বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

শূর্পণখার বিষতুল্য বক্তব্য, তার বিদ্রূপবাক্য লঙ্কেশ্বর রাবণের মনের গভীরে নাড়া দিয়েছে। উপরন্তু রামচন্দ্রের চন্দ্রাননা পত্নী সীতাকে লাভ করার প্রলোভন তাঁকে অস্থির করে তুলল। রাবণ সচিবদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় পরামর্শ করে সীতাকে হরণ করে নিয়ে আসার দোষ-গুণ, সামর্থ্য-অসামর্থ্য বিবেচনা করলেন। অবশেষে স্থির করলেন, সীতাকে হরণ করে নিয়ে আসবেন তিনি।

কিন্তু কাজটি যে খুব সহজসাধ্য নয়, সে ধারণা তাঁর ছিল। রাবণ গোপনে যানগৃহে গেলেন। বেছে নিলেন দ্রুতগামী স্বর্ণভূষিত অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত, পতাকা শোভিত স্বর্ণময় এক রথ। পিশাচমুখ অশ্বতর বাহিত সে রথ মহাশক্তিশালী, ইচ্ছামতো চলতে পারে। সেই সোনার রথে সোনার অলঙ্কারে সুসজ্জিত দশানন পাড়ি দিলেন সাগরতীরে। তাঁর ঘননীল দেহে সেসব অলঙ্কার যেন বর্ষার মেঘে সাদা বকের মতো শোভা পাচ্ছিল। সাগরতীরে নারকেল গাছের সারি, কদলী, শাল, তাল, হেঁতাল, অর্জুন, প্রিয়ক… আরও কত বৃক্ষরাজির শোভা। সেখানে কত নদী এসে মিশেছে অকূল পারাবারে। গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায়, নদীর মিষ্টি জলের তীরে তীরে কত বড় বড় আশ্রম। সেখানে তপস্যায় মগ্ন মহর্ষিরা। তপোবলে দিব্যলোকজয়ী গন্ধর্ব, কিন্নর, সিদ্ধপুরুষদেরও বাস সেখানে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে দিব্য অপ্সরাদের অপার্থিব গীতমাধুরী।

রাবণ দেখতে পেলেন সাগরতীরে রত্নব্যবসায়ীরা স্তুপীকৃত করে রেখেছেন, শঙ্খ, বৈদুর্য, মুক্তা, প্রবাল, আরো কতশত মণিমুক্তারাশি। পথে দেখলেন অগুরু, তমাল বৃক্ষের গভীর অরণ্য। ঘ্রাণে উপলব্ধি করলেন চন্দনের বনে বাতাসে বইছে সুবাস। এভাবেই দশানন পার হয়ে গেলেন পুণ্যকর্মা ঋষি সিন্ধুরাজের আশ্রম, পার হলেন শতযোজন বিস্তৃত প্রসিদ্ধ বটবৃক্ষ সুচন্দ্রকে। এই বটবৃক্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গরুড়ের স্মৃতি।
অবশেষে সাগর পার হয়ে রাবণ এলেন নির্জন বনপ্রদেশে অবস্থিত মারীচের আশ্রমে। সেই মারীচ, যার পিতা যক্ষ সুন্দ, মা ছিল যক্ষী তাড়কা। জন্মসুত্রে যক্ষ হয়েও ঋষিশাপে অভিশপ্ত রাক্ষস জীবন ভোগ করতে হয় তাড়কা আর মারীচকে। বিশ্বামিত্রের নির্দেশে ঋষিদের যজ্ঞনাশিনী রাক্ষসী তাড়কার মৃত্যু হয় কিশোর রামের হাতে। রাতের অন্ধকারে যজ্ঞবেদীর চারপাশে মারীচ আর অন্যান্য রাক্ষসেরা যখন নিক্ষেপ করছে মাংসের টুকরো, রক্তে ভরে যাচ্ছে যজ্ঞবেদী, রামের হাতে জ্বলে উঠেছে তখন মানবাস্ত্র। মাতৃহারা মারীচকে হত্যা করতে চাননি রাম। কিন্তু তাকে নিক্ষেপ করছিলেন দূরে, সমুদ্রপারে। হতভাগ্য মারীচের রূপান্তরিত জীবনের পুনরায় রূপান্তর হয় যেন এই ঘটনার প্রেক্ষিতে। সমুদ্রতীরে অরণ্যের মাঝে একলাই কুটির বাঁধলো মারীচ। পরণে তার কৃষ্ণমৃগচর্ম, মাথায় জটা। তপস্বীর জীবন কাটায় সে দীর্ঘকাল ধরে। রামের প্রতি তার অগাধ ভক্তিভাব। সমস্ত অরণ্যদেশে গাছে গাছে সে দেখে রামের কৃষ্ণাজিনধারী রামমূর্তি। একই সত্তায় কত বিচিত্র ভাববিবর্তন মারীচের জীবন জুড়ে।

