রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

ঘরে ঢুকতে গিয়েই পূর্ণিমা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাওয়া পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে যাওয়ার মুখেই দরজার চৌকাঠে কয়েকটা বড় বড় আস্ত আঁশ সকালের রোদ পড়ে চক্‌চক্‌ করছে!

পূর্ণিমার হাতে একটা ছোট কাঁসার থালার উপরে জলভর্তি পিতলের ঘট, তার উপর আম্রপল্লব, কিছু তুলসী ও দূর্বা। আজ বিষ্যুদবার, এই দিনে গাঁয়ের সকলের মতো সে-ও লক্ষ্মীর ঘট পাতে। সেইজন্যই একেবারে ডুব দিয়ে, পুকুর থেকে ঘটে জল ভরে, তুলসীপাতা আর দুব্বো ঘাস তুলে নিয়ে সে যাচ্ছিল ঠাকুরের কাছে। একটা ছোট জলচৌকির উপর তার ঠাকুরের পট রাখা। আর আছে মাটির লক্ষ্মী-গণেশ। এই ব্যবস্থা বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক সে করেছে। নাহলে কুলুঙ্গিতে একখানা পুরাতন মকরবাহিনী গঙ্গার ছবি ছাড়া আর কোনও ঠাকুর-দেবতার ছবি বা মূর্তি ছিল না এ সংসারে। তা-ও আবার সে ছবি কিনা পরানের আগের বউ কোথা থেকে এনে রেখেছিল। পুজো করত নাকি। গঙ্গাদেবীর ভক্ত ছিল সে। তারও আগে, তার স্বামী বলে, তার শাউড়ির নাকি একখানা ছোট কিন্তু ‘ভেন্ন’ ঠাকুরঘর ছিল গোয়ালঘরের লাগোয়া। তা সে অনেককাল আগের কথা, ক’দিন ধরে নাগাড়ে তুমুল বৃষ্টি আর ষাঁড়াষাঁড়ির বানে নদীর জল ভীষণ হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠে সোঁ সোঁ আওয়াজ করে ছুটে এসে গোয়ালঘর, ঠাকুরঘর, মায় বসতবাটির এক অংশ পর্যন্ত একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এখনকার মতো তখন ইঁটের গাঁথনি ছিল না, মাটি আর দরমার বেড়া দিয়ে করা গোয়ালঘর আর ঠাকুরঘর যে টিকবে না, তাতে আর আশ্চর্য কী?

পরাণের আগের পক্ষের বউ ছিল নাকি যেমন দেমাকি, তেমনি লক্ষ্মীমন্ত। এ গাঁয়ের কারও সঙ্গে কথা বলত না তেমন, লোকের সামনে বেরতোও না বিশেষ। বেরলেও এক গলা ঘোমটা, পায়ের পাতা দেখা যায় না এমন করে শাড়ি পরা। পরাণ অবশ্য বলত, তার বউয়ের কোমরের নীচের অংশে সমস্যা ছিল। গ্রামের মেয়ে-ঝি-রাও বলে, নীচের অংশ ছিল ভারী, সে তুলনায় শরীরের উপরের অংশ ছিল পাতলা। পরাণ যে কোথা থেকে তাকে জুটিয়েছিল, মানে ওই যাকে বলে বিয়ে করে এনেছিল, তা নিয়ে লোকের ধন্দ এখনও কাটেনি।
এ গ্রাম জেলে-মাঝিদের গ্রাম। কতকাল ধরে বাপ-ঠাকুর্দা, তাদের বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে এই গ্রামের ছেলে-বুড়োরা শীত নেই, বর্ষা নেই তাদের নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নদীর উজান বেয়ে সমুদ্রের পানে। কখনও একলা, কখনও চার-পাঁচজনে দল করে। বিশেষ করে বর্ষার সময় বড় নৌকা নিয়ে দল বেঁধেই যায় তারা। তখন এমনিতেই নদীতে জল থই থই করে, জলের টানও থাকে মারাত্মক। এই সময় দল করে গেলে খাটনিও ভাগ হয়ে যায়, মাছও পড়ে জবর। বাকি সময় মাঝিরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে একলাই যায়। তা সেবার শীতকালে আচমকা অসময়ের বৃষ্টি শুরু হল। তিন চার দিন ধরে কখনো জোরে, কখনও ঝিরিঝিরি করে বৃষ্টি হয়েই চলল। এই সময় কারও গা থাকে না তেমন মাছ ধরতে যাওয়ার। নেহাত যার অবস্থা সঙ্গিন, না বেরুলে ঘরে খাওয়া জুটবে না, তারাই বাধ্য হয়ে বেরোয় শীতকালের ঝড়-বাদলা মাথায় নিয়ে। পরান একা মানুষ। তার তেমন দরকার ছিল না। তবু সে তার ছোট নৌকাখানা নিয়েই বেরিয়ে পড়ল। বন্ধুরা তাকে তাস-পাশা মদের লোভ দেখিয়েও আটকাতে পারল না। তাছাড়া পরাণকে যে ঘরের কেউ বাধা দেবে তার উপায় ছিল না। মা-বাপ দুজনেই অনেককাল হল গত হয়েছে। আজ বছর পাঁচেক পরাণ একাই থাকে। তার মায়ের খুব সাধ ছিল ছেলের বউয়ের মুখ দেখার, নাতি-নাতনিকে কোলে নিয়ে ‘দোল দোল দুলুনি’ করার, কিন্তু সে-সব সাধ পূর্ণ হওয়ার আগেই সে চলে গিয়েছে সব কিছুর মায়া কাটিয়ে। বাপ গিয়েছে তার পরের পরের বছর। তা সে-ও “বাপ্‌, বে কর একখান। ঘরে একটা মেয়েছেলে থাকা ভালো!” বলে বলে হয়রান হয়ে শেষে চোখ বুজেছে। সেই ইস্তক পরাণ একা।

