বৃহস্পতিবার ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

ভগবান শ্রীনারায়ণকে রুক্মপুরে নিজের বাড়িতে দেখে গরুড় লজ্জায় একেবারে মুখ নিচু করে রইল। প্রণাম করে সে নারায়ণকে বললেন, হে ভগবন! আপনি সমুদ্রে মহাশয্যায় শেষনাগের উপর শুয়ে থাকেন আর সেই সমুদ্র আপনার আশ্রয় দিচ্ছে এই ভেবে একেবারে মদোন্মত্ত হয়ে গিয়েছে। অকারণে কেবল পরিহাসের জন্য আমার ভৃত্য এক টিট্টিভ দম্পতীর ডিমগুলোকে সে চুরি করে নিয়েছে। এটা আমার অপমান। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা ও সঙ্কোচের কারণেই শুধু আমি চুপ করে বসে আছি, তা না হলে এই সমুদ্রের জলভাগ শুকিয়ে এতক্ষণে একে স্থলভাগে পরিণত করে দিতাম। নেহাৎ আপনি তাঁর স্বামী। স্বামীর ভয়ে লোকে তার পোষ্য কুকুরকেও মারে না। তাই আপনার সম্মানহানির কথা চিন্তা করে সমুদ্রকে আমি কিছুই বলিনি। পণ্ডিতেরা বলেন, যে কাজ করলে স্বামীর সম্মানহানি হয় বা স্বামীর মনে পীড়া উত্পন্ন হয় একজন সত্কুলে জাত সেবকের প্রাণ থাকতে সেইরকম কাজ করা উচিত নয়।

ভগবান নারায়ণ বুঝলেন, গরুড় ভীষণভাবে কুপিত এবং অপমানিত। নেহাৎ নারায়ণের প্রতি শ্রদ্ধায় সে অবনত— না হলে এতক্ষণে হয়তো সমুদ্র শুকিয়ে দিয়ে সৃষ্টি বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলতো। তাই কিছু একটা করা প্রয়োজন। সবক্ষেত্রে নির্লিপ্ত হয়ে থাকা যায় না। ভগবান স্মৃত হেসে বললেন, হে বৈনতেয়! আপনি যথার্থই বলেছেন। শাস্ত্রে বলে—
ভৃত্যাপরাধজো দণ্ডঃ স্বামিনো জাযতে যতঃ।
তেন লজ্জাঽপি তস্যোত্থা ন ভৃত্যস্য তথা পুনঃ।। (মিত্রভেদ, ৩৫৪)


অর্থাৎ ভৃত্য যদি কোনও অপরাধ করে তার দণ্ড স্বামীকেও পেতে হয়, এইটাই জগতের নিয়ম। তাই তাকে কেউ শাস্তি দিলে লজ্জায় স্বামীর মুখই নত নয়, ভৃত্যের হয়তো কিছুই এসে যায় না। সবসময়েই রাজার অপমান তাঁর অনুচরের জন্যেই হয়ে থাকে। অনুচরদের দোষেই রাজারা অপমানিত হয়। তাই আপনি আমার সঙ্গে সমুদ্রের কাছে চলুন। প্রথমে তার কাছ থেকে ডিমগুলিকে ফিরিয়ে এনে টিট্টিভ দম্পতীকে প্রসন্ন করে তবে আমরা অমরাবতী যাব।
গরুড়ের সঙ্গে সমুদ্রবেলায় এসে উপস্থিত হয়ে শ্রীভগবান এক অগ্নিবাণ ধনুতে সন্ধান করে সমুদ্রকে ভর্ত্সনা করে বললেন, ওরে দুরাত্মা! অবিলম্বে টিট্টিভের ডিমগুলো ফিরিয়ে দে। তা না হলে তোকে শুকিয়ে স্থল বানাতে বেশী সময় লাগবে না আমার। শ্রীনারয়ণকে রুদ্রমুর্তিতে দেখে সমুদ্র আর টু শব্দটিও করল না। দ্রুত টিট্টিভ দম্পতির ডিমগুলো সে ফিরিয়ে দিল।
 

