বুধবার ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪


মা সারদা।

মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য মা সারদা যেমন তৎকালীন সমাজের নিয়মের বাইরে গিয়ে দুর্গাপুরীকে ইংরেজি শিখতে পাঠান, বা ভবিষ্যতের সারদা মঠের প্রথম অধ্যক্ষা প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণাকে ধাত্রীবিদ্যা শিখতে পাঠান। তেমনই তিনি বিধিবদ্ধ শিক্ষার বাইরে নান্দনিক শিক্ষাকেও সমান উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গীতে অনুরাগের কথা আগেই বলা হয়েছে, বাংলার নাট্যমঞ্চও তাঁর আশীর্বাদ পেয়েছে। একদা যেমন এই বাংলার রঙ্গভূমি ঠাকুরের কৃপা ও তাঁর পদধূলিস্পর্শে ধন্য হয়েছিল। ঠিক তেমনই মা সারদাও তাঁর স্নেহস্পর্শ থেকে বঞ্চিত করেননি নাট্যশিল্পকে। আর তাই দেখা যায় যে ঠাকুরের তিরোভাবের পরও গিরীশ ঘোষ থেকে শুরু করে তখনকার নাট্যজগতের অনেকেই আসতেন সারদা মায়ের কাছে। শুধু তাই নয়, তাঁরা শ্রীমাকে থিয়েটার দেখার জন্য অনুরোধও করতেন। তাঁদের কথায় শ্রীমাও থিয়েটার দেখতে রাজি হয়ে যেতেন।
নাটকের কাহিনি যদি ধর্মমূলক হত, তবে শ্রীমা খুশি হতেন। এমনকি, সেইরকম নাটক দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে তিনিও ঠাকুরের মতো সমাধিস্থ হয়ে যেতেন। তেমনই ঘটেছিল গিরীশচন্দ্রের চৈতন্যলীলা নাটক দেখতে দেখতে। তিনি গিরীশ ঘোষের অনুরোধে মিনার্ভা থিয়েটারে তাঁর ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটক দেখতে গিয়েছেন। আর ‘কালাপাহাড়’ নাটক দেখেছেন মনোমোহন থিয়েটারে। শতবর্ষ পার করা এই থিয়েটার হলগুলো যে শ্রীমার পূত পদস্পর্শে ধন্য হয়েছিল, তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। তিনি গিরীশ ঘোষের ‘পাণ্ডববিজয়’ নাটকটিও দেখতে যান।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

মুভি রিভিউ: মহারাজা—নিথিলন, বিজয় ও অনুরাগ একযোগে থাপ্পড় মেরেছেন উগ্র পৌরুষের গালে

বেলুড়মঠে আয়োজিত ‘জনা ও অশ্বমেধযজ্ঞ’ নাটক দেখতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদের অনুরোধে মা সারদা শরৎ মহারাজকে নিয়ে ‘কিন্নরী’ নাটকটি দেখতে যান। আর ‘কুমারী’ দেখেন রয়েল বেঙ্গল থিয়েটারে। অপরেশচন্দ্রের অনুরোধে তিনি মিনার্ভায় ‘রামানুজ’ দেখতে যান। আর এই পালা দেখতে দেখতে তিনি সমাধিস্থ হয়ে যান। তখনকার সমাজের অনেক পতিতা অভিনেত্রীও শ্রীমার স্নেহ পেয়ে তাঁর কাছে ছুটে আসত। যেমন ঠাকুরের স্নেহস্পর্শে বিনোদিনী ধন্য হয়েছিলেন। তেমনভাবে ভাদের নিজের সন্তানের মতো মা সারদা কোলের কাছে টেনে নিয়ে আদর করতেন। আর শ্রীমার আদরে সিঞ্চিত হয়ে সেই দুঃখিনী মেয়েরাও ধন্য হয়ে যেত।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭২: বনবাসজীবনে প্রকৃতির প্রভাব কি রামের দুঃখকে মুছে দিয়েছিল?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়

