলাম, বিয়েটা তো পরে করলি? আমাকে ঠকালি কেন? ঊর্মি চুপ করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, বিয়েটা করলে তোকে হারাতাম। কথাগুলো কেমন বুকে আঘাত করল। ততক্ষণে শিয়ালদা চলে এসেছি। এই রাতে ওকে একা ছাড়তে পারব না। বললাম, চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিই। সুচেতাকে ফোন করে জানালাম এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে, সে অসুস্থ। তাকে বাড়ি পৌঁছে ফিরব। সুচেতা আমার এহেন সমাজসেবা সম্পর্কে অবগত। ফোন রাখতেই ঊর্মি বলে উঠল তোর এই মিথ্যে বলা অভ্যাসটা গেল না দেখছি। দু’জনেই হেসে ফেললাম।

এমন কত মিথ্যে বলে পড়া ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মেরেছি বন্ধুরা। তার যে একমাত্র কারণ ছিল ঊর্মির সঙ্গে একটু বেশি থাকা। গাড়ি চালাতে চালাতে কত পুরনো কথা বলে চলেছি দু’জনে। কোন কোন বন্ধুকে কী নামে ডাকতাম। কী কী দুষ্টুমি করতাম স্যার ম্যামদের সঙ্গে। রণিতা ম্যাম ক্লাসে পড়া ধরলে কীভাবে কোলের ওপর বই খুলে দেখে নিয়ে উত্তর দেওয়া যায় সে পদ্ধতি তো ঊর্মিই শিখিয়েছিল। বললাম, হ্যাঁ রে প্র্যাকটিস করছিস তো? উত্তর এল না হলে খাব কী? বাবা-মায়ের কথা জানালাম, দুজনেই আজ আর নেই। ঊর্মি মা-বাবার সঙ্গে থাকে না। আন্দুলেই একটা নার্সিংহোমে চাকরি করে। অনেকদিন তোর গান শুনিনি। একটা গান গাইবি ঊর্মি, যে গানটা বিমলদার কোচিংয়ে ফেয়ারওয়েলে গেয়েছিলি। ঊর্মি আমার দিকে তাকাল। তারপর গেয়ে উঠল— জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার। এমন গান আমার ঊর্মিই গাইতে পারে। সেকেন্ড ব্রিজে চলে এসেছি কথা বলতে বলতে। এবার ঊর্মির পথ নির্দেশে চলতে চলতে ওর বাড়ি পৌঁছে গেলাম। ছোটখাট বাগান আছে সামনেটা। কিন্তু চারিদিক বড় অন্ধকার। এত বৃষ্টিতে নির্ঘাত পাওয়ার অফ হয়েছে। বলতে বলতে দরজাটা খুলে আমাকে নিয়ে বাড়ি ঢুকল ঊর্মি। দাঁড়া একটা মোমবাতি জ্বালাই। এখানে তো সেভাবে পাওয়ার অফ হয় না। ড্রয়ার থেকে মোমবাতি, দেশলাই বের করে জ্বালল। বাড়িটা একতলা। দুটো বড় বড় ঘর। আমাকে একটা ঘরে বসিয়ে আরেকটা ঘরে গেল ও। ততক্ষণ মোমবাতির আলোয় ঘরটা দেখছিলাম। পুরো দেওয়াল জুড়ে পেন্টিং। সবই ওর আঁকা। ছবির নিচে নামটা জ্বলজ্বল করছে ঊর্মিমালা রায়।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

