শুক্রবার ১৯ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

এ পাড়ায় এখন ঘরে ঘরে টিভি সেট। কারেন্টের অবস্থা তথৈবচ বলে অনেকে আবার ব্যাটারির ব্যবস্থা রেখেছে। তবে রাত নামলে আর কারেন্ট থাকে না প্রায় দিনই। অনেকে তখন রেডিওতে গান শোনে। ছেলেছোকরারা শোনে মোবাইলে গান। পূর্ণিমার একটা মোবাইল আছে, তবে তাতে কেবল ফোন করাই চলে। গান, ছবি কিছুই দেখা যায় না। সে আবদার করে রেখেছে, পরাণ বলেছে, “আচ্ছা, হবে খন। পুজোর সময় দেখা যাবে।” অতএব ঘুম না আসা রাতে সে যে মোবাইলে একটু গান শুনবে, কি সিনেমা দেখবে, তার উপায় নেই।
দিন দশ ধরে নাগাড়ে বৃষ্টির শেষে আজ দুপুরের পর থেকে আকাশের মেঘ হালকা হতে শুরু করেছিল। হাওয়ার বেগও কমে এসেছিল অনেক। বেশি বৃষ্টি হলেই বিলের জল তাদের উঠোন ছোঁয়। কতদিন থেকে স্বামীকে বলছে সে, ওইদিকে একটা পাকা গাঁথনি দিয়ে উঁচু দেওয়াল তুলে দাও। তাহলে আর জল ঢুকবে না খিড়কির দরজায়। কিন্তু সে কথা সে কানেই নেয় না। বলে, “দেওয়াল তুললে বিল আর দেখা যাবে না মোটেই। বাচ্চাটা শুয়ে শুয়ে বিল দেখে। ওর কষ্ট হবে !”
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প-৩: আঁশ/২

শারদীয়ার গল্প-২: আর্তি

খিড়কির কাছ ঘেঁষে বিলের জল ক’দিন ধরেই জমা আছে। ঘাট পর্যন্ত ডুবে গিয়েছে। জানালা দিয়ে তা-ই দেখছিল সে। পরাণ বুদ্ধি করে বাড়িটা খুব উঁচু করে তৈরি করেছিল বলে রক্ষে। নাহলে ঘরের ভিতর জল ঢুকে একশা হতো। আকাশ এখন পরিষ্কার। বাইরে ধপধপ করছে জ্যোৎস্না। তারই মাঝে তার চোখ গেল বারান্দার গ্রিলের দিকে। আজও দরজা হাট করে খোলা? আশ্চর্য! আজও মানুষটা ভুল করেছে। বৃষ্টিবাদলায় বিক্রি তেমন হচ্ছিল না ক’দিন। সেই জন্য দু’দিন দোকান খোলেনি পরাণ।
বাড়িতে থেকে দিনরাত বাচ্চার সঙ্গে আদিখ্যেতা করে কাটিয়েছে। মনে মনে হাড় জ্বললেও মুখে কিছু বলেনি পূর্ণিমা। সারা সন্ধ্যে বারান্দায় বসে জলের মধ্যে নৌকা বানিয়ে ভাসাচ্ছিল পরাণ। আর বাচ্চাটি খিলখিল করে হাসছিল। হাসছিল না তো, যেন পূর্ণিমার বুকে শেল হানছিল। এদিকে এখনও তার পেট হল না, আর ওদিকে সতিন কাঁটা বাচ্চাটা না মরে বেঁচে আছে এখনও! জ্বালা তো হবেই।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৯: তুনে ও রঙ্গিলে ক্যায়সা জাদু কিয়া… লতার সেই সুরেলা কণ্ঠ ও পঞ্চমের জাদু

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

হঠাৎ সে কেঁপে উঠল। পিছনে কলাগাছের পাশে ডুবে যাওয়া ঘাটের কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। ফিসফিস করে যেন ডাকছে কাউকে। এমন সময় তাকে অবাক করে দিয়ে গ্রিলের খোলা গেট দিয়ে কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে। তারপর জল কেটে কেটে এগিয়ে যেতে থাকল ঘাটের দিকে। চাঁদের আলোয় তার মাথার কোঁকড়া চুল চোখে পড়ল পূর্ণিমার। পুঁয়ে পাওয়া বাচ্চাটির মতোই লাগছে না? সে অবাক হল, আতঙ্কিতও।
কী দেখছে সে? তারপর তার মনে হল, যাই হোক না কেন, বাইরে বেরিয়ে দেখা উচিত। কি হচ্ছে জানতেই হবে তাকে। ঘুরে বেরুতে যাবে, বাধা পেল। পরাণ এসে দাঁড়িয়েছে কখন নিঃশব্দে। ফিসফিস করে বলল সে, “চুপ থাক। কাউকে বলিস না। বাচ্চাটা তার মার কাছে ফিরে যাচ্ছে। এখন ও ভালো সাঁতার শিখে গেছে। আমার দায়িত্ব শেষ। তোকে আর পুঁয়ে পাওয়া বাচ্চার দিকে বিষ নজরে দেখতে হবে না। দুধ গরম করতে হবে না। কাল ওর ঘরটা ধুয়ে মুছে সাফ করে রাখিস। সব ফেলে দিস, তবে ওর ঘরের দেওয়াল থেকে ওই মাছ-মেয়ের ফোটকটা সরাস না। ওটা ওর মায়ের ছবি তো ! তোর সতীন। ভালোই হল। এবার তোর পেট হবে দেখিস। তোকে আর বাচ্চা নেই বলে গুমরে মরতে হবে না। চল্‌, শুবি চল্‌!”
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

পরের দিন বাচ্চার ঘর পরিষ্কার করার সময় অবাক হয়ে দেখল পূর্ণিমা। তার বিছানা জুড়ে, ঘরের মেঝেয় পড়ে আছে বড়ো বড়ো রূপোলি আঁশ। যদিও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না, এখন সে জানে এই আঁশগুলি কার, কেন !
 

সমাপ্ত

* গল্প (Short Story) – আঁশ (Aansh) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content