মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


বেঁচে থাকুন পঞ্চম, বেঁচে থাকুক আপনার মেলোডি।

‘১৯৪২ এ লাভ স্টরি’র কাজ তো সম্পন্ন হল। এ যেন নতুন করে তাঁর জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট। তাঁর সতীর্থদের এবং ঘনিষ্ঠ মহলের উচ্ছসিত প্রশংসা অর্জন করলেন তো বটেই। নিজেও কোথাও যেন নিজেকে প্রশংসিত করার কারণ খুঁজে পেলেন। বেশ বুঝতে পারলেন যে দ্বিতীয় ইনিংস আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরার পালা এ বার। ‘উপেক্ষিত’ পঞ্চম এ বার যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।

তবু স্বাস্থ্য খুব একটি ভালো যাচ্ছিল না। কিছু বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে সুদূর লন্ডনে পাড়ি দিতে হয়েছিল বাইপাস সার্জারির জন্য। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছিল ঠিকই। তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেও এসেছিলেন। তবে বেশ কিছু দিন বিশ্রামের পর তিনি আবার কাজ শুরু করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই থেকে টানা তিন থেকে চার বছর তেমন ভাবে কাজও পাননি পঞ্চম, যেমন আগেই বলেছি। তার সঙ্গে ছিল শরীরের ছোট-বড় কিছু সমস্যা। বাইপাস সার্জারির পর ডাক্তারবাবুরা তাঁকে বলেছিলেন, সঠিক ভাবে হৃদযন্ত্রের যত্ন নিতে হবে। বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। দৈনিক পথ্য এবং ওষুধ, এই দুই-ই যেন নিয়ম মেনে খেতে হবে। সেখানেই হয়তো কিছু ঘাটতি থেকে যাচ্ছিল। এর রকম শারীরিক অবস্থাতেই, ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে তিনি শেষ করেন ‘১৯৪২ এ লাভ স্টোরি’র কাজ। ছবিটি তখন শুধু মুক্তির অপেক্ষায়।
এরই মধ্যে এলো নতুন বছর। অর্থাৎ, ১৯৯৪ সাল। নিউ ইয়ার বলে কথা! গোটা দেশ-সহ মায়ানগরী মুম্বই তখন ইংরেজি নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। সেই উপলক্ষেই জানুয়ারির তিন তারিখে শক্তি সামন্ত নিজের বাড়িতে আয়োজন করলেন একটি সান্ধ্যকালীন পার্টির। বহু তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি পঞ্চমকেও আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। সময় মতো পৌঁছলেন পঞ্চম। স্বাস্থ্যের কারণে গাড়ি চালানোর উপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল কিনা ঠিক জানা নেই। তবু সেই সন্ধ্যায় নিজেই গাড়ি চালিয়েছিলেন তিনি। খুব ধুমধাম হল সেই পার্টিতে। ‘১৯৪২ এ লাভ স্টোরি’র চরম সাফল্যের ভবিষ্যৎবাণীও করলেন উপস্থিত অনেকে। খুব ভালো কাটলো সময়টি।

নৈশভোজ সেরে এ বার বাড়ি ফেরার পালা। নিজেই গাড়ি চালিয়ে ফিরে এলেন বটে, তবে শরীর বোধহয় খুব একটা সায় দিচ্ছিল না। তাঁর বাসস্থান মেরিল্যান্ড অ্যাপার্টমেন্টসে ফিরে দ্বাররক্ষককে পঞ্চাশটি টাকা দিয়ে বললেন তাঁর গাড়িটি যথাস্থানে পার্ক করে রাখতে। তারপর আস্তে আস্তে পৌঁছলেন নিজের ফ্ল্যাটে। সময় ততক্ষণে মধ্যরাত পেরিয়েছে। শোয়ার ঘরে রাখা বিশালাকায় টেলিভিশন সেটটি চালিয়ে দিয়ে চালু করলেন তাঁর পছন্দের চ্যানেল বিবিসি। সোফায় ক্লান্ত শরীরটি এলিয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইলেন টেলিভিশনের দিকে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৯: এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লগা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— উকড়ি বেগুন, মধুফল ও নিশিন্দা

