শ্রীরামকৃষ্ণদেব।
গুরুতত্ত্বে একটি অপূর্ব সুন্দর গল্প কথিত আছে— গুরু ও ইষ্টের মধ্যে গুরুই মহান। ইষ্টও মানুষের দোষ-গুণ বিচার করে গ্রহণ করেন। কিন্তু গুরু শিষ্যের দোষ-গুণ বিচার না করেই গ্রহণ করেন। তাঁর বিশেষ কৃপায়, মনুষ্যকৃত সমস্ত পাপনাশ করে ইষ্টের সঙ্গে মিলনের ঘটিয়ে দেন। ভগবান লাভ করে মনুষ্য কৃত-কৃতার্থ হন।
যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ যথা দেবে তথা গুরৌ, তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ।। (শ্বেঃউঃ ৬।২৩)
যাহার পরমেশ্বরের প্রতি পরাভক্তি এবং পরমেশ্বরের প্রতি যেরূপ, গুরুর প্রতি ও সেই রূপ ভক্তি আছে, সেই মহাত্মার নিকট উপনিষদ উক্ত (ব্রহ্ম তত্ত্ব) বিষয় স্বানুভবযোগ্য হয়। গুরুর ভালোবাসা জগৎ ছাড়া। নিঃস্বার্থ প্রেম চরিতার্থ করত, সর্বতো ভাবে শিষ্যের ভার গ্রহণ করে; কল্যাণসাধনই গুরুর একমাত্র লক্ষ্য। শ্রীরামকৃষ্ণ অগণিত মানবের ভার গ্রহণ করেছেন, ইষ্ট রূপে, আবার কখনও গুরু রূপেও।
গিরিশ ঘোষের সমস্ত আধ্যাত্মিক ও পারমার্থিক ভার গ্রহণের মধ্য দিয়ে সে ভাবটি পরিস্ফুট হয়। সাধারণভাবে গুরু যেমন সাধন-ভজনের কথা, নির্দেশ দিয়ে থাকেন, শ্রীরামকৃষ্ণ তেমনই স্মরণ মনন করতে বললেন। কিন্তু গিরিশ সে অল্প ভারও নিতে অপ্রস্তুত। নিজের কর্মভার ও মনের অবস্থার কথা ভেবে এ হেন ভারও নিতে অপারগ তাই গুরুরূপী শ্রীরামকৃষ্ণকে সে কথা দিতে পারলেন না।
যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ যথা দেবে তথা গুরৌ, তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ।। (শ্বেঃউঃ ৬।২৩)
যাহার পরমেশ্বরের প্রতি পরাভক্তি এবং পরমেশ্বরের প্রতি যেরূপ, গুরুর প্রতি ও সেই রূপ ভক্তি আছে, সেই মহাত্মার নিকট উপনিষদ উক্ত (ব্রহ্ম তত্ত্ব) বিষয় স্বানুভবযোগ্য হয়। গুরুর ভালোবাসা জগৎ ছাড়া। নিঃস্বার্থ প্রেম চরিতার্থ করত, সর্বতো ভাবে শিষ্যের ভার গ্রহণ করে; কল্যাণসাধনই গুরুর একমাত্র লক্ষ্য। শ্রীরামকৃষ্ণ অগণিত মানবের ভার গ্রহণ করেছেন, ইষ্ট রূপে, আবার কখনও গুরু রূপেও।
গিরিশ ঘোষের সমস্ত আধ্যাত্মিক ও পারমার্থিক ভার গ্রহণের মধ্য দিয়ে সে ভাবটি পরিস্ফুট হয়। সাধারণভাবে গুরু যেমন সাধন-ভজনের কথা, নির্দেশ দিয়ে থাকেন, শ্রীরামকৃষ্ণ তেমনই স্মরণ মনন করতে বললেন। কিন্তু গিরিশ সে অল্প ভারও নিতে অপ্রস্তুত। নিজের কর্মভার ও মনের অবস্থার কথা ভেবে এ হেন ভারও নিতে অপারগ তাই গুরুরূপী শ্রীরামকৃষ্ণকে সে কথা দিতে পারলেন না।
গিরিশ অবচেতন ও সচেতন ভাবে জানেন শ্রীঠাকুর জগতের ত্রাতা, তিনি দেহ ধারণ করে এসেছেন। তা, তিনি কি আর গিরিশ ঘোষের মতো একজনকে উদ্ধার করতে পারবেন না! গিরিশের মনে কোনও চালাকি ছিল না। মনে প্রাণে সর্বতো ভাবে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ে অর্পণ করেছেন। অবশেষে গিরিশ শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে বকলমা দিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ গুরু রূপে সে ভার গ্রহণ করলেন। দেখার বিষয়। যদিও গুরু শিষ্যের মধ্যে বাক্য বিনিময়ের মধ্যে এ বোঝাপড়া হয়, ভালোবাসার লেনদেনে বিশ্বাসের বাঁধ মজবুত হল, সে পারমার্থিক জিঙ্ঘাংসা পরিপূর্ণতা লাভ করল; সে কিন্তু সর্বতো ভাবে শিষ্য-গুরু-ইষ্ট পরম্পরা বিশিষ্ট ও মানবের প্রতি অপার করুণার প্রাতিভাষিত রূপ। বর্ণনার অতীত।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬২: হে ঈশ্বর তুমিই সব করছো, তুমিই আমার আপনার লোক…
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য
শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সর্বতো ভাবে আত্মসমর্পণ করে গিরিশ জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন থেকে আমি কি করব?” শ্রীরামকৃষ্ণ, “যা করচ তাই করে যাও। এখন এদিক (ভগবান) ওদিক (সংসার) দু’ দিক রেখে চলো। তারপর যখন এক দিক ভাঙবে তখন যা হয় হবে। তবে সকাল-বিকাল তার স্মরণ মননটা রেখো।” এই বলে ঠাকুর গিরিশের উত্তরের প্রতীক্ষা করলেন। গিরিশ অনেক ভেবেচিন্তে দেখলেন তার যে কাজ স্নানের, আহারে, নিদ্রা, কিছুই নিয়মিত হয় না তা তিনি স্মরণ মনন করবেন কী করে! আবার গুরুকে কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারাটা চরম অপরাধ। তাই তিনি সৎ উত্তর পেলেন না। পারব কি, পারব না, বলতে না পেরে মনের মধ্যে ভয় নৈরাশ্য চিন্তার ঝড় বইতে লাগলো।
তখন পরম করুণাময় শ্রীশ্রীঠাকুর গিরিশ ঘোষকে হাসতে হাসতে বললেন, “তুই বলবি, ‘তাও যদি না পারি’—আচ্ছা, তবে আমায় বকালমা দে।” ইহজগৎ ও পরজগতের সমস্ত ভার গ্রহণ করে গুরু তার সমস্ত কর্ম ভার গ্রহণ করলেন। তাঁর অপার দয়ার কথা ভেবে তার উপর ভালোবাসা ও বিশ্বাস, অনন্ত ধারায় প্রবাহিত হতে লাগলো।
তখন পরম করুণাময় শ্রীশ্রীঠাকুর গিরিশ ঘোষকে হাসতে হাসতে বললেন, “তুই বলবি, ‘তাও যদি না পারি’—আচ্ছা, তবে আমায় বকালমা দে।” ইহজগৎ ও পরজগতের সমস্ত ভার গ্রহণ করে গুরু তার সমস্ত কর্ম ভার গ্রহণ করলেন। তাঁর অপার দয়ার কথা ভেবে তার উপর ভালোবাসা ও বিশ্বাস, অনন্ত ধারায় প্রবাহিত হতে লাগলো।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়
শ্রীশ্রীমায়ের জীবনেও এই রূপ ঘটনার আভাস পাওয়া যায়। একদিন স্বামী অরূপানন্দ বলছেন, শ্রীশ্রীমা করুণ স্বরে ভক্তদের জন্য কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছেন, চোখে জল “আহা, এরা আমাকে কত ভালোবাসে আমিও এদের কত ভালোবাসি। আশীর্বাদ করি বাবা, বেঁচে থাকো, ভক্তি হোক, শান্তিতে থাকো, শান্তিই প্রধান, শান্তিই চাই।” একবার শ্রী ইন্দুভূষণ সেনগুপ্ত কোয়ালপাড়া মাঠে শ্রীশ্রীমাকে বলছেন, “মা, সাধন ভজন কিছু হয়ে উঠছে না।”
শ্রীশ্রীমা অভয় ও আশ্বাস দিয়ে বললেন, “তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করতে হয় আমি করব।” বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার কিছু করতে হবে না?” শ্রীমা বললেন, ‘না’। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তবে এখন হতে আমার ভবিষ্যৎ উন্নতি আমার নিজের কৃতকর্মের উপর নির্ভর করে না?” শ্রীশ্রীমা বললেন, “না, তুমি কি করবে? যা করতে হয় আমি করব।”
শ্রীশ্রীমা অভয় ও আশ্বাস দিয়ে বললেন, “তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করতে হয় আমি করব।” বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার কিছু করতে হবে না?” শ্রীমা বললেন, ‘না’। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তবে এখন হতে আমার ভবিষ্যৎ উন্নতি আমার নিজের কৃতকর্মের উপর নির্ভর করে না?” শ্রীশ্রীমা বললেন, “না, তুমি কি করবে? যা করতে হয় আমি করব।”
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪০: দুর্বল বা অসহায়রা একত্র হলে তাঁরাই অজেয় হয়ে ওঠেন
শ্রীশ্রীমায়ের এই অহেতুক কৃপায় তিনি নির্বাক হলেন। তিনি তার সকল সন্তানের জন্যই জপ করেন, ভাবনা করেন, যাদের নাম মনে আসে না তাদের জন্য শ্রীশ্রী ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেন। “ঠাকুর আমার অনেক ছেলে অনেক জায়গায় রয়েছে, যাদের নাম আমার মনে হচ্ছে না, তুমি তাদের দেখো। তাদের যাতে কল্যাণ হয় তাই করো।”
অহেতুক কৃপাসিন্ধু। যিনি জগতের মা, আর গুরুরূপেও সর্বদা বর্তমান আছেন; অপেক্ষা করছেন কখন কোনও সন্তানের আসবে, আর তাদের ত্রিতাপের জ্বালা নিবারণ করে অমৃতের সন্ধান দেবেন।—চলবে।
অহেতুক কৃপাসিন্ধু। যিনি জগতের মা, আর গুরুরূপেও সর্বদা বর্তমান আছেন; অপেক্ষা করছেন কখন কোনও সন্তানের আসবে, আর তাদের ত্রিতাপের জ্বালা নিবারণ করে অমৃতের সন্ধান দেবেন।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।