
ছবি : প্রতীকী।
মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
মন্থরককে এইভাবে বেঁধে ধনুকের ডগায় টাঙিয়ে নিয়ে যেতে দেখে হিরণ্যক অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে বিলাপ করতে শুরু করল। দুঃখ যেন তার কাছে ক্রমশ সাগরের মতো বিশাল হয়ে উঠছে। নিজের দেশ এবং আত্মীয়বর্গকে হারিয়ে সবে যখন সে নতুন দেশে এসে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখছে তখনই আবার নতুন বন্ধু মন্থরকের এই বিপদ। এক দুঃখের সমুদ্র পার হতে না হতেই দ্বিতীয় দুঃখ এখন তার সামনে। দুঃখের যেন শেষ নেই তার জীবনে। আসলে সময় যখন খারপ যায় তখন কোনও কিছুই আর যেন ঠিক মতন হয় না। খারপ সময় চললে সব কিছুই পর পর কেবল খারাপই হতে থাকে— “ছিদ্রেষ্ববর্থা বহুলী ভবতি”। ঘটে অনেক ছিদ্র থাকলে শত চেষ্টাতেও ঘট যেমন জলে ভেসে থাকতে পারে না, প্রাণীর জীবনও সেই রকম।
জীবনে বিপদ যদি একবার আসবার পথ পেয়ে যায়, তখন সে বারে বারে আসতে শুরু করে। যেমন, সমতল ভূমিতে মানুষ যখন চলে তখন তাঁর কোনও পদস্খলন হয় না। কিন্তু যখনই সে উঁচু-নীচু রাস্তায় চলতে শুরু করে, তখনই পদে পদে তাঁকে হোঁচট খেতে হয়। যুদ্ধের সময়ে শুদ্ধ বাঁশের তৈরি কোমল অথচ শক্ত ধনুক যেমন পাওয়া কঠিন তেমন বিপদের সময়ে সত্কুলে জাত কোমল এবং শক্ত মনের বন্ধু পাওয়াও কঠিন। হিরণ্যকের দুঃখের জায়গাটা এখানেই। সত্যি বলতে মানুষ মিত্রদের উপর যে পরিমাণ বিশ্বাস ও ভরসা করে মা-বাবাকে অতো ভরসা করে না।
প্রথমত: ধনহীন অবস্থায় মানুষের পরম আশ্রয়ের স্থান হয় একজন বন্ধু।
দ্বিতীয়ত: গোপন কথা বলার মতো একজন মানুষ।
তৃতীয়: লাভটি হল বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়। একজন বন্ধু সহায় হলে মানুষ কঠিন থেকে কঠিনতম বিপদ থেকেও বেরিয়ে আসতে পারে।
হিরণ্যক বিলাপ করতে করতে বলল, দ্বিতীয় কেউ আর আমার এই মন্থরকের মতন একজন বন্ধু হতে পারবে না। জানিনা কেন বিধাতা আমার উপর এইভাবে বিপদ-বাণ বর্ষণ করছেন! প্রথমে যা সম্পদ ছিল বিধাতা তা সব কেড়ে নিলেন। তারপরে হল আত্মীয়নাশ, এমনকি নিজের দেশ পর্যন্ত ছাড়তে হল। এখন যে বন্ধুর কাছে এসে একটি শান্তি পেয়েছিলাম তাকেও বিধাতা আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিলেন। হয়তো এইটাই মানুষের জীবনের ধর্ম। শরীর ধারণ করা মানেই দুঃখ। নশ্বর এই শরীরের মতো ধনসম্পত্তিও ক্ষণেকের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। জীবন মানেই কেবল আসা আর যাওয়ার খেলা। আঘাতের জায়গাতেই বারবার আঘাত লাগে। সম্পদ নষ্ট হলে পেটে যেমন খিদের আগুন জ্বলতে শুরু করে ঠিক তেমনই সেই হতভাগ্যের শত্রুও তখন বাড়তে থাকে। তাই এইটাই প্রমাণিত যে বিপদের অনর্থও অনেক বেড়ে যায়। লোকে ঠিকই বলে যে দুঃসময় উপস্থিত হলে বা বিপদের সময়ে একমাত্র বিশ্বাসের পাত্র এই “বন্ধু” নামক দু-অক্ষরের শব্দটি শোনবার মতো শান্তি আর দ্বিতীয় কোথাও নেই।