১২ কাহিনি সমাপ্ত

দমনক কাহিনি শেষ করে বললে, সেই জন্যেই আমি বলেছিলাম যে ব্যক্তি শত্রুর পরাক্রমকে না বুঝেই যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে যায় সে নিজে বলবান হলেও শত্রুর কাছে সে নিশ্চিতভাবে পরাজিত হয়। সমুদ্রকে কি আপনার কম বলবান মনে হয়, কিন্তু বাহুবলেই শুধু যুদ্ধ জয় করা যায় না। তার জন্য চাই মিত্রশক্তি। কার সঙ্গে কোনও ক্ষমতাশালী ব্যক্তির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক কতটা নিবিড়, যুদ্ধজয়ের ক্ষেত্রে সে সব দিকও বিবেচনা করতে হয়। তাই বলে উদ্যোম ত্যাগের কথা আমি বলছি না। ঝগড়ায় যেতে হলে সবদিন বিচার-বিবেচনা করেই অগ্রসর হওয়া উচিত।
দমনকের কথাগুলোকে চিন্তাভাবনা করে তাকেই আবার সঞ্জীবক জিজ্ঞাসা করলে, ওহে মিত্র! তাহলে আপনিই বলুন কীভাবে আমি বুঝবো যে সে আমার প্রতি কুপিত বা আমাকে হত্যা করবার জন্য কোনও বদমতলব আঁটছে। এতকাল পর্যন্ত যতদিন গিয়েছে ততই সে আমার প্রতি প্রসন্নতা দেখিয়েছে। প্রতিদিন আমাদের দুজনের মধ্যে স্নেহবন্ধন নিবিড় হয়েছে। কোনও দিনই আমার প্রতি তাঁকে বিরূপ হতে দেখিনি। তাই আপনিই বলুন কী লক্ষণ দেখে আমি তাঁকে হত্যা করবার কথা চিন্তা করবো?

আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪২: রাজকোষে সঞ্চিত সোনা-রূপা-ধান্যাদি সবই প্রজাবর্গের, রাজার ব্যক্তিগত নয়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন

দমনক ধুরন্ধর প্রাণী। কীভাবে একজনের সম্পর্কে অন্যের মনে বিষ বপন করতে হয় সে ভালোই জানে। সঞ্জীবককে সে বলল, হে ভদ্র! এটা না বুঝতে পারার কোনও কারণ আছে কি? যদি তুমি দেখো যে তাঁর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে কিংবা ভ্রুকুটি কুটিল করে জিহ্বায় দিয়ে অধরোষ্ঠের প্রান্তভাগ লেহন করছে (সিংহ রেগে গেলে বা কোনও প্রাণীকে আক্রমণ করবার পূর্বে এইরকম আচরণ করে) তাহলেই বুঝবেন যে সে আপনার প্রতি দুষ্টবুদ্ধি পোষণ করছে, অন্যথায় বুঝতে সে আপনার প্রতি সুপ্রসন্ন। সম্ভবত স্বামী পিঙ্গলকের মন বোঝার এর থেকে সহজ উপায় কিছু নেই। যাইহোক, এ বার আমাকে অনুমতি দিন আমি নিজ গৃহে ফিরে যাই। আমাদের দু’জনের মধ্যে এই কথা যেন পাঁচ কান না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আমার পরামর্শ হল যদি যাওয়ার কোনও জায়গা থাকে তবে রাত্রি নামবার আগেই প্রাণ থাকে কোথাও একটা চলে যাওয়াই ভাল। রাজনীতিজ্ঞরা কী বলেন জানেন তো? তাঁরা বলেন, একজন ব্যক্তিকে বিসর্জন দিলে যদি গোটা পরিবারটা বেঁচে যায়, সেক্ষেত্রে পরিবারের একজনকে ত্যাগ করাই শ্রেয়; তেমনই ভাবে একটি পরিবারের জন্য যদি গোটা একটা গ্রাম রক্ষা পায়, তবে নিশ্চয়ই সেই পরিবারের মায়া ত্যাগ করতে হবে। তেমনইভাবে দেশ বাঁচাতে বুদ্ধিমান ব্যক্তির একটি গ্রামকেও প্রয়োজনে ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে প্রয়োজনে পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে। সেক্ষেত্রে পিঙ্গলকের বিচরণভূমি সামান্য এই জঙ্গল আর কতটুকু। তাই আমার মনে হয় তোমার এখনই বেলা থাকতে থাকতে এই জঙ্গল ছেড়ে স্বামী পিঙ্গলকের নাগালের বাইরে দূরে কোথাও একটা চলে যাওয়াটাই শ্রেয়। পণ্ডিতরা বলেন—
আপদর্থে ধনং রক্ষেদ্ দারান্ রক্ষেদ্ধনৈরপি।
আত্মানং সততং রক্ষেদ্ দারৈরপি ধনৈরপি।। (ঐ, ৩৮৭)


অর্থাৎ মানুষের উচিত ভবিষ্যৎ বিপদ-আপদের কথা চিন্তা করে ধনসঞ্চয় করা; প্রয়োজনে সঞ্চিত সেই অমূল্য ধনসম্পদ দিয়ে হলে স্ত্রীকে রক্ষা করা উচিত। কিন্তু সেই সঞ্চিত ধনসম্পদ হোক বা স্ত্রী, নিজেকে বাঁচাতে প্রয়োজনে সবকিছুই ত্যাগ করতে হবে। সাধে কি বলে, “আপনি বাঁচলে বাপের নাম!” তাই বলবান শত্রুর বিষ নজরে পড়লে দুর্বলের উচিত নয় বিদেশে আত্মগোপন করা কিংবা তাঁর বশ্যতা মেনে নেওয়া। আমার তো মনে হয় এই পরিস্থিতিতে আপনার পালিয়ে যাওয়াটাই শ্রেয়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ

