তখন মাস্টারমশাই মহেন্দ্র নাথ গুপ্ত, শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সবে আসতে শুরু করেছেন। মাস্টার মহাশয় ইংরেজি জানা শিক্ষিত, হাত জোড় করে নমস্কার করা লোক। কিন্তু সেদিন ভুমিষ্ট হয়ে প্রণাম করে বসলেন। নরেন্দ্রাদি ছোকরা ভক্তদের ঠাকুর উচ্চহাস্য করে বলছেন, ‘ওই রে আবার এসেছে’। কেন হাসলেন ঠাকুর বলছেন, “দেখ, একটা ময়ূরকে বেলা চারটার সময় আফিম খাইয়ে দিচ্ছিল। তারপর দিন ঠিক চারটার সময় ময়ূরটা উপস্থিত আফিমের মৌতাত ধরেছিল। ঠিক সময়ে আফিম খেতে এসেছে।”
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রেমে পড়তে শুরু করেছেন মাস্টার। নিজেও অনুভব করছেন কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আবার টেনে নিয়ে এসেছে। ভক্ত ভগবানের সম্পর্ক তাই-ই। ভক্ত ছোট চুম্বক ভগবান বড় চুম্বক। প্রথম প্রথম ভগবান ভক্তকে আকর্ষণ করে, পরে ভক্তের টানে ভগবান আসেন। যিনি এই টান অনুভব করেছেন তিনি ধন্য। জীবনে চার পুরুষার্থ রয়েছে। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। এই পুরুষার্থ সকল পূর্ণ করার জন্য এই শরীর ধারণ। ধর্ম, অর্থ, কাম প্রায় প্রত্যেকেই পূরণ করে। কিন্তু মোক্ষ লাভার্থে অল্প কয়জন চেষ্টা করে।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩৮: শাস্ত্র ঈশ্বরের দর্শন করিয়ে দিতে পারে না, সাধন দ্বারাই তাঁকে লাভ করতে হয়
বিচিত্রের বৈচিত্র: পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অন্তরঙ্গদের ভালো করে চিনতেন। তাই মাস্টার মশাইকে সে কথা ও তার উদ্দেশ্য কী পরে পরে জানিয়ে দিতে চান। শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন নরেন সম্বন্ধে মাস্টারকে বলছেন, “দেখ, চাষারা হাটে গরু কিনতে যায়। তারা, হাটে ভালো গরু মন্দ গরু বেশ চেনে। লেজের নিচে হাত দিয়ে দেখে। কোন গরু লেজে হাত দিলে শুয়ে পড়ে। সে গরু কেনে না। যে গরু লেজে হাত দিলে তিড়িং মুড়ি করে লাফায় উঠে সেই গরুকে পছন্দ করে। নরেন্দ্র সেই গরুর জাত। ভিতর খুব তেজ। কেউ কেউ লোক আছে যেন চিনের ফলার, আঁট নেই, জোর নাই, ভ্যাৎ ভ্যাৎ করছে।”
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৮: আমি শুনি গো শুনি তোমারে…
নরেন্দ্র সম্বন্ধে সর্বদাই উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। শ্রীশ্রীমা বলছেন, ‘নরেন্দ্র ছিল তাঁর মাথার মণি’। শ্রীমা জানতেন নরেন্দ্র কে ছিলেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরের সঙ্গে প্রথম দিকের সাক্ষাৎকার গুলিতে বোঝা যায়। এদিকে নরেন্দ্রকে বলছেন, “দেখ আরেকটু বেশি বেশি আসবি। সবে নতুন আসছিস কিনা। প্রথম আলাপের পর নতুন সকলেই ঘন ঘন আসে। যেমন নতুন পতি।” শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তরঙ্গদের সর্বদায় আনন্দে রাখতেন। গৌর নিতাই, সংসারী লোকদের আকর্ষণ করার জন্য বলতেন, ‘মাগুর মাছের ঝোল যুবতী মেয়ের কোল বোল হরি বোল। প্রথম দুইটি লোভে অনেকে হরিবোল বলতে যেত। পরে বুঝত মাগুর মাছের ঝোল হল হরি প্রেমে অশ্রু, যুবতী মেয়ে পৃথিবী, হরি প্রেমে ধুলায় গড়াগড়ি।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি
দাঁতে ব্রাশ ঠেকাতেই মাড়ি থেকে রক্ত পড়ছে? কী করবেন? দেখুন ভিডিয়ো
অপরদিকে সর্বদা তাদেরকে আধ্যাত্মিক শক্তিতে পূর্ণ করার দিকে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন সর্বদা ঈশ্বরিয়া প্রসঙ্গ ভজন কীর্তন আনন্দের হাট লেগেই থাকতো শ্রীশ্রীমা শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে বলছেন, “তাঁকে কখনো নিরানন্দ দেখিনি।” সদা আনন্দময় পুরুষ ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আবার শ্রীশ্রীমা নিজের সম্বন্ধে বলছেন, হৃদয়ে আনন্দের পূর্ণ ঘট প্রতিষ্ঠিত আছে। একদিন ঠাকুর নিজের ছোট খাটটিতে বসে আছেন আনন্দময় মূর্তি সহস্র বদন। শ্রীযুক্ত কালী কৃষ্ণের সঙ্গে মাস্টার মহাশয় এসে উপস্থিত। কালীকৃষ্ণ জানতেন না তাকে তার বন্ধু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বন্ধু বলেছিল শুঁড়ির দোকানে যাবে তো আমার সঙ্গে এসো। সেখানে এক জ্বালা মদ আছে। মাস্টার এসে বন্ধুকে যা বলেছিলেন শ্রীশ্রী ঠাকুরকে সমস্ত নিবেদন করলেন। ঠাকুর হাসতে লাগলেন।
ঠাকুর বললেন “ভজনানন্দ, ব্রহ্মানন্দ। এই আনন্দের সূরা প্রেমের সূরা। মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর প্রেম, ঈশ্বরকে ভালোবাসা। ভক্তি সার জ্ঞান বিচার করে ঈশ্বরকে জানা বড় কঠিন।” ভালোবাসার দ্বারা সহজে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। কৃষ্ণকে গোপগোপিকারা প্রেমে সখা রূপে পেয়েছিল।—চলবে।
ঠাকুর বললেন “ভজনানন্দ, ব্রহ্মানন্দ। এই আনন্দের সূরা প্রেমের সূরা। মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর প্রেম, ঈশ্বরকে ভালোবাসা। ভক্তি সার জ্ঞান বিচার করে ঈশ্বরকে জানা বড় কঠিন।” ভালোবাসার দ্বারা সহজে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। কৃষ্ণকে গোপগোপিকারা প্রেমে সখা রূপে পেয়েছিল।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।