লতার সঙ্গে আরডি।
মুক্তি পায় ‘বসেরা’ ছবিটি। কলম ধরেন গুলজার। সুর রচনার ভার তুলে দেওয়া হয় পঞ্চমের শক্ত কাঁধে। ‘আউঙ্গি এক দিন আজ জাউন’ গানটিতে সুর করেন পঞ্চম। গায়িকা তাঁর সহধর্মিণী আশা। একটি দুষ্টুমিষ্টি ছন্দের তালে তালে নিজের কণ্ঠকে পঞ্চমের সুরের ঝর্ণাধারায় যেন ভাসিয়ে দিলেন আশা। রিদম এবং মেলোডির এ এক অপূর্ব মেলবন্ধন। এই একই ছন্দ এবং সুর পঞ্চম একটি অতিপরিচিত বাংলা গানেও ব্যবহার করেছিলেন। সে-ক্ষেত্রেও গায়িকা ছিলেন আশা ভোঁসলে। গানটি হল ‘আসবো আর একদিন আজ যাই’। আমি শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত যে আপনারা এই দুটি গানই শুনেছেন। মুগ্ধ হয়েছেনও বটে।
একই ছবির আরও একটি গান ‘যাহা পে সভেরা হো বসেরা ওহি হ্যায়’ গানটির ক্ষেত্রে পঞ্চম বেছে নেন তাঁর লতাকে। কারণ এই গানটিতে লতাকেই মানায়। এটি পঞ্চমের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা যথাযতভাবে রেখেছেন লতা মঙ্গেশকর। পিয়ানোর একটি মনমাতানো রান দিয়ে শুরু হয় গানটি। তারপর শ্রোতাদের কর্নেন্দ্রিও ভেদ করে লতাকণ্ঠ স্পর্শ করে তাদের হৃদয়। মাইনর স্কেলে এমন একটি হৃদয়বিদারক সুর এবং তার সঙ্গে লতার গায়কী। দুইয়ে মিলে সম্পূর্ণভাবে বাকরুদ্ধ করে তোলে আমাদের। আমরা কোথাও যেন হারিয়ে যাই এই সুরের মায়াজালে।
‘তুমহে ছোড়কে আব’ গানটিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই পঞ্চম কিশোর-আশা জুটিকে ব্যবহার করেন। নায়ক-নায়িকার চাঞ্চল্যকে কণ্ঠের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে এই জুটির যে জুড়ি মেলা ভার সেটি খুব ভালো করে জানতেন পঞ্চম। গানের দৃশ্যটি দেখলে বোঝা যায় পঞ্চমের এহেন ভাবনার কারণটি কী।
‘তুমহে ছোড়কে আব’ গানটিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই পঞ্চম কিশোর-আশা জুটিকে ব্যবহার করেন। নায়ক-নায়িকার চাঞ্চল্যকে কণ্ঠের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে এই জুটির যে জুড়ি মেলা ভার সেটি খুব ভালো করে জানতেন পঞ্চম। গানের দৃশ্যটি দেখলে বোঝা যায় পঞ্চমের এহেন ভাবনার কারণটি কী।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩৪: আরডি-র গানে সারা পৃথিবীর মিউজিক উঠে এসেছিল
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!
পঞ্চম যখন লতা মঙ্গেশকরের কথা মাথায় রেখে কোনও সুর রচনা করতেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি একজন অন্য মানুষ হয়ে উঠতেন। সুরের ধরণগুলি একটু খেয়াল করলেই আপনারা বুঝতে পারবেন আমি ঠিক কি বলতে চাইছি। এই ছবিরই আরও দুটি গান ‘সাওয়ারে শুনাও বাঁশুরী’ এবং ‘জানে ক্যায়সে বিতেগি’ শুনলেই বুঝতে পারবেন বিষয়টি। দুটি গানই ভিন্ন স্তরের। অথবা ভিন্ন ঘরানার বললে হয়তো সঠিক বলা হবে। লতাকে কোনো গান গাওয়ানোর আগে পঞ্চম অনেক চিন্তা করে তারপর তাঁকে দিতেন গানটি। সেটি লতা মঙ্গেশকর ও অনুধাবন করতেন বইকি। তিনি বেশ বুঝতে পারতেন যে তাঁর ব্যাক্তিত্বের কথা মাথায় রেখেই সুরটির জন্ম দিয়েছেন পঞ্চম। ফলে, পঞ্চম ছিলেন লতার পরম স্নেহের পাত্র। তিনি আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন পঞ্চমকে। এমনকি রিহার্সাল চলাকালীন কোন গানকে নিয়ে লতার দেওয়া কোনও উপদেশ স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করতেন পঞ্চম। এমনই ছিল দিদি এবং ভাইয়ের সম্পর্ক।
