(ডান দিকে) কিশোর কুমারের সঙ্গে পঞ্চম (বাঁ দিকে)।
১৯৮৭ সাল মোটামুটি কাজের মধ্যে দিয়ে বেশ কাটছিল। কম বেশি সাফল্যও আসছিল। নবাগত সুরকারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিল পঞ্চমের সুরসৃষ্টির কর্মকাণ্ড। মানুষের হৃদয়কে যে একইভাবে ছুঁয়ে যেতে হবে! তাঁর দলের সদস্যদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে চলত আলোচনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নতুন প্রজন্ম ঠিক কেমন সুরের মায়াজালে ধরা দেবে? মেলোডিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে, নাকি রিদমকে? রিদম প্যাটার্নে কী কী পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব যেগুলিতে থাকবে নতুনত্বের ছোঁয়া? এমন কী কী করলে পুরনো এবং নতুন দুই প্রজন্মকেই মাতিয়ে রাখা যাবে? এইগুলিই থাকতো আলোচনার বিষয়বস্তু। এই ভাবে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি।
১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর। দিনটি শুরু হয়েছিল আর পাঁচটি দিনের মতোই। কর্মব্যস্ত সকাল। কর্মব্যস্ত জনসাধারণ। কর্মব্যস্ত বলিউড। শুটিং, রিহার্সাল, রেকর্ডিং সবকিছুই শুরু হয়ে গিয়েছিল যথাস্থানে, যথাসময়ে। বেলা যত গড়াচ্ছিল, বম্বে শহর-সহ গোটা দেশ হয়ে পড়ছিল ব্যস্ততর। কিন্তু দ্বিপ্রহরের কিছু পরেই কিশোর নিবাস ‘গৌরীকুঞ্জে’ যে অঘটনটি ঘটে গেল, সেটির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই। প্রস্তুত ছিলেন না কিশোর কুমার নিজেও।
সন্ধে নামার কিছু আগে হঠাৎই বুকের বাঁদিকে প্রবল বেদনা অনুভব করতে শুরু করেন কিশোর। হাত দিয়ে বুক চেপে কোনওক্রমে স্ত্রী লীনা চন্দ্রভরকরকে কাছে ডাকেন। লীনা তড়িঘড়ি ছুটে এসে চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখতে পান তাতে তাঁর পায়ের তলার মাটি সরে যায় এক নিমেষে। কিশোর স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তাঁর দু’চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। কিছু বলতে চাইছেন স্ত্রীকে, কিন্তু কোনওমতেই পেরে উঠছেন না। বিপদ বুঝে, একটুও সময় অপচয় না করে লীনা বাড়ির পরিচারকদের উদ্যেশ্যে চিৎকার করে বলেন ‘ডক্টর কো বুলাও’। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, কিশোর পুত্র অমিত কুমার সেই সময় কোনও একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে ভ্রমণরত।
সন্ধে নামার কিছু আগে হঠাৎই বুকের বাঁদিকে প্রবল বেদনা অনুভব করতে শুরু করেন কিশোর। হাত দিয়ে বুক চেপে কোনওক্রমে স্ত্রী লীনা চন্দ্রভরকরকে কাছে ডাকেন। লীনা তড়িঘড়ি ছুটে এসে চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখতে পান তাতে তাঁর পায়ের তলার মাটি সরে যায় এক নিমেষে। কিশোর স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তাঁর দু’চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। কিছু বলতে চাইছেন স্ত্রীকে, কিন্তু কোনওমতেই পেরে উঠছেন না। বিপদ বুঝে, একটুও সময় অপচয় না করে লীনা বাড়ির পরিচারকদের উদ্যেশ্যে চিৎকার করে বলেন ‘ডক্টর কো বুলাও’। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয়, কিশোর পুত্র অমিত কুমার সেই সময় কোনও একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে ভ্রমণরত।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫৫: মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস পড়া হ্যায়…
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪১: সুন্দরবনে বাঘে-মানুষে সংঘাত
বাড়িতে তখন লিনার সঙ্গে রয়েছে কিশোরের কনিষ্ঠ পুত্র ছোট্ট সুমিত। অসহায় লীনা বুঝে উঠতে পারেন না ডাক্তার না আসা অবধি তাঁর কি করা উচিত। চোখের সামনে স্বামীকে এই ভাবে ছটফট করতে তিনি আগে কখনও দেখেননি। ততক্ষণে কিশোর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে শুরু করেছেন। শরীর ছেড়ে দিয়েছেন। বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয় কিশোরকে। কিশোর যেন একটু স্বস্তি পেয়েছেন। তাই হয়তো চোখ বুজে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। অন্তত লীনা- সহ তাঁর পাশে উপস্থিত বাকিদের তেমনই মনে হতে থাকে।
আসেন ডাক্তার। কয়েক মুহূর্ত চলে প্রাথমিক পরীক্ষা। কিন্তু ডাক্তারবাবুর শরীরের ভাষা বুঝতে অসুবিধে হয়নি লীনার। গা শিউরে ওঠে তাঁর। বুঝতে পারেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অঘটনটি সবার অজান্তে ঘটে গিয়েছে। কিশোর কোনও পূর্বাভাস না দিয়েই তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন বহু বহু দূরে। যে দূরত্ব ঘোচানো আর কোনওদিনও সম্ভব নয়। সূর্য ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে অস্তমিত।