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১৭: কুক্কুটজাতক-চিনে নাও বন্ধু কে?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৩: ভাগ্যের দোহাই দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না

ঈশ্বর কী সাড়া দেন তামিলে, সংস্কৃতে?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৩: গ্রহের ফের
চিত্রাঙ্গ অত্যন্ত উত্সাহিত হয়ে বলল, ভদ্র লঘুপতনক! তোমার এই পরিকল্পনাটা অসাধারণ। মনে হচ্ছে মন্থরককে আমরা ঠিক ছাড়িয়ে আনতে পারবো। কথায় আছে—
প্রথমং সর্বজন্তুনাং তৎ প্রাজ্ঞো বেতি নেতরঃ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ১৯৪)

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৬: এক সন্ধ্যায় মা সারদার বলা ভূতের গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৭: উত্তরণ-অবতরণ শেষে স্বপ্নের ‘সূর্যতোরণ’
সকলের চোখমুখের ভাষা বুঝে নিয়ে চিত্রাঙ্গ বলল, “তদেবং ক্রিযতাম্” — চলো আমরা তবে এইটাই করি।
সকলে পরিকল্পনা মতো কাজ করল। শিকারী দেখলো জলাশয়ের পাশে সেই মরা হরিণটা পড়ে আছে আর একটা কাক তার মাথার উপর বসে ঠোকরাচ্ছে। সে তখন অত্যন্ত খুশি হয়ে ভাবল, হরিণটার ভাগ্যে আর আয়ু ছিল না। ফাঁসটা কেটে কোনোক্রমে পালালেও জঙ্গল পর্যন্তও আর যেতে পারেনি। ফাঁসের যন্ত্রণাতেই মৃত্যু হয়েছে। এই কচ্ছপটা তো বেশ ভালোভাবেই বাঁধা আছে, সুতরাং যাই গিয়ে হরিণটাও একটা ব্যবস্থা করি। আজ ঈশ্বর অত্যন্ত্র সদয় হয়েছেন —দু-দু’টো শিকার আজ ভাগ্যে জুটেছে।
এইসব ভাবতে ভাবতে সে কচ্ছপ মন্থরককে মাটিতে নামিয়ে হরিণের মাংসের লোভে চিত্রাঙ্গের দিকে দৌড়াল। হিরণ্যক বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে তার বজ্রের মতন শক্ত দাঁত দিয়ে মন্থরকের পাশ কেটে টুকরো টুকরো করে দিল। মন্থরকও কুশপাশ থেকে মুক্ত হয়ে দ্রুত গিয়ে পাশের জলাভূমিতে লুকিয়ে পড়ল। চিত্রাঙ্গও অপেক্ষা করছিল মন্থরকের পালানো পর্যন্ত। ব্যাধটা তার দিকে আসতে আসতেই সে দৌড়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে পড়লো আর কাল লঘুপতনকও উড়ে পালালো গাছের মগডালে। ব্যাধ এদিকে চিত্রাঙ্গকে এইভাবে লাফিয়ে পালাতে দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। হাতের সামনে থেকে শিকারকে এইভাবে পালাতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই সে অত্যন্ত হতাশ হয়ে গেলো। দুঃখিত মনে ফিরে এসে দেখো কচ্ছপও নেই—সেও পালিয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো সে মাটিতে।

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০২: ভরতের মতো একমুখী লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কী সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১২: দারুণ এক গগনবিহারী খেলনা বানিয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ
এই রকম বিলাপ করতে করতে সেই ব্যাধটি নিজের ঘরে চলে গেলো। তারপর সেই কাক, কচ্ছপ, হরিণ আর ইঁদুর দূরে সেই ব্যাধকে চলে যেতে দেখে মহানন্দে যে যার লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে পরস্পরকে আলিঙ্গন করতে শুরু করল। এ যেন তাদের দ্বিতীয় জন্ম ফিরে পাওয়া।—চলবে।