বুধবার ২৭ নভেম্বর, ২০২৪


অযোধ্যাপতি দশরথ — কত মহিমা তাঁর, কত প্রতাপ, দিকে দিকে যশোগাথা প্রচারিত। আজ বুঝি সবই বৃথা মনে হয়। বড় করুণ, অসহায় দৃষ্টিতে রানি কৈকেয়ীর কৃপাপ্রার্থী পৃথিবীপতি। সত্যপ্রতিজ্ঞা যেন আজ পাষাণের মতো চেপে ধরেছে তাঁর শ্বাস। সত্য নয়, সে যে আজ কঠিন লৌহশৃঙ্খল। পাষাণী কৈকেয়ীর পায়ে মাথা কুটছেন রাজা সত্যপাশ থেকে মুক্তির আশায়। প্রিয়পুত্র রাম, তাকে কোন গহন বনে নির্বাসনে পাঠাবেন তিনি! তার চেয়ে যে নিজের মৃত্যুও অনেক বেশি কাম্য ! শোকে দুঃখে সেই মৃত্যুই কামনা করতে লাগলেন রাজা।

কৈকেয়ীর পাষাণহৃদয় এতেও টলল না। বরং বাক্যবাণের তীব্রতা গেল বেড়ে — “এ কী মহারাজ! আপনি নিজে প্রতিজ্ঞা করে নিজেই অনুতপ্ত? সত্যে অবস্থান করা তো আপনার কর্তব্য! সত্যই তো পরম ধর্ম। আপনার মতো মানুষই তো তাকে রক্ষা করবে। ভেবে দেখুন, শিবি রাজা সত্যরক্ষার জন্য নিজের শরীরের মাংস কেটে শ্যেন পাখিকে দিয়েছিলেন। কিংবা রাজা অলর্ক! নিজের সত্য রক্ষার জন্য দুই চোখ উৎপাটন করে দিয়েছিলেন এক ব্রাহ্মণকে। আর আপনি! সত্য প্রতিজ্ঞা করে এমন কাপুরুষের মতো আচরণ করছেন। আপনি যদি নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করেন, তাহলে আমি আপনার সামনে আত্মহত্যা করব।”

এবার রাজার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তাঁর মনের সুস্থিতি একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়ে যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ওঠানামা চলছে। এ ছলনার পাকে তিনি যে একেবারে বাঁধা পড়ে গেলেন— মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই। “কৈকেয়ি, আমি কোন মোহের বশে তোমার পাণিগ্রহণ করেছিলাম? পাপীয়সী, আমি তো ফুলের মালা ভেবে গলায় ফাঁসির দড়ি পরেছি—এত স্বার্থপরতা, এত শঠতা তোমার মনে ছিল?! আমি এই মুহূর্তেই তোমাকে ত্যাগ করলাম কৈকেয়ি। আর তোমার এই অন্যায় কাজের জন্য ভরতকেও ত্যাগ করলাম।” শোকে বিলাপে রাত কেটে গেল। কৈকেয়ী নিজের সিদ্ধান্তে অচল। দশরথ শোকাচ্ছন্ন, বিহ্বল।
আঁধারপুরীতে ভোর হল। অভিষেকের পুণ্যলগ্ন চলে এল কাছে। রাজা এখনও এলেন না রাজসভায়। এমন আনন্দের দিনে এখনও ঘুম ভাঙেনি কি তাঁর? বিশ্বস্ত সুমন্ত্র এলেন কৈকেয়ীর পুরীতে। রাজপুরীতে সর্বত্র অবারিত যাতায়াত তাঁর। এসে বন্দনা করলেন রাজার। নিজের স্তুতিবাক্য যেন তপ্ত শলাকা হয়ে মর্মমূলে পৌঁছল রাজার। আর্তস্বরে বললেন, ”সুমন্ত্র, আমি সত্যপাশে বদ্ধ, দুঃখে পীড়িত। তুমি রামকে ডেকে নিয়ে এসো। আমি তাকে এখানে দেখতে চাইছি।” রাজার আদেশেও সন্তুষ্ট হতে পারলেন না কৈকেয়ী। নিজেই আদেশ দিলেন, যত শীঘ্র সম্ভব রামকে রাজার সামনে নিয়ে আসার জন্য।

