ছবি: প্রতীকী।
মিত্রভেদ
ধর্মের কল যে বাতাসে নড়ে সে কথা আবারও সত্যি বলেই প্রমাণিত হল। রাজপুরুষেরা পাপবুদ্ধিকে শমীবৃক্ষের শাখায় ঝুলিয়ে রেখে সকলে ধর্মবুদ্ধির প্রশংসা করতে গিয়ে বলল—
পশ্যতো বকমূর্খস্য নকুলেন হতা বকাঃ।। (মিত্রভেদ, ৪৩৯)
অর্থাৎ বুদ্ধিমান লোকেদের উচিত কোনও উপায় বা পরিকল্পনা চিন্তা করবার সময়েই সেক্ষেত্রে কী কী বিপদ হতে পারে সে সব চিন্তা করে রাখা। এমনকি বিপদ হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবার রাস্তা গুলোকেও ভেবে রাখা।না হলে সেই মূর্খ বকটির চোখের সামনেই তার বাচ্চাগুলোকে যেমন সেই বেজিটা খেয়ে নিয়েছিল ঠিক তেমন হবে।
ধর্মবুদ্ধি বলল, “কথমেতৎ?”—সে ব্যাপারটা ঠিক কেমন?
রাজপুরুষেরা তখন বললে শুরু করল—
২০: বক ও নকুলের গল্প
কোনও গভীর বনের মধ্যে এক বিরাট বট গাছ ছিল। সেখানে বহু বক একসঙ্গে বাস করতো আর সেই গাছের কোটরেই ছিল একটা কালকেউটের বাসা। সেই সাপটি ছিল মহা বজ্জাত। যে সমস্ত বক শিশুদের তখনও পাখা গজায়নি, উড়তে পারতো না। তাদের ধরে ধরে খেয়েই তার জীবনযাত্রা চলতো। একবার এক বক দিনের শেষে ফিরে এসে তার সব শিশুগুলোকে সাপে খেয়ে নিয়েছে দেখে উদাসীন হয়ে জল ভরা চোখে এক নির্জন সরোবরের ধারে মুখ নিচু করে বসেছিল। তাকে এ ভাবে বসে থাকতে দেখে কোথা থেকে একটা কাঁকড়া এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, মামা গো! আপনি এভাবে বিষণ্ণমুখে বসে আজ কাঁদছেন কেন?
চোখের জল মুছে সেই বকটি তখন বলল, ওহে ভদ্র! কী আর করবো? আমি নিতান্তই ভাগ্যহীন একটি প্রাণী। আমার সব সন্তানদের ওই গাছের কোটরের বাস করে যে কৃষ্ণসর্পটি সেটি খেয়ে নিয়েছে। সেই দুঃখেই নির্জনে এসে একটু চোখের জল ফেলছি। তাই ওই সাপটাকে মারবার যদি কোনও উপায় জানা থাকে তাহলে আমাকে জানাও।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়
মুভি রিভিউ: মহারাজা—নিথিলন, বিজয় ও অনুরাগ একযোগে থাপ্পড় মেরেছেন উগ্র পৌরুষের গালে
তথা প্রবোধ্যতে শত্রুঃ সান্বযো ম্রিযতে যথা।। (ঐ, ৪৪০)
মুখের কথাগুলিকে মাখনের মতন নরম ও হৃদয়গ্রাহী করে নির্দয় চিত্তে শত্রুকে এমনভাবে বোঝানো উচিত যাতে সেই শত্রু সপরিবারে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
সে তখন বলল, মামা গো! এইটাই যদি তোমার দুঃখের কারণ হয়ে থাকে তাহলে তো সহজ উপায় একটা আছে। কয়েকটা মাছ ধরে সেই মাছের মাংসগুলো একটা বেজির গর্তের সামনে থেকে সেই কৃষ্ণসর্পের কোটর পর্যন্ত ছড়িয়ে দাও। তাহলেই দেখবেন সেই মাছের মাংসখণ্ডগুলো খেতে খেতে কেমন সেই বেজিটা সেই সাপের গর্তটা চিনে নেয় আর নেউল যদি সাপকে দেখে তাহলে যে কি হয় সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে আর বুঝিয়ে দিতে হবে না!