এই বিষয়ে অপরেশচন্দ্রের লেখা থেকে জানা যায়, “রামকৃষ্ণ-ভক্তজননী মা আমার, এই দেশের রঙ্গালয়ের কোনও পতিতা অভিনেত্রীকে কোলে করে দেখিয়ে গিয়েছেন, ভগবানের দয়া কাঁটাগাছকেও বাছে না, সে দয়ার পাত্রপাত্রী নেই, সে দয়া বিচার করে না, ব্যবহারিক জগতের কোনো বিধিনিষেধ মানেনি। সে কেবল জাতি নির্বিচারে সকলকে পবিত্র করে নেয়”।

মা সারদার বাগবাজারের বাড়িতেও মাঝে মাঝে থিয়েটারের আসর বসত। সেই আসরে বলরাম ঘোষের স্ত্রী, শ্রীম’-র গৃহিণী, গোলাপমা, গোপালের মা, গৌরীমা প্রমুখ শ্রীমা ও ঠাকুরের মহিলা ভক্তরা উপস্থিত থেকে অভিনয় উপভোগ করতেন মা সারদার সঙ্গে। সেখানে শ্রীমার ভক্ত মেয়েরাই অভিনয় করত। বৃন্দার পালাকীর্তন জাতীয় অনুষ্ঠান এই আসরে হত। এমনকি ভগিনী নিবেদিতা পর্যন্ত নানা রকম পোশাকে সেজে এই সব অভিনয়ে অংশ নিতে নামতেন। আর তাই দেখে মা সারদা আনন্দে হেসে গড়াগড়ি যেতেন। মা সারদার সময়ে নির্বাক ছবির যুগ শুরু হয়েছে। সারদা মা এতটাই আধুনিক ছিলেন যে, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের হলে গিয়ে তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী’ নামে একটি নির্বাক ছবিও দেখেছিলেন।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

মা সারদা নিজের ভাইয়ের মেয়েদের সাধারণ লেখাপড়া শিখিয়ে ছিলেন। তাদের দিয়ে ধর্মগ্রন্থ পড়িয়ে শুনতেন, চিঠির উত্তর লেখাতেন। যেসব বিদুষী মহিলারা উচ্চ আদর্শে জীবনযাপন করতেন, তারা শ্রীমার স্নেহের পাত্রী ছিলেন। এবিষয়ে কোয়ালপাড়ায় স্ত্রীশিক্ষা প্রসঙ্গে তাঁর কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “এদেশের মেয়েরা সব পশুর মতন দেকচি। আমার এক এক সময় ইচ্ছা হয়, এদের শেখাবার ব্যবস্থা করি, কিন্তু করি কি করে? শেখাবার লোক আনতে গেলে পূর্ববঙ্গ থেকে আনতে হয়। তাতে হিতে বিপরীত ফল হবে। মানুষের স্বভাব এই যে, তারা মন্দটা আগে শেখে। তাদের অনেক সদগুণ আছে, সেসব নিতে পারবে না, বাবুয়ানাটি আগে নেবে। আহা, এদেশের মেয়েও সেরকম যদি শিক্ষিত হয়”।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

সেলাই-বোনাই শিল্পকর্মে মা সারদা উৎসাহ দিতেন। তিনি নিজে তাঁর প্রয়োজনীয় সেলাইয়ের কাজ নিজহাতে করতেন। কেউ যদি শ্রীমাকে দেবার জন্য আসন, দেবতার প্রতিকৃতি প্রভৃতি নিজের হাতে সেলাই করে নিয়ে যেত, তা দেখে তিনি খুব আনন্দিত হতেন। আর প্রশংসা করে তা সকলকে দেখাতেন। শ্রীমার ভক্ত প্রফুল্লমুখী বসু কার্পেটে উলের মন্দির তৈরি করেছিলেন তাতে ঠাকুর, শ্রীমা ও স্বামীজির সাতখানা ছবি বসানো ছিল। শ্রীমা সেটি হাতে নিয়ে বলতে লাগলেন, “পূর্ববঙ্গের মেয়েরা বড় গুণী, বড় ভক্ত। কি চমৎকার সব তারা তৈরি করে”।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content