সূর্য উদয়াচলে উদ্ভাসিত। পুষ্যা নক্ষত্রের সঙ্গে চাঁদের যোগে অভিষেকের পুণ্য লগ্ন। অভিষেকের এমন পুণ্যসময় যে চলে যায়। রাজদ্বারে অপেক্ষায় প্রধান মন্ত্রিগণ, রাজপুরোহিত, শতসহস্র পুরবাসী। রাজার নির্দেশে অভিষেকের সমস্ত দ্রব্য নিয়ে এসেছেন তাঁরা। আনা হয়েছে যত পুণ্যতোয়া নদ-নদী, তাদের জল, আনা হয়েছে সাত সমুদ্রের জল। সে জলে অভিষেকস্নান করবেন কৌশল্যানন্দন। দ্বারে দ্বারে সাজানো মঙ্গল ঘট, অশ্বত্থপল্লবের মাঝে বিকশিত পদ্মের শোভা তাতে। অভিষেকস্থলে এনে রাখা হয়েছে সিংহচর্মে আবৃত সোনার সিংহাসন, মণিমাণিক্যের কারুকাজ তার গায়ে। যুবরাজ বসবেন সেই মঙ্গল-আসনে। মাথার উপর পুষ্পমালায় সেজে উঠেছে বাহারি চাঁদোয়া, যেন জ্যোৎস্না-আলোয় উজ্জ্বল পূর্ণচাঁদের মায়া বিছিয়ে আছে আকাশ জুড়ে। ইক্ষ্বাকুকুলের উপযুক্ত আর সব সামগ্রী— সবই প্রস্তুত। পুরোহিতরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন সুমন্ত্রকে দেখতে পেয়ে। মহারাজ এখনও কি প্রস্তুত নন?
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২২: সত্যের শৃঙ্খলে বন্দি রাজা দশরথ

নিত্যদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি? আপনার সন্তানের উপরে এর প্রভাব কেমন পড়ে?

উৎসব শেষে ত্বক-চুলে ক্লান্তির ছাপ? ঘরোয়া উপায়ে ফিরিয়ে আনুন জেল্লা

ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৬: গাড়ির সান রুফ খুলে চালিয়ে দিলাম ‘সুহানা সফর হ্যায় ইয়ে মৌসম হাসি, হামে ডর হ্যায় কে…’

সুমন্ত্র আবার ফিরে যান রাজার কাছে। আবার ব্যথিত, চিন্তিত কণ্ঠে উচ্চারিত হয় —রাম… রাম…। বাক্যটুকু উচ্চারণের ক্ষমতাও আজ রাজা হারিয়ে ফেলেছেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন কৈকেয়ী —“সুমন্ত্র, রাজা রামের অভিষেকের আনন্দে সারা রাত জেগেছিলেন, আজ খুব পরিশ্রান্ত তিনি। তুমি বরং রামকে তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে এসো।” মিথ্যা কি এমন নিষ্ঠুরতার আবরণে ঢাকা থাকে? তাতে কি এভাবেই লুকানো থাকে শাণিত তরবারির তীক্ষ্ণ ফলা?
“কিন্তু রানীমা, মহারাজের আদেশ না পেলে যাই কি করে?” সুমন্ত্র নিজ কর্তব্যবোধে অবিচল। পেলেন আদেশ। রামকে নিয়ে আসার আদেশ নাকি আর্তি এল সুমন্ত্রর কানে। আর দেরি করলেন না সুমন্ত্র। ছোটালেন রথ রামের প্রাসাদের পথে। রাজপথে জনসমুদ্র, তারই মাঝে পথ করে নিতে নিতে চিন্তার ঢেউ গ্রাস করল ক্রমশ তাঁকে।

রাম এলেন কৈকেয়ীর ভবনে সুমন্ত্রের রথে। পার হয়ে এলেন দর্শনপ্রত্যাশী, আনন্দে উদ্বেল প্রজাদের কলোচ্ছ্বাস। কৈকেয়ীর ভবনে বাইরের এই উৎসুক জনতার আনন্দের লেশটুকুও নেই। রাজা সেখানে আসনে বসে আছেন, উদ্ভ্রান্তমুখে। তাঁর চোখের কোণে জল, মুখ ঢেকেছে বিষাদের ঘন কালো মেঘ। কী হয়েছে পিতার? রামের মনে সহসা মেঘ ঘনিয়ে আসে। এগিয়ে এসে প্রণাম করেন পিতা ও বিমাতাকে। দশরথের মুখে বড় কষ্টে শুধু অস্ফুট উচ্চারণ ধ্বনিত হয় —‘রাম!’ পিতার বিষণ্ণ, শোকাকুল দৃষ্টি রামকে ব্যথিত করে তোলে। মনে হয়, সূর্যদেব যেন আজ রাহুর গ্রাসে ম্লান।
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ: Types of Sentences কাকে বলে জান কি?