বকটি দেখলো এতো খুব ভালো পরামর্শ। কাঁকড়াটি ঠিক যেমন যেমন বলেছিল ঠিক সেইভাবেই কিছু মাছ ধরে একটা বেজির গর্তের থেকে সাপের গর্ত পর্যন্ত সে ছড়িয়ে দিল। কিন্তু তার ফল হল মারাত্মক। বেজিটি তার গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে সেই মাছ খেতে খেতে সাপের গর্তে এসে সাপটিকে তো মারলো, কিন্তু সেইসঙ্গে গাছ বেয়ে উঠে সেই সব বকগুলোকেও মেরে ফেলল।
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই
২০ কাহিনী সমাপ্ত
রাজপুরুষেরা বলল, এইজন্যেই আমরা বলছিলাম, শুধু পরিকল্পনা করলেই হয় না। সেইসঙ্গে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গেলে যে কি কি বিপদের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সে বিষয়েও চিন্তা করতে হয়। এই পাপবুদ্ধি টাকা হাতাবার উপায় চিন্তা করেছিল ঠিকই, কিন্তু বিপদ হলে পালাবার রাস্তা ভেবে রাখেনি, তাই ওর বাপকে মরতে হল।
১৯ কাহিনি সমাপ্ত
গল্প শেষ করে করটক দমনককে বলল, তুমিও সেইরকম নিজের উন্নতির জন্য উপায় ভেবে রেখেছো ঠিকই কিন্তু যখন এই সঞ্জীবক আর পিঙ্গলকের দ্বন্দ্বযুদ্ধে স্বামীর প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তখন এই বিপদ থেকে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায় পাপবুদ্ধির মতন সে কথা চিন্তা করে রাখোনি। এবার তার ফল ভোগ করো। তুমি যে সজ্জন নও সেটা আমি জানি।তুমি একজন পাপবুদ্ধি মাত্র। ভালো কথা তোমার কানে ঢোকে না। লোকের ভালো তুমি দেখতে পাও না। বেশ বুঝতে পারছি যে তোমার জন্যেই এখন স্বামী পিঙ্গলকের জীবনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নিজের দুষ্টবুদ্ধি এবং ধূর্ততাকেই কেবল প্রকট করেছো তুমি। তোমার মানসিকতাটাই এমন।
সেই বলে না? ময়ূর যদি বর্ষায় মেঘধ্বনি শুনে পেখম তুলে পাগলের মতো নাচন না শুরু করে তাহলে লোকে চেষ্টা করেও তার আহার নিঃসরণের পথ মানে পশ্চাৎ-দেশের ফুটোটাও খুঁজে পেত না। তোমার হল সেই অবস্থা। নিজের স্বার্থ চিন্তায় এমন পাগল হয়েছো তুমি যে সকলেই এখন তোমার মতো পাপবুদ্ধিকে এখন বেশ চিনে নিয়েছে। সত্যি বলতে তোমার সঙ্গে চলাফেরা করতেও এখন আমার ভয় লাগছে। আমাদের স্বামী পরাক্রমী সিংহপিঙ্গলকের যখন এমন দশা করতে পারো তুমি তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কি অবস্থা করতে পারো তুমি সেটা ভেবেই আমার এখন ভয় লাগছে। তাই তোমার সঙ্গ ত্যাগ করাটাই আমার পক্ষে ভালো হবে। সেই গল্পটার কথা জানো তো? যেখানে একহাজারপল ওজনের তুলাদণ্ড ইঁদুরে খেয়ে নিয়েছিল?