আসে ‘হারজাই’ ছবিটি। পঞ্চম-ম্যাজিকের ছোঁয়ায় ‘জীবন মে জব আয়সে পল’ গানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। আর হবে নাই বা কেন—সুর, ছন্দ এবং কিশোর-আশার মন কেড়ে নেওয়া গায়কী। আর কিছু সত্যিই কি প্রয়োজন হয়? এই জুটির ক্ষেত্রে পঞ্চম কিছু একটি অভিনব করবেনই করবেন।
‘কভি পলকো পে আঁসু হ্যায়’-র মতো অত্যন্ত ধীরগতির একটি গান গাওয়ানো হয় কিশোরকে দিয়ে। গায়কের কণ্ঠে গানটি যেন আরও বেশি করে আলোকিত হয়ে উঠেছে। ‘সুন জারা শখ হাসিনা’ গানটির সঙ্গে পরিচিত হলেই বুঝতে পেরে যাবেন যে, এই গানের সুরকার কে হতে পারে। কিশোর-আশা জুটিকে দিয়ে এই গানটি গাওয়ানোর প্রবল ইচ্ছে ছিল পঞ্চমের। তো ইচ্ছেপূরণ তো করতেই হয়। তাই দু’জনের কথা মাথায় রেখে জন্ম দিলেন অসাধারণ এই সুরের।
‘কভি পলকো পে আঁসু হ্যায়’-র মতো অত্যন্ত ধীরগতির একটি গান গাওয়ানো হয় কিশোরকে দিয়ে। গায়কের কণ্ঠে গানটি যেন আরও বেশি করে আলোকিত হয়ে উঠেছে। ‘সুন জারা শখ হাসিনা’ গানটির সঙ্গে পরিচিত হলেই বুঝতে পেরে যাবেন যে, এই গানের সুরকার কে হতে পারে। কিশোর-আশা জুটিকে দিয়ে এই গানটি গাওয়ানোর প্রবল ইচ্ছে ছিল পঞ্চমের। তো ইচ্ছেপূরণ তো করতেই হয়। তাই দু’জনের কথা মাথায় রেখে জন্ম দিলেন অসাধারণ এই সুরের।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২০: সুন্দরবনের বসন্ত রোগ নিরাময়কারী দেবী শীতলা
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
এ বার লক্ষ্য করুন, ‘তেরে লিয়ে পলকো কি ঝালর বনু’ গানটি কিন্তু গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। আশা নন। কারণ গানটির দৃশ্যের কথা মাথায় রেখে সুর জন্ম দেওয়ার সময়ই হয়তো পঞ্চমের মনে পরে গিয়েছিল লতার কথা। দৃশ্যে নায়িকা খুব সংযত, এবং গানটির প্রবাহও সেইরকমই। অর্থাৎ, এই ক্ষেত্রে লতাকে চাই-ই চাই। এবং লতা মঙ্গেশকরও নিজের কণ্ঠ দিয়ে একটি মালা গেঁথে উপহার দিয়ে গিয়েছেন আমাদের।
‘তুঝসা হাসিন দেখা না কাহি’ গানটি পুরোপুরি পঞ্চম ঘরানার। বেস গিটার, ইলেকট্রিক স্প্যানিশ, বঙ্গ, পারকাসান—কি নেই। আধুনিক ‘পার্টি সং’-এর ধাঁচে তৈরি করেছেন গানটি। গাওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন এক এবং অদ্বিতীয় কিশোর কুমারকে। এখানে একটি কথা না বলে পারছি না। কিশোর এবং পঞ্চম—এই দুটি মানুষ যেমন ‘কাভি পালকো পে আসু’ র মতো একটি ধীরগতির সিরিয়াস গানের ক্ষেত্রে ১০০ ভাগ সফল। আবার তেমনি উপরোক্ত ‘তুঝসা হাসিন’-এর মতো একটি আধুনিক ‘পার্টি সং’-এর ক্ষেত্রেও একই রকম সফল। ভাবুন, একই ছবির দুটি গান। কিন্তু দুটিই সম্পূর্ণ রূপে বিপরীতধর্মী। তবু সুরকার এবং গায়ক দু’জনেই তাঁদের নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন দুটি ক্ষেত্রেই। এই ক্ষুদ্র বিষয়গুলিকে যদি আমরা একটু সূক্ষ্ম ভাবে বিশ্লেষণ করি আমাদের কাছে ঠিক পরিষ্কার হয়ে যাবে এই দু’জন ক্ষণজন্মার ক্ষমতার ব্যাপ্তি।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১১: আমার নাম, তোমার নাম— তুং নাম, তুং নাম!
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৭: মা সারদার ভগবতী সাধনা
‘ইয়ে রুত হ্যায় হাসিন’ গানটিতে একটি মিষ্টি সুরের সন্ধান পাওয়া যায় যা শুধু পঞ্চমের পক্ষেই জন্ম দেওয়া সম্ভব। রণধীর কাপুরের লিপে কিশোর এক কথায় অনবদ্য। আসলে কোথাও হয়তো কিশোর এবং পঞ্চম—দু’ জনেই দুজনের কাছে বিশেষভাবে দায়বদ্ধ ছিলেন। কোথাও কোনও লিখিত চুক্তি ছিলনা ঠিকই, কিন্তু সেই অলিখিত এবং অব্যাক্ত দায়বদ্ধতা থেকেই বোধহয় দু’জনে পরস্পরের জন্য নিজেদের উজাড় করে দিতেন। —চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।