সেই যে পরাণ বেরলো, তারপর মাসখানেক তার কোনও পাত্তা নেই। গাঁ-গঞ্জে হুটহাট করে কেউ থানায় যায় না। তাছাড়া ঘরের লোক কেউ থাকলে তারা নাহয় উদ্বিগ্ন হতো। কিন্তু প্রথমে কেউ তেমন গা করল না। পরে বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে তাদের কথাতেই একটা জেনারেল ডায়েরি করে এল। জলে কত রকমের বিপদ ওত পেতে থাকে। তার উপর সেই দিনটাও ভালো ছিল না। সকলেই ধরে নিয়েছিল, পরাণের পরাণখানা বড়ো গাঙই গিলে খেয়েছে। তার যে খিদে ভারি। গ্রামের মাতব্বরেরা অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে ভেবে শ্রাদ্ধ-শান্তির ব্যবস্থাও করতে চাঁদা তুলতে শুরু করে দিয়েছিল। আর ঠিক তার মাস-খানেকের মাথায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরান মণ্ডল ফিরে এল। আর ফিরে তো এলই, কিন্তু একা এল না। সঙ্গে সাত হাত ঘোমটা টানা বউ। সবাই তো হাঁ!
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩৬: ছবিঘর অন্ধকার

শারদীয়ার গল্প-১: পুরুষোত্তম/৩

সকলের জিজ্ঞাসায় সে জানাল, তার নৌকা নাকি খারাপ আবহাওয়ার কারণে দিক ঠিক করতে না পেরে অনেক দূরে ভেসে গিয়েছিল। খিদে তেষ্টায় কাতর হয়ে সে নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সেই অবস্থায় এই মেয়েটির বাবা তাকে উদ্ধার করে। কাছাকাছি তার নৌকা ছিল। সেই তাকে বাড়ি নিয়ে যায়। মেয়েটির মা নেই। সে অনেকদিন বিছানায় পড়ে ছিল। তখন এই মেয়েটিই তার সেবা-শুশ্রূষা করে তাকে সারিয়ে তোলে। এরপর তার বাবা তাকে মেয়েটিকে বিবাহ করতে বললে সে রাজি হয়ে যায়। সেখানেই স্থানীয় প্রথায় তাদের বিয়ে হয়। ব্যস্‌, এইটুকুই। আর কিছু না। পরাণ তার বউকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। শাঁখ বাজল না, উলু দিল না কেউ, বরণও করল না। দু’ জনের যৌথ জীবন শুরু হয়ে গেল।