কিন্তু কিছুতেই যেন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। বুকের ভিতরে ক্রমশ বেড়ে চলছিল একটি অসহনীয় যন্ত্রণা। দু’হাত দিয়ে বুকের বাঁদিকে আস্তে আস্তে চাপ দিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু কোনওভাবেই শারীরিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছিল না। বাড়িতে তখন শুধু তাঁর চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গী বহুদিনের পরিচারক সুদাম। তাঁর চোখে পড়ে ঘটনাটি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন যায় ডাক্তারের কাছে। ভোর প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ ছুটে আসেন ডাক্তারবাবু। সব রকম ভাবে পরীক্ষা করার পর এ বার তাঁর চরম বাস্তব কথাটি ঘোষণা করার পালা। তিনি যা বললেন, সেটি শুনে সুদামের পায়ের তলার মাটি সরে গেল। তাঁর মনিব আর নেই। তিনি পাগলের মতো ফোন করতে থাকেন তাঁর পরিচিত পঞ্চম-ঘনিষ্ঠদের।

ফোন যায় পঞ্চমের সেক্রেটারি ভরতভাই এবং শক্তি সামন্তের বাড়িতেও। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সেই দুঃসংবাদ। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটেছে। কিন্তু এই ভোর যেন রাতের চেয়েও অন্ধকার। ততক্ষণে একে একে মেরিল্যান্ড অ্যাপার্টমেন্টে এসে পৌঁছেছেন বম্বে ফিল্ম এবং মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির দিকপালেরা। এসে পৌঁছেছেন রিপোর্টারা। বিল্ডিংয়ের বাইরে তখন জনসমুদ্র। চোখের জল যে বড়ই বেয়াড়া। সেই জল তখন চোখে ধরে রাখাই দায়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক

>পঞ্চমের মরদেহ তখন শোয়ানো রয়েছে তাঁর ঘরে। এসেছেন আশা ভোঁসলে। নিয়ে আসা হয়েছে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীনা মীরা দেব বর্মণকে। ছেলের শায়িত দেহের দিকে তাকিয়ে তিনি ঠিক কী অনুধাবন করলেন সেটি অজানা। ততক্ষণে পঞ্চমের শেষযাত্রার প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে। ধীরে ধীরে নামিয়ে আনা হল তাঁর নিথর দেহ। কাঁধ দিলেন অনেকেই। সুসজ্জিত একটি গাড়িতে যত্নে শোয়ানো হল পঞ্চমকে। শম্বুক গতিতে এগিয়ে চলা সেই গাড়ির সামনে এবং পিছনে গাড়ির সঙ্গে হাঁটতে থাকা সেই জনজোয়ারের কথা মায়ানগরী আজও ভোলেনি। গাড়ির ওপর পঞ্চমের শায়িত দেহের পাশে তখন তাঁর অতি ঘনিষ্ঠরা, তাঁর দীর্ঘদিনের সতীর্থরা। সবার চোখ ছলছলে। কেউ চোখ মুচ্ছেন। কেউ মনে মনে তাঁর সঙ্গে কাটানো দিনগুলির স্মৃতিচারণ করছেন। কেউ বা বুকে কান্না চেপে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।

একসময় শববাহী গাড়িটি প্রবেশ করল সৎকার স্থলে। ধীরে ধীরে নামিয়ে আনা হল চিরঘুমে শায়িত আরডি বর্মণকে। শাস্ত্র মেনে কিছু আচারের পর সেই দেহ সমর্পণ করা হল অগ্নিদেবতার কোলে। সুর সাম্রাজ্যের এক সন্ন্যাসী রাজার পার্থিব শরীর বিলীন হয়ে গেল পঞ্চভুতে। বাইরে তখন সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ, সবাই চোখ মুছতে ব্যস্ত। তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই সামিল ছিলেন যাঁরা একসময় সচেতনভাবে উপেক্ষা করে গিয়েছেন আরডি বর্মণকে। তাঁদের চোখের জলকে কুমিরের কান্না বলে অভিহিত করা ঠিক হবে কিনা জানা নেই। কিন্তু হ্যাঁ, তাঁদেরকেও দেখতে পাওয়া গিয়েছিল সেই জনসমুদ্রের মাঝে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