এ হেন সন্ন্যাসী মারীচের কাছে রাবণ এলেন তাঁর অভিসন্ধি নিয়ে। তাঁকে দেখতে পেয়ে মারীচ ভাবছে, রাক্ষসরাজ এখানে, এসময়ে এলেন কেন? রাবণ শূর্পণখার বৃত্তান্ত খুলে বললেন মারীচকে। মারীচের অমিত বিক্রমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে সাহায্য চাইলেন তার কাছে। — “আমি রামকে বধ করবো মারীচ। এ কাজে তোমার তুল্য বলশালী, বুদ্ধিমান সঙ্গী আর তো কাউকে দেখি না আমি। তুমি আমার এ প্রার্থনা রেখো। জনস্থানে আমাদের সব পরাক্রমী বীর সৈন্যরা নিহত হয়েছে। তাদের হত্যাকারী সেই অধম ক্ষত্রিয়, নীচস্বভাব, মূর্খ, লোভী ইন্দ্রিয়পরায়ণ রাম। সে অধর্মপরায়ণ। অকারণে আমার ভগ্নী শুর্পণখার অঙ্গচ্ছেদন করে সে বিকৃত করে দিয়েছে। মারীচ, আমি শুনেছি, রামের স্ত্রী সীতা অত্যন্ত সুন্দরী, যেন পদ্মহীনা লক্ষ্মী! আমি জনস্থানে গিয়ে তাকে বলপূর্বক নিয়ে আসতে চাই। তুমি আমার এ কাজে সহায় হও।”
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৮: অভীষ্ট লাভ নাকি আত্মবিনাশ — লঙ্কাধিপতি কোনটি বেছে নিলেন?

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-১: কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়…

রাবণ এ অনুরোধ করেই শেষ করলেন না তাঁর বক্তব্য। তিনি যে ছলনার বশে সীতাকে হরণ করবেন, সেই চক্রান্তও সবিস্তারে বললেন মারীচকে। —“মারীচ, এখন কি করণীয়, সেটা শোনো। তুমি হলে মায়াবিশারদ। তার উপর ইন্দ্রিয়জয়ী তপস্বী। তুমি জনস্থানে রামের আশ্রমের কাছে গিয়ে এক সোনার হরিণের রূপ ধারণ করবে। আশ্চর্য সেই মায়াবী হরিণের সারা গায়ে থাকবে রূপোর মতো বিন্দু। তুমি তারপর আশ্রমের বাইরে কিন্তু সীতার চোখের সামনে গিয়ে চরতে থাকবে। এমন সুন্দর হরিণ দেখে সীতা নিশ্চয়ই রাম-লক্ষ্মণকে বলবে সেটি ধরে দেওয়ার জন্য। রাম লক্ষ্মণ হরিণটিকে ধরতে চলে গেলে আমি সেই সুযোগে সীতাকে ধরে নিয়ে আসব। তুমি তো শীঘ্রগতি পুরুষ। কাজের গুরুত্ব আর পরিস্থিতি বুঝে তুমি সেই স্থান থেকে তারপর পালিয়ে যাবে। এরপর প্রিয় পত্নীর বিচ্ছেদে রাম অনাহারে দুর্বল হয়ে যাবে। আমি তাকে তখন অনায়াসে বধ করব।”

রাবণের পরিকল্পনা শুনে মারীচের বুক দুরুদুরু করতে লাগল, ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল। রামের পরাক্রমের অতীত কাহিনি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। রাবণের দিকে উদ্ভ্রান্তদৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাতজোড় করে শেষে সে বলল—“মহারাজ, চারপাশে এমন অনেক লোক আছে, যারা সব সময় প্রিয় কথা বলে, কিন্তু তারা হিতৈষী নয়। আবার এমন অনেক লোক আছে, যারা অপ্রিয় কিন্তু হিতকর বাক্য বলে। অপ্রিয় বাক্যের বক্তা এবং শ্রোতা দুইই দুর্লভ। শুনতে অপ্রিয় হলেও, আপনি চপল স্বভাব এবং রাজ্যের অবস্থা জানার জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করেননি, এটা সত্য। ঠিক এ কারণে দেবরাজ ইন্দ্রের মতো পরাক্রমী রামচন্দ্রের বিক্রম সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণা নেই। তাই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে চাইছেন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”