পরাণের ঘর গাঁয়ের একটেরে। সেই যে পরীর বিল আছে, তারই গা ঘেঁষে। পরীর বিলের একূল ওকূল দেখা যায় না। বিলের দক্ষিণ দিকের সঙ্গে বড়ো গাঙ্গের যোগ আছে। সে গাঙ্গও খানিক এগিয়ে গিয়ে মিশেছে থই থই সমুদ্রে। পরানদের এ অঞ্চলে নদী-নালা, খাঁড়ি, বিল এসবই বেশি। আর আছে সুন্দরী, গরান—এইসব গাছ, ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে নদীপথে বিলের জলে কুমীরও ঢুকে পড়ে। এই তো বছর দুয়েক আগে গাঁয়ের কত লোকের চোখের সামনে নিত্য মণ্ডলের বাছুরটাকে কুমীরে টেনে নিয়ে গেল। বিলের জল খানিক রক্তে রাঙা হয়ে রইল, তারপর আবার যেই কে সেই। পূর্ণিমা এসে ইস্তক শুনেছে, পরীর বিল নাকি যে-সে বিল নয়। বিশেষ বিশেষ রাতে এখানে পরীরা নেমে আসে। ভাগ্যবানেরাই কেবল তাদের দেখা পায়। কিন্তু দেখা পাওয়ার পর তাদের ভাগ্য আর সুপ্রসন্ন থাকে না। তারা সব পাগল হয়ে যায়। তবু তাদের এলোমেলো অসংলগ্ন কথা থেকে যেটুকু জানা যায়, তা হল, বিলের মাঝখানে গজিয়ে ওঠা কতকালের চরে সেই সেই রাতে তারা এসে বসে থাকে, স্নান করে জ্যোৎস্নার আলোয় গায়ের জল শুকোয়। তারপর অস্ফুট স্বরে গান গাইতে থাকে। সেই গান একবার যে শোনে তার আর মাথার ঠিক থাকে না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, পরান মন্ডল আর তার বাবা-মা, এমনকি বৌয়েরও পর্যন্ত মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ, পরীর গান কোন না কোনদিন তাদের কানে যাওয়ারই কথা। কিন্তু তা হয় নি। পরান হেসে বলে, “আমার তো রাতে বিন্নায় শুলেই ঘুম। গান তো দূরের কথা, কানের কাছে বাঘ ডাকলেও শুনতে পাবো না।”
কিছুদিনের মধ্যে বোঝা গেল, পরাণ কেবল বৌ নিয়েই আসেনি, শ্বশুরের কাছ থেকে ভালো মতো পুঁজিও নিয়ে এসেছে। গ্রামীণ ব্যাঙ্কে সে খাতা খুলল, তাতে টাকাও জমা পড়ল। যাতায়াতের বাঁধ-রাস্তার ধারে একখানা মণিহারি দোকান দিল। জানাল, ‘সে আর মাছ ধরার কাজ করবে না। সকলে অবাক! বিড়াল যদি বলে মাছ খাবো না, বাঘে যদি বলে ঘাস-পাতা খাবে তা-ও নাহয় বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু জেলের পো যদি বলে জাল ধরবো না, মাছ ছোঁবো না, তাতে বিশ্বাস করা যায় না সহজে। সকলে ভাবল, নতুন বিয়ে করে সাময়িক মস্তিষ্ক বিভ্রম ঘটেছে পরানের। দু’দিন যাক, বিয়ের জল গা থেকে শুকিয়ে আসুক, ঠিক সুড়সুড় করে সে আবার নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সকলের সব ভবিষ্যৎবাণী ভুল প্রমাণ করে দিয়ে পরাণ তার বাপ-দাদার পেশা থেকে সরে এল। এখন তার পরিচয় মণিহারি দোকানের দোকানি।