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩
করটক তখন বলতে শুরু করল—
২১: লৌহনির্মিত তুলাযন্ত্র এবং বণিকপুত্রের কাহিনি
কোনও এক দেশে জীর্ণধন নামে এক বণিকপুত্র ছিল। নামেই বোঝা যাচ্ছে তার আর্থিক অবস্থাটা ঠিক কেমন ছিল। ব্যবসাবাণিজ্যে তার প্রচুর অর্থিক ক্ষতি হয়ে যাওয়ায় সে একবার দেশান্তরে যাওয়ার কথা চিন্তা করল। শাস্ত্রে বলে—যে দেশে বা যে স্থানে কোনও ব্যক্তি একসময়ে নিজের পরাক্রমে বহু ভোগবিলাসে জীবন কাটিয়েছে, ধনহীন অবস্থাতেও সে যদি সেখানেই বাস করে তবে তাকে অধম ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। কারণ টাকাপয়সা থাকায় যে স্থানে এককালেকেউ অনেক দাম্ভিকতার সঙ্গে বোল-চাল বজায় রেখে দিন কাটিয়েছে, পরে ধনহীন হয়ে সেখানেই যদি সে দীন-হীনের মতো আচরণ করে তবে তার সম্মানটা আর কোথায় থাকে? সকলের কাছেই সে তখন একটি মোজার খোড়াকে পরিণত হয় মাত্র।
সেই জীর্ণধনের গৃহে পিতৃপিতামহের সময়ে উপার্জিত একটি এক-হাজার পল পর্যন্ত ওজন করার মতো একটি তুলাযন্ত্র ছিল। সম্পত্তির বিচারে সেটি বেশ দামি একটি দ্রব্য। কিন্তু এতোবড় জিনিষকে তো আর বাড়িতে ফেলে রেখে দেওয়া যায় না! চোর ডাকাতের ভয় আছে। তাই সেটা এক প্রতিবেশী শ্রেষ্ঠীর কাছে গচ্ছিত রেখে ভাগ্যান্বেষণে দূরদেশে চলে গেল। এরপর দেশদেশান্তর ঘুরে বহুদিন পর সে যখন আবার একদিন নিজে দেশে ফিরে এল তখন প্রথমেই সেই শ্রেষ্ঠীর কাছে গিয়ে সেই তুলাযন্ত্রটি ফেরৎ চাইল— “ভোঃ শ্রেষ্ঠিন্! দীযতাং মে সা নিক্ষেপতুলা।” —ওহে শ্রেষ্ঠী! সেই নিক্ষেপ-তুলাযন্ত্রটি এবার আমাকে তবে ফিরিয়ে দিন।
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার
জীর্ণধন বুঝল সবটাই কিন্তু মুখে কিছু বলল না। হতাশা দেখিয়ে বলল, সত্যিই যদি ইঁদুরে খেয়ে যায় তাহলে তো তোমার কোনও দোষ নেই ভাই। কী আর করা যাবে? এই সংসারটাই এমন যেখানে কোনও বস্তুই দীর্ঘকাল টিকে থাকে না।আমি বরং নদীতে স্নানে যাই। তোমার এই পুত্র ধনদেবকে একটু স্নানের উপকরণ নিয়ে আমার সঙ্গে দাও।
শ্রেষ্ঠী সেই তুলাযন্ত্রটি চুরি করায় কিছুটা ভয়ে ছিল। জীর্ণধন তার পুত্র ধনদেবকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে সে আর বাঁধা দিল না। বরং পুত্রের কাছে গিয়ে বলল, ওহে বত্স! এ তোমার কাকা, আমার ভ্রাতৃপ্রতিম। ইনি স্নানের জন্য নদীতে যাচ্ছেন, তুমি এর স্নানের অন্যান্য সামগ্রীগুলো নিয়ে যাও।পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেন, ভয়, লোভ কিংবা কোনও প্রয়োজন বাদে অন্যকোনও অবস্থায় কোনও লোক সশ্রদ্ধায় কারোও ভালো করে না। শাস্ত্রবাক্যে যথার্থই বলা হয়েছে,
তত্র শঙ্কা প্রকর্তব্যা পরিণামেঽসুখাবহা।। (ঐ, ৪৪৬)
অর্থাৎ অপ্রয়োজনে যখন কেউ কাউকে অতিরিক্ত সম্মান করতে শুরু করে তখন নিশ্চিতভাবে এটা সন্দেহ করা যেতেই পারে যেকার্যকারণ বিহীন সেই সম্মানের পরিণাম খুব একটা সুখের হবে না। পিতৃপিতামহের সময়ের উপার্জিত দামী সেই তুলাযন্ত্রটি ইঁদুর খেয়ে নিয়েছে বলার পরও যখন জীর্ণধন কিছু না বলেই সেই শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছিলেন তখন ব্যাপারটা বোঝা উচিত ছিল যে এর পরিণামটা খুব একটা ভালো হবে না।—চলবে।