স্বাদে-আহ্লাদে: গরমের দিনে বাড়িতে হঠাৎ অতিথি এসেছে? গলা ভেজাতে তৈরি করে ফেলুন ম্যাংগো মোজিতো

রাজন এর ফলে পৃথিবী রাক্ষসশূন্য হয়ে যাবে না তো? আর, আপনি সীতাকে হরণ করতে চাইছেন? তিনি মহাতেজস্বিনী নারী, রামের প্রাণাধিক প্রিয়। সূর্যের তেজ কি কখনও হরণ করা যায়? তাঁর সর্বনাশ করলে আপনার মহা বিপদ এসে উপস্থিত হবে না তো? আপনার বংশ, আপনার পুত্র, প্রিয় লঙ্কানগরী, আশ্রিত প্রজারা—সকলে রক্ষা পাবে তো? এ ভাবেই তো দুর্মতি, পাপাচারী রাজারা নিজেদের ধন, মান, প্রাণ, প্রজা—সবই বিনষ্ট করে। আপনিও সে পথেই চলতে চাইছেন? আর রামের সম্বন্ধে আপনার যে ধারণা, তা সঠিক তো নয়ই, বরং সর্বৈব মিথ্যা। তিনি মহাত্মা, ধীমান, যশস্বী।

তিনি ধর্মাত্মা, জিতেন্দ্রিয়, বিদ্বান। সকল জীবের ক্ষতি সাধনে তাঁর রুচি নেই। আমি অল্পবয়স্ক রামের প্রবল প্রতাপ দেখেছিলাম। সে কথা আমি আজও ভুলিনি। আমি আজও বৃক্ষে বৃক্ষে সহস্র সহস্র চীরবসনধারী পাশহস্ত, রামের মূর্তি দেখতে পাই, সমস্ত অরণ্য রামময় মনে হয়। আমার অন্তর প্রাণভয়ে আজও কেঁপে ওঠে। রকারাদি শব্দ শুনলে আমি ভয়ে চমকে উঠি। আপনাকে হিতার্থী হয়ে বলছি, আপনি এ কাজ করলে সবংশে নিহত হবেন। আর আমাকেও যদি জীবিত দেখতে চান, তাহলে, আমার সামনে রামের প্রসঙ্গই তুলবেন না।”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৩: বায়োপসি মানেই ক্যানসার?

মৃত্যুপথযাত্রীর ওষুধের প্রতি তীব্র অনীহা জন্মায়। রাবণের বোধহয় তাই হল। মারীচের হিতবাক্য শুনেও তাতে কর্ণপাত করলেন না তিনি। বরং মারীচের প্রতি বিরক্ত, ক্ষুব্ধ হয়ে কঠোর বাক্যে বললেন, “শোনো মারীচ, তোমার কথা মরুভূমিতে বপন করা বীজের মতো নিষ্ফল। এই সংকল্প থেকে কেউ আমাকে সরাতে পারবে না। আমি তো তোমাকে পরামর্শ দিতে বলিনি। কৃতসংকল্প কাজে তোমার সাহায্য চেয়েছি। তোমাকে এ কাজের বিনিময়ে আমার অর্ধেক রাজত্ব দেব। কিন্তু যদি সাহায্য না করো, তাহলে এখনই বধ করবো তোমাকে।”

মারীচ এখন নির্ভয়। সে দ্বিধাহীন কণ্ঠে আবার স্মরণ করিয়ে দিল, এ কাজের ফল, নিশ্চিত মৃত্যু, সবংশে বিনাশ। রাবণের কথায় অসম্মত হলে তার মৃত্যু নিশ্চিত জেনে এবার মারীচ সিদ্ধান্ত নিল এ কাজে রাবণকে সাহায্য করবে সে। কিন্তু সে একথাও জানে, এ ছলনার ফল স্বরূপ রামের হাতেই তার মৃত্যু অপেক্ষায় আছে। সে মৃত্যু শ্রেয়তর জেনে মারীচ এগিয়ে গেল মৃত্যুপথ ধরেই।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content