কেবল এই টুকুই না, আরও কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটল তার জীবনে। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে বাড়ি পাকা করল। তিনখানা ঘর, লাগোয়া রান্নাঘর, আর বাড়ির পিছন দিকে গোসলঘর। তার বৌয়ের বাপের বাড়িতে নাকি এটাই রেওয়াজ। বাড়ির কাজ যে ক’দিন হল, সে ক’দিন বৌ গিয়ে রইল বাপের বাড়ি। পরাণ নিজে হাত লাগাল বাড়ি তৈরির কাজে। এ গাঁয়ের সকলেই অল্পবিস্তর এ সব কাজ জানে। অভাবের সময় কেউ কেউ চলে যায় কলকাতায় কিংবা আরও দূরে। বাড়ি তৈরির কাজ করে কিছু পুঁজি জমলে ফিরে আসে আবার। তবে কেবল বাড়ি নয়, পঞ্চায়েতকে বলে-কয়ে, এর ওর হাতে কিছু কিছু গুঁজে দিয়ে পারমিশন নিয়ে বিলের জলের ধারে একখানা ঘাট মতো বাঁধিয়ে দিল পরাণ। তার বৌ জল ভালোবাসে খুব। তার বাপের বাড়িতে নাকি বাঁধানো ঘাটের বড় পুকুর আছে, তাতে গা ধুয়ে সে নাকি ঘাটে বসে চুল শুকাতো। যদিও গ্রামের কেউই কখনও দিনের বেলায় তার বৌকে ঘাট ব্যবহার করতে দেখেনি। তবে সন্ধেবেলা, উঠতি ছোঁড়াগুলো, যারা বাপ-দাদার সামনে বিড়ি টানতে এখনও শরম করে, কিংবা বোতল টানে, তারা কয়েকজন দেখেছে, আকাশে যেদিন পূর্ণ চাঁদ জেগে ওঠে, সেই রকম দিনে পরান মণ্ডলের বৌ একঢাল এলো চুল মেয়ে সেই ঘাটে এসে অদ্ভুতভাবে বসে আছে। কোনও কোনওদিন সে নাকি বিলের জলে নেমেও যেত, সাঁতার কাটত সেই সময়। পরাণকে বলতে, সে ওদিক পানে ছেলে-ছোকরাদের যাওয়া নিয়ে আপত্তি তুলে বলল, “ওদিকে যাওয়ারই কি দরকার বাপু! মেয়েছেলে সন্ধ্যের সময় ঘাটে বসে থাকে, আর যদি সাঁতার কাটেই বা, তা কি ছেলে-ছোকরাদের লুকিয়ে দেখা উচিত? এ কোন ধরণের ভদ্রতা?” এরপর সে ঘাটের দুধারে হোগলা পাতার বেড়া দিয়ে ঘিরে দিল।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২০: তোমরা যা বলো, তাই বলো…

শম্ভু, শম্ভু, শিব মহাদেব শম্ভু, খুদার ইবাদত যাঁর গলায় তাঁর আর কাকে ভয়?

গাঁয়ের মেয়ে-বৌরা যখন বলত, “তা তোমার বৌ কেমনধারা মেয়েছেলে? এখেনে এল, আমাদের সঙ্গে মেলে না, মিশে না! এত দেমাক কিসের ওর?”
পরাণ সে সব শুনে সাত হাত জিভ কেটে বলত, “ছি ছি! বৌদিদিরা গো, সে একে তো নতুন, তার উপরে ছোটোবেলায় মাকে হারিয়েছে, বাপ সারা সময় তার ট্রলার, জাল এ সব নিয়ে সমুদ্দুরে চলে যেত মাছ ধরতে। বাড়িতে এক হাবা-কালা দাই। আর দু-চারজন কাজের লোক। তা এর মাঝে আমাদের সমাজের আদব-কায়দা, লোক-লৌকিকতা কিছু শেখেনি তেমন। এজন্য সবার সঙ্গে মিশতে তার লজ্জা লাগে। পারেও না। ওকে জোর করো না। দেখ, আস্তে আস্তে যদি সহজ হয় নিজেই কথা বলবে ডেকে ডেকে।”

