রবিবার ১৭ নভেম্বর, ২০২৪


রামকৃষ্ণ।

ধর্ম চেতনা এবং সংশয়—চিরকালীন। সাধারণ থেকে সাধক প্রত্যেকেই এই সংশয় প্রকাশ করেছেন। ধর্মলাভ করা সম্ভব? যদি যায়, কোনও পথে? কীভাবে? ধর্মলাভ হলে তার লক্ষণ বা কী? ইত্যাদি। ধর্মলাভ তো সাধন সাপেক্ষ, নচেৎ সম্ভব নয়। তার জন্য দরকার ত্যাগ ও তপস্যা। যদি না যায় জীবনের অর্থই কী? সংশয় আবিষ্ট হয়ে চিরকালীন থাকা যায়? দ্বন্দ্বের পারে যেতে হবে। নির্দিষ্ট কোন একটি পথ আশ্রয় করে এগোতে হয়। অনেক পথ রয়েছে, কোন পদ সাধক অবলম্বন করবেন! সংশয় সর্বদাই পথ ছাড়তে চায় না। চেতনার স্তরে সর্বদাই প্রশ্ন জেগে যায়। সাধকের সিদ্ধির দোর গড়াতেও সংশয় পথ ছাড়ে না। শাস্ত্রে এমন বলে যে, নিঃসংশয় হওয়াই ধর্মলাভ। দ্বন্দ্ব-রাহিত্যই প্রেমের পরাকাষ্ঠা। সম্পূর্ণ নিবেদনে পূর্ণতা প্রাপ্তি।
শ্রীমদ্ ভগবৎ গীতা ভগবান বলছেন—
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োঽসি মে।।১৮|৬৫

তুমি মন্মনা, মদ্ ভক্ত, মদ্ যাজী হও, আমাকে নমস্কার করো, তাহলে আমাকেই প্রাপ্ত হবে। ইহা আমি তোমার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি। কারণ তুমি আমার প্রিয়। ভগবান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাঁর স্মরণাগত ভক্তকে তিনি রক্ষা করবেন। কোনও সংশয় নেই।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৫: অরু দত্ত— এক অভিশপ্ত গান্ধর্বী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গগণের মধ্যে আলোচনা প্রণিধান যোগ্য। শ্রীপ্রসন্ন বলছেন, ‘না হল জ্ঞান, না হল প্রেম। কি নিয়ে থাকা যায়?’ শ্রীতারক বলছেন, ‘জ্ঞান হওয়া শক্ত বটে, কিন্তু প্রেম হল না কেমন করে?’ প্রসন্ন বলছেন, ‘কাঁদতে পারলাম না, তবে প্রেম হবে কেমন করে? আর এত দিনে কি বা হল?’ ভগবান লাভের জন্য আকুতির প্রবল উচ্ছ্বাস অনেক সময় এই প্রকার আপশোষ রূপ ধারণ করে। কিন্তু, তা ক্ষণিকের।

তারক আবার বলছেন, ‘কেন পরমহংস মহাশয়কে তো দেখেছো; আর জ্ঞানী বা হবে না কেন?’ আবার সংশয় প্রকাশ করে প্রসন্ন বলছেন, ‘কী জ্ঞান হবে? জ্ঞান মানে তো জানা। কী জানবে? ভগবান আছেন কিনা তার ঠিক নাই!’ তারক ভাবছেন, ‘তা বটে, জ্ঞানীর মতে ঈশ্বর নাই।’ আর যে ব্রহ্ম সর্বব্যাপী তাঁকে কি জানা যায়? যে জানে, সে তা-ই হয়ে যায়। যে সংশয় সাধকের ছিল তা পূর্ণতা প্রাপ্তিতে সমাপ্ত হয়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

শ্রীরাখাল বলছেন, গুরুমহারাজ যেমন ভালোবাসতেন, তত কি আর বাপ-মা ভালোবাসে? আমরা তার জন্য কী করেছি, যে এত ভালোবাসা? কেন তিনি আমাদের দেহ-মন-আত্মার মঙ্গলের জন্য এত ব্যস্ত ছিলেন? আমরা তার কী করেছি?’
শ্রীরাখাল, শ্রীরামকৃষ্ণ উদ্দেশ্যে বলতেন, “অহেতুক কৃপাসিন্ধু।” একদিন বরাহনগর মঠে, শ্রীনরেন্দ্র নিজে চৈতন্যদেবের প্রেম বিতরণের কথা পড়িতেছেন। সে সময় মাঠের এক ভাই মন্তব্য করেন, ‘আমি বলি কেউ কারুকে প্রেম দিতে পারে না।’
শ্রীনরেন্দ্র বললেন, “আমায় পরমহংস মহাশয় প্রেম দিয়েছেন”।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৫: রাজনীতি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বারে বারে টেনে আনে ধর্মকে, আর এতেই প্রাণ যায় ধর্মভীরু সাধারণদের

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

শ্রীঠাকুর যেমন বলতেন, প্রেম সকলের লাভ হয় না। অবতার পুরুষদের বা ঈশ্বরকোটিদের হয়। শ্রীনরেন্দ্র নিঃসংশয়ে তা লাভ করেছিলেন। মুণ্ডকোপনিষদে রয়েছে, ‘ভিদ্যতে হৃদয় গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়া ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে।।’ ২|২|৮ কার্য কারণরূপী সেই পরমাত্মা দৃষ্ট হইলে উক্ত সাক্ষাৎকারীর হৃদয়ের গ্রন্থি বিনষ্ট হয়, সকল সংশয় ছিন্ন হয়। কর্ম সমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। হৃদয়ে প্রভুর দর্শন করে তার আর কোন সংশয় যেমন থাকে না তেমন অপ্রাপ্তব্য কিছু থাকে না।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content