শুক্রবার ৫ জুলাই, ২০২৪


ফ্রেমবন্দি গ্র্যান্ডেলা। ছবি: লেখক।

আজকের লেখা এই সিরিজের চতুর্থ পর্ব। তাই পাখির ছবি তোলার পিছনে আমার যে লক্ষ্য রয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলা যাক। আমার লক্ষ্য হল ভারতের ১০০০টি প্রজাতির পাখির ছবি তোলা। তার মধ্যে অরুণাচলপ্রদেশের পাখিই হল অন্যতম। কারণ অরুণাচলে এমন কিছু প্রজাতির পাখি আছে, যা শুধু ওখানেই পাওয়া যায়। তাই তাদের আমার তালিকায় রাখতেই হবে।

অরুণাচলপ্রদেশ আসাধারণ সুন্দর একটি জায়গা। যাঁরা সেখানে গিয়েছেন তাঁরা জানেন। হিমালয় ধীরে ধীরে এখানে পূর্বদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া রয়েছে ইন্দো-চিন সীমান্ত। তাই আর্মি ক্যাম্পও অনেক রয়েছে ওখানে। অরুণাচলকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। পূর্ব অরুণাচল, মধ্য অরুণাচল এবং পশ্চিম অরুণাচল। ২০২২ সালের মাঝামাঝি আমি ঠিক করলাম পশ্চিম অরুণাচলে প্রথমে যাব। তারও প্রায় এক বছর পর ২০২৩ সালের মে মাসে আমার সুযোগ হল ওখানে যাওয়ার।
সাধারণত, কোনও জায়গার ছবি তুলতে যাওয়ার সময় আমি সেখানকার স্থানীয় গাইডদের সরাসরি নিজে বুক করেনি। কিন্তু যেহেতু অরুণাচল দুর্গম জায়গা, আর পাখির ছবি তোলার জন্য আমায় অনেক দূর দূর যেতে হবে, তাই আমি একজন ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে বুকিং করলাম। দিলীপ গুপ্ত’র আইভান ট্রিপস বুক করলাম। দিলীপ একজন ভালো ট্যুর অপারেটর এবং বার্ড গাইড। তাঁর এই বিষয়ে বেশ জ্ঞান আছে। তিনি আমায় জানালেন, অরুণাচলে আমাদের অনেক দুর্গম জায়গায় যেতে এবং থাকতে হবে। আর তার জন্য আমাদের ঠান্ডার জামাকাপড়, টুপি, গ্লাভস, টর্চ, ভ্যাসলিন, মশার ওষুধ, বিশেষ ধরণের জুতো আর জোঁকের থেকে বাঁচার জন্য ‘লিচ সক্স’ নিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন:

পাখি সব করে রব, পর্ব-৩: আচমকা বলরাম চেঁচিয়ে বলল, ‘বাপি, বাপি—ওই যে বাপি’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

অরুণাচলের ট্রিপ মোট ৯ দিনের ছিল। এর মধ্যে অনেক জায়গায় যাওয়ার ছিল, যেমন টেঙা ভ্যালি, ঈগলস নেস্ট, বম্পু, ধিরাং, সেলাপাস আর মান্ডালা। আজকের গল্প সেলা পাস নিয়ে। পুণে থেকে বিমানে করে আমি গুয়াহাটি পৌঁছলাম। তার পর দিলীপবাবুর ঠিক করে দেওয়া গাড়িতে করে আমরা উপরে উল্লিখিত জায়গাগুলোতে একে একে গেলাম।

ট্রিপের সপ্তম দিনে (১০ মে ২০২৩) আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোর রাতে অর্থাৎ ৩:৩০-এ উঠে ধিরাং থেকে সেলা পাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। ধীরে ধীরে প্রকৃতি ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ ধারণ করতে লাগলো। এর মধ্যে আবার শুরু হল তুষারপাত। সে এক আলাদাই অনুভূতি। আমি একটি ভিডিও শেয়ার করছি এখানে। সেটি দেখলে ঠিক ধারণা করতে পারবেন কেমন ছিল আশপাশটা। চলতে চলতে সকাল ৭টায় আমরা সেলাপাস পৌঁছলাম।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৮: আমি শুনি গো শুনি তোমারে…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

ওখানে প্রচণ্ড জোর হাওয়া বইছিল, সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা। আমরা সবাই অনেক শীতের পোশাক পরেও ঠকঠক করে কাঁপছিলাম। এ বার আমাদের ভয় হল যে এত ঠান্ডা আর হাওয়ার মধ্যে আদৌ কোনও পাখির দেখা পাওয়া যাবে কিনা। এখানে বলে দেই সেলা পাস সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩,৭০০ ফুট ওপরে। আর এটি তাওয়াংকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে। জায়গাটির নাম সেলা পাস কেন হল, তারও একটা গল্প আছে। সেটা গল্প পরের কোনও পর্বে শোনাবো।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম—আমাদের চিন্তা হচ্ছিল যে, আমরা আদৌ কোনও পাখি পাবো কিনা। কিন্তু ভালো কথা হল, বরফ পড়লে ‘গ্র্যান্ডেলা পাখি’ ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে। আর সেটাই হল। গ্র্যান্ডালা পাখি থ্রাশ প্রজাতির। হিমালয়ের মাঝারি উচ্চতার পাহাড়গুলিতে এই পাখি দেখা যায়— ভারত, ভুটান, নেপাল, তিব্বত আর চিনে। পাখিটি আয়তনে মোটামুটি পায়রার মতো। পুরুষ পাখি গাঢ় নীল রঙের। শুধু পাখনা আর লেজ হালকা কালো। আর স্ত্রী পাখি ধূসর রঙের, সঙ্গে সাদা শরীরে ছিটছিট আছে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১২: জয়রামবাটিতে প্রত্যাবর্তন

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৫: আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে / খুঁজে পেতে আনি খেতে-নয় বড় সিধে সে!…

আমি আর আমার সঙ্গে থাকা ফটোগ্রাফাররা প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে মনের সুখে ওদের ছবি আর ভিডিও তুললাম। ধীরে ধীরে বরফ পড়া বন্ধ হওয়ায় অন্য পাখিরাও বের হল। যেমন ফায়ার টেলড মাইজারনিস, ব্লাড ফেসান্ট, দু’ রকমের রোজ ফিঞ্চ, স্নো পিজিয়ন, ইউরেশিয়ন রেন ইত্যাদি দুর্লভ পাখিরও দর্শন পেলাম। আমার অরুণাচল যাওয়া, বিশেষ করে সেলাপাস যাওয়া সফল হল। অরুণাচলের অন্যান্য পাখিদের বিষয়ে পরের পর্বগুলোতে লিখবো। এর মধ্যে একটা খুব আকর্ষণীয় পর্ব হবে বুগুন লিওচেলাকে (BugunLiocichla) নিয়ে। এই নামটা মনে রাখবেন, আর গুগল করেও দেখতে পারেন।

লেখকের ইনস্টাগ্রাম লিঙ্ক: https://www.instagram.com/shuva.wildlifephotographer/
* শুভদীপ সোম (Shuvadip Som), আইটি ডিরেক্টর, পুণের একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। নেশা ফটোগ্রাফি।

Skip to content