পাড়ার বৌ-ঝিরা যারা ভেবেছিল, নতুন বৌয়ের সঙ্গে ভাবসাব করবে, এরপর তারা আর আগ্রহ দেখাল না। তারপরেও যে-ক’জন এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল, তারা বলাবলি করতে লাগল, ওসব কিছুই না, বৌয়ের বাপের টাকা আছে। তাই তার খুব দেমাক। অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। গরিব জেলে-মাঝিদের গ্রাম এটা। কারও চালে খড় নেই তো, কারও ঘরের দেওয়াল পড়ো পড়ো। তার মধ্যে পরানের পাকা ঘরখানা আর ঘোমটা টানা বৌ সকলের চোখের সামনে যেন জ্বলজ্বল করতে লাগল।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরাণের বৌ পোয়াতি হল। তার বাবা এসে তাকে নিয়ে গেল। যদিও তাঁকে কেউই দেখেনি। তিনি নাকি সন্ধ্যের সময় এসে খুব ভোর ভোর মেয়েকে নিয়ে গিয়েছেন। অনেক দূরের পথ। বছর খানেক কেউ পরানের বৌ-কে আর ফিরে আসতে দেখল না। তারপর ফিরল বটে, কোলে বাচ্চা নিয়েই ফিরল, কিন্তু সেই বাচ্চাকে দেখে সকলে শিউরে উঠল। জন্ম থেকেই বাচ্চার দুই পা জোড়া। কোমরের নীচ থেকে দুটি পা। সকলে শিউরে উঠল দেখে। ও মা গো! এ বাচ্চা তো পুঁইয়ে পাওয়া। অনেকদিন আগে, সে শ’ দুশ’ বছরও হতে আরে, এ গাঁয়ে নাকি এমন বাচ্চা কয়েকটি জন্মেছিল। আর তারা সব বেশিদিন বাঁচেনি।

পরাণের তাতে হেলদোল ছিল না। সে খানিক বড়ো শহরের হাসপাতালে যোগাযোগ করল। তাও গ্রামের লোকের ঠেলায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে। সেখানে ডাক্তারবাবুরা জানালেন, এ এক বিরল রোগ। আরোগ্যের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরান সেই যে বাচ্চাকে নিয়ে ফিরে এল, আর গেল না দেখা করতে। স্বামী-স্ত্রী মিলেই বাচ্চাটিকে দেখভাল করতে লাগল। অনেকেই দেখেছে, সন্ধ্যের দিকে পরানের বৌকে বাচ্চা নিয়ে বিলের ধারে বসে থাকতে। হারু পাগলা আবার দেখেছে, বৌটি নাকি সেই কোলের বাচ্চাটিকে জলে অর্ধেক শরীর ডুবিয়ে দিতেই বাচ্চাটি খিলখিল করে হেসে উঠত আর তার আপাত অসাড় নীচের অঙ্গটিকে নাকি মাছের মতোই দোলাত এ-পাশ ও-পাশ। কিন্তু হারু পাগল, তার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি সেজন্য।
এরই মাঝে এক আয়লা। সে কি ঝড়, সে কি ঝড় ! সেই সঙ্গে বৃষ্টি। সমুদ্র একেবারে উত্তাল হয়ে উঠল, নদী ছাপিয়ে, বিল উপচে এসে ঘা দিল আরও অনেকের মতো পরানদের গ্রামে। গোটা গ্রাম মুহূর্তে তছনছ করে দিল। বাড়িঘর, লোকের কপাল সব সেই লোনা উন্মত্ত জলই যেন গ্রাস করে নিল। মাটির বাড়ির কমই টিকে রইল, পরান ভাগ্যিস বৌয়ের বাপের টাকায় পাকা বাড়ির গাঁথনি দিয়েছিল। তার বাড়িটা আঘাত সয়েও তাই টিকে ছিল। বেশিরভাগের কপাল অত ভালো ছিল না। দিন পনেরো পরে জল নামতে দেখা গেল, কত মানুষ, পশু যে মরেছে, ভেসে গেছে বানের তোড়ে তার ইয়ত্তা নেই। মাঠের পর মাঠ চাষের জমি লোনা জলে দফারফা। কতকাল যে এখন ফসল ফলবে না কে জানে! পরাণের মণিহারি দোকানটিরও বেশ ক্ষতি হয়েছিল। বেশ কয়েক হাজার টাকার মালপত্র একেবারে বরবাদ। কিন্তু তার অন্য ক্ষতির তুলনায় সে সব কিছুই না। জীবনযাপন আবার আগের মতো চলতে শুরু করলে পর জানা গেল, বানের জলে পরাণের বৌটি ভেসে গিয়েছে। পরাণ বলল, সম্ভবত তার বৌ তখন বিলের ধারে কোন কাজে গিয়েছিল। বানের জল পাহাড়প্রমাণ ফুলে উঠে যখন আছড়ে পড়ে তখন সে আর নিজেকে বাঁচাতে পারে নি। তবে বাচ্চাটি ঘরে উঁচু চৌকির ওপর শুয়ে ছিল, সে বেঁচে গিয়েছে।