দাঁড়ি পড়ল পঞ্চম অধ্যায়ে। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বর্মণ অধ্যায়ে। প্রায় সাড়ে তিনশোটি হিন্দি- সহ বিভিন্ন প্রাদেশিক ছবিতে নিজের পারদর্শিতার নজির রেখে গেলেন। পিতা শচিন দেব বর্মণের সুযোগ্য এবং একমাত্র পুত্র রাহুল দেব বর্মণ যে সুরভাণ্ডার মুক্তহস্তে উপহার দিয়ে গেলেন আমাদের, সেগুলি আমাদের আজও সমৃদ্ধ করে রেখেছে। সমৃদ্ধ করে রাখবে আগামী প্রজন্মকেও। কিন্তু তবু অবুঝ মন যে মানে না! তাঁকে যে আবারও ফিরে পেতে ইচ্ছে করে আমাদের মাঝে! সর্বশক্তিমানের কাছে অবোধ শিশুর মতো আবদার করতে মনে চায়। হে ঈশ্বর, ফিরিয়ে দাও আমাদের পরমাত্মীয় পঞ্চমকে। তাঁকে ফিরিয়ে দাও তাঁর সেই অফুরান সুরের ডালি সঙ্গে দিয়ে। আমরা আবারও সিক্ত হতে চাই তাঁর সুরের অঝোর বারিধারায়।

পঞ্চমের অমৃতলোক গমনের কয়েক মাস পর মুক্তি পায় ‘১৯৪২ এ লাভ স্টরি’। সাফল্যের নিরিখে সেটি যেন সীমাহীন। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই সীমাহীন। ফলত, পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থাও এ বার কৃপণতা বর্জন করে পুরস্কৃত করতে বাধ্য হলেন পঞ্চমকে। কিন্তু হায়! পঞ্চমহীন সেই সভায় মরণোত্তর সেই পুরস্কার গ্রহণ করবেন কে? মঞ্চে এলেন তাঁর বহুদিনের বন্ধু রণধীর কাপুর। নতমস্তকে গ্রহণ করলেন সেই পুরস্কার। সেটি হাতে নিয়ে পঞ্চমের উদ্দেশ্যে আকাশের দিকে হাতটি ছুড়লেন বার কয়েক। পঞ্চমের মনে বহুদিন ধরে জন্ম নেওয়া গভীর ক্ষতর উপর এ যেনো সামান্য একটি প্রলেপ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি

দেশ চিরতরে হারাল এক ক্ষণজন্মাকে। আর আপামর বাঙালি হারাল তাদের ঘরের ছেলেকে। যে ছেলেটি এতদিন ধরে ঘরে এবং প্রবাসে বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করে গিয়েছে বারংবার। যে ছেলেটির ঝুলিতে রয়েছে পনেরোবার ফিল্মফেয়ার আওয়ার্ডসের নমিনেশন এবং তিন বার ফিল্মফেয়ার আওয়ার্ডস জেতার কৃতিত্ব। যে ছেলেটির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয় হয়ে থেকে যাবে আগামীতেও। যে ছেলেটির জন্ম হয়, কিন্তু মৃত্যু হয় না। যাঁর সৃষ্টি করা মেলোডি বয়ে চলে প্রতিটি প্রকৃত সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের প্রত্যেকটি ধমনীতে।

হে পঞ্চম, আমরা জানি না ঠিক কিভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলে আপনার মাপের একজন সৃজনশীল এবং দুর্লভ প্রতিভার অধিকারী কোনও মানুষকে সুযোগ্য সম্মান প্রদান করা সম্ভব। আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম আপনার চরণযুগলে। আমরা আপনাকে ভুলিনি, ভুলবোও না কোনওদিন।

আপনি যেখানেই থাকুন, খুব ভালো থাকুন। আর আমাদের সমৃদ্ধ করে রাখুক আপনার রেখে যাওয়া মহামূল্যবান সুরসম্পদ, যা আপনি সৃষ্টি করেছেন আপনার মনের মাধুরী মিশিয়ে। যে সুরে মিশে আছে পাখির কলকাকলি, বয়ে চলা নদীর স্রোতের শব্দ, উত্তাল সমুদ্রের গর্জন, মন কেড়ে নেওয়া রাখালবাঁশি, মাটির গন্ধ, এবং যেগুলির পাশাপাশি রয়েছে এক নিদারুণ আধুনিকতার ছোঁয়া।

বেঁচে থাকুন পঞ্চম, বেঁচে থাকুক আপনার মেলোডি। —সমাপ্ত।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content