বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


মা সারদা।

শ্রীমার স্নেহ তাঁর সব সন্তানের উপর সমান হলেও তিনি ‘যাকে যেমন তাকে তেমন, যার পেটে যা সয়’—সেই বুঝে ব্যবস্থা করতেন। এই কাজ তিনি এমন সাবধানে ও হুঁশিয়ারির সঙ্গে করেন যাতে তা পরস্পরের ঈর্ষার কারণ না হয়। কোয়ালপাড়া আশ্রমের অন্যতম প্রধান কর্মী রাজেন মহারাজ একদিন শ্রীমার বাড়িতে এসে তাঁকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে বলেন যে তার কাশী যাবার ইচ্ছা, এখানে আশ্রমে তার ভাল লাগছে না। কারণটাও জানালেন যে আশ্রমে মনোমালিন্য চলছে, আর তার শরীরও ভাল যাচ্ছে না। এই বিষয়ে সে শ্রীমার অনুমতি ও আশীর্বাদ চাইছেন। মা সারদা তাকে অন্য কোথাও যেতে না দিয়ে জয়রামবাটি এসে কিছু সময় তাঁর কাছে থাকতে বলেন। শুনে রাজেন মহারাজের মন খুশিতে ভরে গেল।
কয়েকদিন পরেই তিনি শ্রীমার বাড়ি এসে বাস করতে লাগলেন। তিনি খুব কাজের মানুষ, সরলপ্রাণ এবং নিষ্ঠাবান ভক্ত। তাঁর থাকার জন্য শ্রীমার বাড়ির কাজেরও নানারকম সুবিধা হল। সেই সময় আর একজন ভক্ত শ্রীমার বাড়িতে থেকে সব কাজের দেখাশোনা করত। রাজেন মহারাজের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। দুই বন্ধু মিলে পরমানন্দে একসঙ্গে বাস করতে লাগলেন। মা সারদা রোজ সকালে ঠাকুরের পুজোর পর প্রসাদী মিশ্রির সরবৎ নিজে একটু খেতেন, যা তাঁর বরাবরের অভ্যাস। স্বাস্থ্যের কারণে পিত্তরক্ষার জন্য এটি বিশেষ প্রয়োজনীয়। পুজোর শেষে এটুকু মুখে দিয়ে শ্রীমা আগে সন্তান-ভক্তদের জলখাবার খাওয়াতেন। তাঁর মধুর আহ্বানে ভক্তদের মন ব্যাকুল হয়ে উঠত, ‘বাবা, বেলা হয়েছে, জল খাবে এসো’। তাঁর বারান্দায় আসন বিছিয়ে জলের গ্লাস ও কাঁসিতে গুড়মুড়ি, পাতায় ফল, প্রসাদী মিষ্টি রেখে দরজার দিকে সস্নেহে ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছেন, ‘বাছুরের অপেক্ষায় গাভীর ন্যায়’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৬: বৎসল্যরসে মা সারদা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি

ছেলেদের খাওয়া হয়ে গেলে শ্রীমা মেয়েদের খেতে দিয়ে তাদের সঙ্গে নিজেও একটু খেতেন। ভক্তদের আনা ফলমিষ্টি শ্রীমা সামান্যই মুখে দিতেন, সেসব অন্যেরাই পেত। ইদানীং তাঁর দাঁত গেছে, চারটি মুড়িই জল খাওয়া, তাও চিবোতে পারেন না। তাই আঁচলে মুড়ি নিয়ে একটা নোড়া দিয়ে সেগুলো গুঁড়ো করে নবাসনের বৌকে ডেকে বলেন, ‘বৌমা, দাও তো একটু নুন, লঙ্কা’। রাজেন মহারাজ আর অন্য ছেলেটি কাছে থাকলে তাদের সঙ্গে অন্যান্য ছেলেরাও প্রায় একসঙ্গে বসে মুড়ি বা ভাত খায়, আনন্দে গল্পগুজব করে, তবে কাজের জন্য কখনও এর ব্যতিক্রম হলে আলাদা খেতে হয়। নাহলে সবাই আনন্দে একসঙ্গেই খায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৪: পরবর্তী পদক্ষেপ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’

কিছুদিন পর শ্রীমা একদিন অন্য সন্তানটিকে আড়ালে একলা পেয়ে বললেন, ‘বাবা, রাজেনের মাথাটা একটু গরম হয়েছে, আশ্রমে আগুনের তাপে রান্না করে। আশ্রমে তার বনিবনাও হচ্ছিল না, শরীরটাও খারাপ হয়েছে। সেখানে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি, কাশী চলে যেতে চাইছিল, এখানে এসেছিল বিদায় নিতে। বলে কয়ে রেখেছি, কিছুকাল এখানে থাকলে মাথাটা ঠাণ্ডা হবে। শরীর একটু ভাল হলে আবার আশ্রমে গিয়ে কাজকর্ম ঠিক করতে পারবে। রোজ সকালে প্রসাদী সরবৎ একটু দিই, তাহলে দেহটা ঠাণ্ডা থাকবে’।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

মা সারদা তাঁর স্নেহসিক্ত কাতর স্বরে এমনভাবে বললেন যে শুনে ভক্তের মনও বিগলিত হল। আর রাজেন মহারাজের প্রতি সহানুভুতিতে ভরে গেল। সেই ভক্তটি একসঙ্গে থেকেও এই কয়দিন জানতেই পারেননি যে, রোজ শ্রীমা পুজোর শেষে রাজেন মহারাজকে স্বয়ং ঘরের ভেতর ডেকে মিশ্রির সরবৎ খাওয়াতেন। অন্য কেউই টের পায়নি। পরে সেই ভক্ত লক্ষ্য করেন যে, শ্রীমা রাজেনকে ঘরের ভেতর ডেকে নিয়ে নিজে একটু সরবৎ মুখে দিয়েই রাজেনের মুখের কাছে সরবতের বাটি ধরলেন। আর রাজেন মহারাজও তখনই সেই প্রসাদী সরবৎ পান করে বাটিটা ধুয়ে এনে যথাস্থানে রেখে বেরিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর

অপর সন্তান শ্রীমার মমতা দেখে খুব মুগ্ধ হলেন আর শ্রীমার সরবৎ কম করে খাওয়া তাঁর মনোমতো না হলেও আর প্রতিবাদ করলেন না। তাঁর মনে এই নিয়ে যাতে কোন দ্বিধাভাব না আসে, তাই মা সারদা নিজেই বলে তাঁর মন ঠিক করে দিলেন। রাজেন মহারাজের কঠোরস্বভাব হলেও শ্রীমার প্রতি অপরিসীম ভক্তিমান ছিলেন। তিনিও সহজে সরবৎ খেতে রাজী হননি। তবে খাওয়ার ব্যাপারে মা সারদার নির্দেশ আর তাঁর মমতার হাত কেউই এড়াতে পারেননি। রাজেন মহারাজও পারেননি। তিনি দুই মাসের বেশি থেকে খানিকটা সুস্থসবল হয়ে আবার কোয়ালপাড়া আশ্রমে ফিরে কাজের গুরুভার গ্রহণ করেছিলেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content