সবাই ভেবেছিল, পরাণ বোধহয় মুষড়ে পড়বে। কিন্তু সে সব কিছুই হল না। সে আবার তার মণিহারি দোকান একটু একটু করে সারিয়ে তুলল। নিজেই একা হাতে বাচ্চার দেখভাল ও দোকানের কাজ চালাতে লাগল। বাচ্চাকে সে রোজ নিজের সঙ্গে করে দোকানে নিয়ে আসত। দোকানের পিছনে একটা ঘুপচি মতো ঘরে মাচার উপর বাচ্চা থাকত। লোকে প্রথম প্রথম সহানুভূতি জানালে বিরক্ত হত সে, ফলে একসময় লোকজনও আর বাচ্চাটিকে নিয়ে কিছু বলত না। যার বাচ্চা সেই যখন চায় না, তখন আমাদের আর বেশি দরদে কাজ কী ?

এর মাঝেই একদিন সকলকে অবাক করে দিয়ে পরান আবার বিয়ে করল। পূর্ণিমাকে। তার বাপের বাড়ি অবশ্য মাইল পাঁচেক দূরে। দেখতে শুনতে তেমন ভালো নয় বলে বিয়ে হচ্ছিল না। তার সামনের দাঁতগুলি বড্ড উঁচু, বাইরে বেরিয়ে থাকে। তা থাকুক। দোকান আর ঘর সামলাতে পরাণের বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। বাচ্চার জন্য কষ্ট করাকে সে কষ্ট বলে ভাবে না। কিন্তু অন্য অনেক কিছুর জন্যও তো কাউকে দরকার হয়? আগের বারের মতো লুকিয়ে চুরিয়ে হল না অবশ্য, বেশ লোকজন সঙ্গে নিয়ে ধূমধাম করেই বিয়েটা হল। বৌভাতের দিন পাড়ার সকলে মাংস-ভাত খেল। সঙ্গে দই, মিষ্টি। পরানের সমবয়সী বন্ধুবান্ধব এবং আরও কিছু ছেলে-ছোকরা ভোজ শেষে বোতল নিয়ে মোচ্ছবও করল। এই সব দিনে পরানের বাচ্চাটি শুয়ে শুয়ে সব কিছু দেখল। এখন সে বছর দুয়েকের হয়েছে। খাট-পালঙ্কে শোয়ায় না তাকে পরান। কোথায় কখন পড়ে যাবে। মেঝের উপর বিছানা পাতা। সেখানেই শুয়ে থাকে। কখনও বিচিত্র শব্দ করে উঠে বসতে চায়। বুক ঘষটে ঘষটে চলে। আর থেকে থেকে জল খায়। পরাণ নিজের হাতে তার নোংরা পরিষ্কার করে। বৌভাতের দিনও করেছিল। তারপর পরিয়ে দিয়েছিল ঝলমলে একখানা মাটিতে লুটানো পোশাক।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৬: শ্রীমায়ের সাধনা