একটু পরেই ঊর্মি ঢুকল একহাতে এককাপ কফি আরেক হাতে একটা বড় সাদা কাগজে মোড়া কিছু একটা। কফির কাপটা আমার হাতে দিয়ে অন্য হাতের জিনিসটা পাশে রাখল। বসল একটা চেয়ার টেনে। মোমবাতির আলোয় কি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ওকে। আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে উঠেছিস যে। বয়স তো বোঝাই যাচ্ছে না। আমার কথায় আবার হেসে ফেলল ঊর্মি। বললাম— একা থাকিস কী করে? আমার কথা শুনে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আর কোনও দেবরাজ পেলাম না যে! গলার কাছে কি একটা দলা পাকিয়ে গেল। ঊর্মির চোখটা মোমবাতির আলোয় ছলছল করছে দেখতে পেলাম। ওকে ভীষণ জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কি একটা অভিমান বড় বাধা হয়ে দাঁড়াল। আবার একটু জোর গলায় বলে উঠলাম ছেড়ে গিয়েছিলি কেন তাহলে। ঊর্মি আবার সেভাবেই একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল যে কোনওদিন আমার থেকে জোর করে কিছু চাইল না। শুধু দিয়েই গেল। তাকে তার ভালোবাসার মানুষ তার বাবা-মাকে তার কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে উপায় কি ছিল বলতো। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ঊর্মি তখনও বলে চলেছে বাবা-মাকে ছাড়তে হবে জেনে তোর যা অবস্থা হয়েছিল। সেদিন আমার দেবরাজকে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কতক্ষণ দু’জনে চুপ করে বসেছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘড়িতে চোখ পড়ল দেখলাম দুটো দশ। আর নয়। এ বার তো ফিরতে হবে। উঠে পড়লাম। ঊর্মি কাগজের মোড়কটা এগিয়ে দিয়ে বলল, তোর জন্যই ছিল, ভেবেছিলাম যেদিন দেখা হবে তোর জিনিস তোকেই দেব। বললাম, কী এটা? বলল বাড়ি গিয়ে দেখিস। আস্তে আস্তে বাইরে এলাম। চারিদিক অন্ধকার। তখনও বিদ্যুৎ নেই। ঊর্মিকে ফেলে আসতে মন চাইছে না। জোর করেই শরীরটা গাড়িতে এনে তুললাম। পিছনে ফিরে তাকালাম ঊর্মি হাত তুলে বিদায় জানাল। কেমন একটা ভারাক্রান্ত মনে কীভাবে যেন অতটা রাস্তা ড্রাইভ করে প্রায় তিনটের সময় বেলেঘাটায় আমার বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরে মনে পড়ল ফোন নম্বরটা নেওয়া হয়নি।
বিছানায় শুয়ে ঊর্মির কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ ঘুম ভাঙল ফোনের ডাকে। উঠে দেখি সকাল আটটা বাজে। তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিলাম। এখন অভির ফোন। ফোনটা ধরতেই অভি ভাঙা ভাঙা গলায় বলে উঠল ফোন না করে পারলাম না রে দেবু। কাল রাত দশটা নাগাদ মা ফ্লাইওভারে একটা অ্যাকসিডেন্টে ঊর্মি মারা গিয়েছে। স্পটেই। আমার চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গেল। না, আর কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম তিতলি মাথার কাছে বসে। সুচেতা সামনে দাঁড়িয়ে। পাশের বাড়ির সাগ্নিক দা এসেছেন। ডাঃ মজুমদার, আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানও আছেন। ডাক্তারবাবু ঘুমের ওষুধ লিখে দিয়ে চলে গেলেন। সাগ্নিকদাও চলে যাবার পর তিতলিকে পড়তে পাঠিয়ে সুচেতা বসল আমার পাশে। ঊর্মির সম্পর্কে সুচেতা জানে। ওর কাছে কিছুই লুকোলাম না। তখনই সুচেতা জানাল, আজকের কাগজে ঊর্মির অ্যাকসিডেন্টের খবরটা আছে। ও ভেবেছিল ঘুম থেকে উঠে খবরটা দেবে। আমার কাছে কিছুক্ষণ বসে সুচেতা রান্নাঘরে চলে গেল। আর যাবার সময় বার বার বলে গেল ওটা একটা স্বপ্ন। আমি ক্লান্ত ছিলাম তাই আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখেছি। সুচেতার কথাগুলোই হয়তো ঠিক। ভাবতে ভাবতে মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আরে কাগজের মোড়কটা তো নিজের হাতেই গাড়ির ডিকিতে রাখলাম। মনে হওয়া মাত্র ছুটে চাবি নিয়ে নিচে নামলাম। গাড়ির ডিকিটা খুলতেই কাগজের মোড়কটা পেয়ে গেলাম। না ভুল নয়, স্বপ্ন নয়। সে আমার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারে না। পাগলের মতো এক নিমেষে খুলে ফেললাম মোড়কটা। একটা অয়েল পেন্টিং। বেঞ্চের ওপর পা দুলিয়ে মুখোমুখি বসে আছে স্কুল ড্রেস পরা দুটো ছোট ছেলে আর মেয়ে। নিষ্পাপ একটা ছবি। কোনও জটিলতা নেই, কোনও কলঙ্ক নেই। এ শুধু আমার জন্যই আঁকা। ছবিটা বুকে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললাম। ঊর্মিরা সত্যিই কোনও বাঁধনে বাঁধা পড়ে না। শুধু রেখে যায় তাদের অফুরান ভালোবাসাটুকু।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

আরও তিনবছর কেটে গিয়েছে। বারবার ভেবেছি আরেকবার যদি দেখা পেতাম। ছেলেবেলার প্রেম জানি না অভিশাপ না আশীর্বাদ। শুধু জানি আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে সে আজও আছে। আঁকা ছবি চোখের সামনে থাকুক বা না থাকুক, স্বপ্নে দুটো স্কুল ড্রেস পরা সাত আট বছরের ছেলেমেয়ে আজো কত গল্প শোনায়। আর একা রাস্তায় বৃষ্টির দিনে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বা একা অন্ধকার ঘরে বসে বসে আজো যে আমার কানের কাছে কেউ মিষ্টি সুরে গেয়ে ওঠে—
“এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে
গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে
তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে…”
* দেবলীনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সহকারী অধ্যাপিকা, ড. এপিজে আব্দুল কালাম গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content