মগধরাজ জরাসন্ধের বারংবার আক্রমণের ভয়ে মধুরাবাসীরা স্বয়ং বাসুবেদ শ্রীকৃষ্ণেরই পরামর্শে নাকি মথুরা নগরীও ত্যাগ করে দ্বারকায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাই প্রাণ থাকতে তোমার পালিয়ে যাওয়াটাই শ্রেয়। না হলে সেই সাম-দান-ভেদ-দণ্ড এই উপায় চতুষ্টয়ের প্রয়োগ করতে পদে পদে নিজেকে রক্ষা করে চলতে হবে সবসময়ে। সেটা খুবই বিপজ্জনক। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে জীবনের ন্যায়-নীতির রহস্য যাঁরা জানেন তাঁদের উচিত প্রয়োজনে স্ত্রী-পুত্রদের পরিত্যাগ করে হলেও অন্যত্র কোথাও পালিয়ে গিয়ে নিজের প্রাণরক্ষা করা উচিত। কারণ প্রাণে বাঁচলে মানুষের আবার স্ত্রী-পুত্র সবকিছুই ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, প্রাণে না বাঁচলে কিছুই থাকে না। যে মুর্খ ব্যক্তি মৃত্যু আসন্ন জেনেও ধনসম্পদ জমিয়ে রেখে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে না তাঁর মৃত্যু তো নিশ্চিত। এমনকি তাঁর মৃত্যুতে ধনসম্পদও আর তাঁর নিজের থাকে না।

দমনক নানা ভাবে আকারে-ইঙ্গিতে কিছুটা স্পষ্টভাবেই বৃষ সঞ্জীবককে প্রাণে বাঁচতে সিংহ পিঙ্গলকের বিচরণ ক্ষেত্র থেকে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে বলল। এরপর দমনক বৃষ-সঞ্জীবকের মনে সিংহ-পিঙ্গলকের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে অবশেষে ফিরে এল করটকের কাছে। দমনককে আসতে দেখেই চিন্তিত করটক তাঁর কাছে গিয়ে বলল— “ভদ্র! কিং কৃতং তত্র ভবতা?” আপনি কি কি করলেন সেখানে আমাকে সবটা বলুন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার

দমনক বললেন, “মযা তাবন্নীতিবীজনির্বপনং কৃতং পরতো দৈববিহিতাযত্তম্”। আমি রাজনীতির বিষের বীজটা দু’জনের মনের মধ্যে একেবারে ভালোভাবে পুঁতে দিয়ে এলাম। এরপর উপরওয়ালা কি করেন সেটাই দেখবার। দু’জনে যাতে দু’জনকে আজ থেকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে এইটুকুই শুধু আমি করতে চেয়েছিলাম। কারণ ভাগ্য সহায় না হলেও উদ্যোগী নীতিমান মানুষের উচিত নিজের দোষগুলোকে মুছে ফেলে ধৈর্য ধরে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করা। কারণ—
উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মী
র্দৈবং হি দৈবমিতি কাপুরুষা বদন্তি।
দৈবং নিহত্য কুরু পৌরুষমাত্মশক্ত্যা
যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি কোঽত্র দোষঃ।। (ঐ, ৩৯২)


যে পুরুষ সিংহের ন্যায় পরাক্রমী এবং উদ্যোমী তার কাছে ভাগ্যলক্ষ্মী স্বয়ং প্রকটিত হোন আর ভাগ্যের উপর ভরসা তো কেবল কাপুরুষেরাই করে। ভাগ্যের উপর দোষ দিয়ে কোন কাজেই তারা উদ্যোগী হয় না; সব সময়েই তারা ভয় পায় ভাগ্য বিপর্যয়ের। তাই ভাগ্যের উপর ভরসা না করে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে পুরুষার্থ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাতেই নিজেকে মগ্ন রাখা উচিত। নিজের উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা মানুষকে নিজেকেই জন্য করতে হয়; আর চেষ্টা করেও যদি তাতে অসফল হয় তাতে লজ্জার কিছুই নেই, বরং চেষ্টা না করাটাই কাপুরুষতা। আমি অন্তত দু’জনের মধ্যে ভেদ ঘটাবার চেষ্টাটা করলাম। এ বার সেটা সফল হল কি হল না সেটা সময় বলবে।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content