আসেন ডাক্তার। কয়েক মুহূর্ত চলে প্রাথমিক পরীক্ষা। কিন্তু ডাক্তারবাবুর শরীরের ভাষা বুঝতে অসুবিধে হয়নি লীনার। গা শিউরে ওঠে তাঁর। বুঝতে পারেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অঘটনটি সবার অজান্তে ঘটে গিয়েছে। কিশোর কোনও পূর্বাভাস না দিয়েই তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন বহু বহু দূরে। যে দূরত্ব ঘোচানো আর কোনওদিনও সম্ভব নয়। সূর্য ততক্ষণে পশ্চিম আকাশে অস্তমিত।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫০: অর্ধশতাব্দী ছুঁলো ‘অমানুষ’
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৫: ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা
দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে দুঃসংবাদ। খবর পাঠানো হয় অমিত কুমারকে। কাজ ফেলে গৌরীকুঞ্জে ছুটে আসেন অশোক কুমার, অনুপ কুমার-সহ চলচ্চিত্র জগতের তারকা, নির্দেশক, গীতিকার, সুরকার এবং কলাকুশলীরা। চোখের জল যেন কিছুতেই বাধা মানে না। কিশোর কুমার চিরঘুমে শায়িত। এই দৃশ্য অবিশ্বাস্য ! রেডিও এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে এই মর্মান্তিক খবরটি ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। গৌরীকুঞ্জের সামনে তখন শোকার্ত মানুষের ঢল। কারও মুখে কোনও কথা নেই। সবাই শুধু অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছেন বাড়িটির দিকে।
পরের দিন এসে পৌঁছন অমিত কুমার। তাঁর সেই কান্নার কাছে শিশুর কান্নাও যেনো হার মেনে যায়। যে বিশাল বটবৃক্ষের ছায়ায় তাঁর এতদিন কেটেছে, সেই বৃক্ষটিকে কোনও এক তুফান এসে যে এক নিমেষে উপড়ে নিয়ে চলে যাবে সেটি তিনি কোনওদিন দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেননি। তারপরই গৌরীকুঞ্জে পৌঁছন রাহুল দেব বর্মণ। তাঁকে দেখে মনে হয় অতি কষ্টে তিনি নিজেকে গৌরীকুঞ্জ অবধি নিয়ে এসেছেন। তাঁর পা দুটি যেন নড়তেই চায় না। যে অগ্রজসম বন্ধুর সঙ্গে এতদিন ধরে তাঁর ওঠাবসা, কর্মক্ষেত্রের বাইরেও যাঁর সঙ্গে ভাগ করে নিতেন নিজের ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা, যাঁর সঙ্গে চলত সুর-সংগীত নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণা, সর্বোপরি, যাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠ পঞ্চমের সুরগুলিকে পৌঁছে দিত আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে, সেই মানুষটি আজ আর নেই।
পরের দিন এসে পৌঁছন অমিত কুমার। তাঁর সেই কান্নার কাছে শিশুর কান্নাও যেনো হার মেনে যায়। যে বিশাল বটবৃক্ষের ছায়ায় তাঁর এতদিন কেটেছে, সেই বৃক্ষটিকে কোনও এক তুফান এসে যে এক নিমেষে উপড়ে নিয়ে চলে যাবে সেটি তিনি কোনওদিন দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেননি। তারপরই গৌরীকুঞ্জে পৌঁছন রাহুল দেব বর্মণ। তাঁকে দেখে মনে হয় অতি কষ্টে তিনি নিজেকে গৌরীকুঞ্জ অবধি নিয়ে এসেছেন। তাঁর পা দুটি যেন নড়তেই চায় না। যে অগ্রজসম বন্ধুর সঙ্গে এতদিন ধরে তাঁর ওঠাবসা, কর্মক্ষেত্রের বাইরেও যাঁর সঙ্গে ভাগ করে নিতেন নিজের ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা, যাঁর সঙ্গে চলত সুর-সংগীত নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণা, সর্বোপরি, যাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠ পঞ্চমের সুরগুলিকে পৌঁছে দিত আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে, সেই মানুষটি আজ আর নেই।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৬: কল্যাণী—অন্দরমহলের সরস্বতী
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৮: অভিভাবিকা মা সারদা
পঞ্চম যেন দ্বিতীয়বারের জন্য পিতৃহারা হলেন। অর্জুনের বাহু থেকে যেন গান্ডীব খসে পড়লো। অমিত কুমারের পরবর্তীকালের একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় যে কিশোরের মরদেহের সামনে দাড়িয়ে, চূড়ান্তভাবে হতাশ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় পঞ্চম অমিত কুমারের কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন ‘বেটা, মেরা জমানা গয়া’। কতখানি হতাশা গ্রাস করলে পঞ্চমের মতো একজন মানুষ এমন কথা বলতে পারেন একটিবার ভাবুন। কিশোর কুমার আর কোনওদিন রাহুল দেব বর্মণের নতুন কোনও সুরে গান গাইবেন না। এই কঠোর সত্যটি যেমন সেই মুহূর্তে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল পঞ্চমের পক্ষে, সেটি একই রকমভাবে অসম্ভব ছিল প্রতিটি সঙ্গীতপ্রেমীর পক্ষেও। চিরতরে হারিয়ে গেলেন সংগীত জগতের প্রবাদপ্রতিম আভাস কুমার গাঙ্গুলি, আমাদের সবার ভালোবাসার মানুষ কিশোর কুমার। তৈরি করে গেলেন এক বিশাল মহাশূন্য। রেখে গেলেন তাঁর শতসহস্র গুণমুগ্ধ, অগুন্তি মন ছুঁয়ে যাওয়া গান এবং তাঁর অভিনীত বেশ কিছু যুগান্তকারী ছায়াছবি। যেগুলিকে আঁকড়ে ধরেই কাটবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন। যেগুলিই হবে আমাদের ‘কিশোর’ প্রাপ্তির একমাত্র পথ।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।