রান্নায় বেশি নুন দিয়ে ফেলেছেন? সামাল দেবেন কোন উপায়ে?

গৃহসজ্জা: দেওয়ালের রঙের উপর নির্ভর করে বাড়ির শান্তি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৬: শারদীয় সংখ্যায় লিখে পাওয়া অর্থ বন্যাপীড়িত মানুষের কল্যাণে

“দেবি, আমি কি অজ্ঞানতাবশে মহারাজের কাছে কোনও অন্যায় করে ফেলেছি? কোন অপরাধে তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন না? কোনও শারীরিক বা মানসিক পীড়ায় তিনি আক্রান্ত হননি তো? আচ্ছা, ভরত, শত্রুঘ্ন — এরা সব কুশলে আছে? আমার মায়েদের কোনো অমঙ্গল হয়নি তো? আপনি আমাকে বলুন দেবি, কী হয়েছে? পিতার কোনও অসন্তুষ্টি থাকলে আমি কোনও কাজে অগ্রসর হতে পারবো না। আমার কাছে পিতাই প্রধান দেবতা, প্রধান হিতোপদেষ্টা। কি কারণে তাঁর মতো নরপতির এমন বিকার তৈরি হয়েছে, দয়া করে আমাকে নিশ্চিন্তে বলুন আপনি। তাঁর জন্য আমি আগুনেও প্রবেশ করতে পারি, তীব্র বিষও পান করতে পারি। সাগরেও ডুবে মরতে পারি। তাঁর জন্য অকরণীয় কিছুই নেই আমার। আর দেবি, আপনিও আমার আরাধ্য। মহারাজের যা বক্তব্য তা আপনিও আমাকে বলতে পারেন। আপনি জেনে রাখুন, রাম কখনো দুরকম কথা বলবে না।”— রাম আকুল হয়ে উঠলেন পিতার এমন মনের অবস্থা দেখে।

কৈকেয়ী সুনিপুণ বাকচাতুর্যে সাজিয়ে ফেললেন ঘটনাক্রম। —“একবার দেবাসুরের যুদ্ধে আহত হওয়ার পর আমার সেবাযত্নে সুস্থ হয়েছিলেন মহারাজ। তিনি খুশি হয়ে দুটি বর দিয়েছিলেন আমাকে। সেই দুই বরে আমি ভরতের অভিষেক আর তোমার চোদ্দ বছরের বনবাস চেয়েছি রাজার কাছে — “ময়ায়ং যাচিতস্তত্র ভরতস্যাভিষেচনম্‌। তব নির্বাসনঞ্চৈব বর্ষাণি হি চতুর্দশ।।” রাম, তুমি পিতার নির্দেশের আর অপেক্ষা করো না। বর দিয়ে রাজা এখন দুঃখ পাচ্ছেন। তিনি তোমার দিকে তাই তাকাতে পারছেন না। তুমি বরং রাজার সত্যরক্ষার জন্য বনবাসে আজই যাওয়ার ব্যবস্থা করো। ” —এত অনায়াসে এমন দুরূহ বাক্য বলা যায় সন্তানতুল্যকে!

“আমি আপনার বা রাজার আদেশে আজই বনে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ভরতকে মাতুলালয় থেকে আনার জন্য আজই দ্রুতগামী রথ যাত্রা করুক। “শান্ত গলায় রাম বললেন। রামের হৃদয়ে শেল বিঁধেছে বিমাতার নিদারুণ বাক্যে। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ ঘটল না।

কৈকেয়ী থামলেন না। তাঁর শঙ্কিত মনে তখনও সংশয়। —“ রাম, আজই ভরতকে আনতে রথ যাত্রা করবে। তুমিও আর সময় নষ্ট করো না। আজই যাত্রা করো। রাম, তুমি এই নগরী থেকে বনে না যাওয়া পর্যন্ত তোমার পিতা সুস্থ হবেন না।”

বেদনায় ভরে গিয়েছে পেয়ালা— অসহায় রাজা শুনতে পেলেন প্রিয়পুত্রের উদ্দেশ্যে নিষ্ঠুর মিথ্যা বাক্যে যেন বিষ ঝরছে। শুনতে শুনতে আবার তলিয়ে গেলেন তিনি সংজ্ঞাহীনতার ওপারে। —চলবে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content