পরিযায়ী মন, পর্ব-১১: ঘরের কাছে জলমহল—চাঁদনি জলটুঙ্গি

পরাণের নতুন বউ পূর্ণিমার স্বভাব আগের বৌয়ের চেয়ে বিপরীত। বেশ মিশুকে, পাড়ার লোকের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলে। বাড়িতে কেউ এলে পান-সুপারি দেয়, চা-বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ণ করে। মোটের উপর পাড়ার লোকের সঙ্গে পরাণের সংসারের যে দূরত্ব গড়ে উঠেছিল আগের বৌকে কেন্দ্র করে, পূর্ণিমা সে-সব নিজ গুণে দূর করে দিল। কিন্তু নিজের সংসারের সতীন-বাচ্চার কাঁটাটিকে সে দূর করতে পারল না। বিয়ের আগে পরাণ কিছুই লুকোয়নি। পূর্ণিমার বাপ-দাদারা গরিব, নিজেদের সম্বল বলতে সামান্য ধানি জমি। তা-ও আয়লার পর একেবারে বন্ধ্যা হয়ে পড়ে আছে। পরান তাদের কিছু থোক টাকা দিয়েছিল। বলেছিল, “আমার বাচ্চাকে আমি নিজেই দেখভাল করতে পারব। তার ভার আপনাদের মেয়েকে নিতে হবে না। সে কেবল সংসারের আর পাঁচটা কাজ করবে। আমি একা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি। মেয়ে আপনাদের সুখেই থাকবে।” তা আছেও সুখে পূর্ণিমা। এমনিতে অ-সুখ কিছু নেই। কেবল দু-বেলা নিরামিষ খেতে খেতে সে হাঁপিয়ে ওঠে। পরানের আগের পক্ষ নাকি আমিষ খেত না, সেই থেকে না খেয়ে খেয়ে সে-ও এখন খেতে পারে না। পূর্ণিমা খেলে তার আপত্তি নেই, তবে তার সামনে যেন না খায় আর বাচ্চাকে যেন না দেয়—এই ছিল তার কড়া হুকুম। কিন্তু স্বামী খায় না, রোজ রোজ একার জন্য কে আর মাছ রাঁধে? আস্তে আস্তে বছর ঘরতে না ঘুরতেই পূর্ণিমাও বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠল নিরামিষে। এ-বাড়িতে মাছ ঢোকা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।

কিন্তু যে বাড়িতে মাছ ঢোকে না, সে বাড়ির গিন্নি যদি প্রবেশ দ্বারের সামনে মাছের বড় বড় আঁশ পড়ে থাকতে দেখে, কেমন লাগে? গা গুলিয়ে ওঠে না? পূর্ণিমার এখন তেমনটাই হল। একে বৃহস্পতিবার, গা ধুয়ে মা লক্ষ্মীকে একটু ধূপ-দীপ দেবে, তা না…? এখন আবার নতুন করে নেয়ে, ঘট মেজে, জল ভরে, আম্রপল্লব, দুব্বো ফুল সব জোগাড় করে পূজায় বসতে হবে। মেজাজ একদম খিঁচড়ে গেল তার। আঁশগুলির দিকে তাকাল সে। উদ্‌বেড়ালে এনে ফেলল কি? বেশ বড় বড় আঁশ। দেখেই বোঝা যায়, খুব বড় মাছ না হলে এত বড়ো আঁশ হয় না। এত বড়ো মাছ এ তল্লাটে কোন পুকুরে আছে ? বাপের জন্মে এত বড় আঁশওয়ালা মাছ দেখেনি সে। তবে শুনেছে, গঞ্জের মেলায় অনেক সময় বড়ো বেগুন, আধমনি ফুলকপির সঙ্গে দশ-বিশ কিলো মাছেরও প্রদর্শনী হয়। এ-ও কি তেমন আকারের কোনও মাছ? আনলই বা কে? নাকি বিল থেকে বিড়াল-টিড়াল কেউ ধরে এনে খেয়ে ফেলেছে? ধন্দ কাটে না। হাতের জিনিস একপাশে নামিয়ে মুড়ো ঝাঁটা দিয়ে সব ঝেঁটিয়ে ফেলতে গিয়েই তার চোখ পড়ল ঘরের মধ্যে। একজোড়া ড্যাবডেবে মাছের মতো গোল চোখ মেলে পরান মণ্ডলের আদরের দুলালী দেখছে তার কাণ্ড। ঠোঁটের কোণায় কি একটু হাসি লেগে আছে? তার এমন অবস্থা দেখে বাচ্চাটি মজা পেয়েছে মনে হল পূর্ণিমার। গা জ্বলে উঠল তার। চেঁচিয়ে উঠল, যেন নিজেকেই গাল দিচ্ছে, “ঝাঁটা মারি, ঝাঁটা মারি অমন কপালে। বাড়ি তো নয়, যেন শত্তুরপুরী। দেব একদিন সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে। বুঝবি তখন!”

গালমন্দ শেষ করে পূর্ণিমা ঘরের ভিতর আনে আড়চোখে তাকাল। কিন্তু সেখান থেকে তখন বাচ্চাটি অদৃশ্য হয়েছে। —চলবে।
* গল্প (Short Story) – আঁশ (Aansh) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content