শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় দিনে বিশ্ব নারিকেল দিবস। সেই কবেই রবিগুরু বলেছেন, “নারিকেলের শাখে শাখে ঝোড়ো হাওয়া কেবল ডাকে, ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে বইছে নগনদী/ সাত রাজার ধন মানিক পাব সেথায় নামি যদি”…. এবং সেই কারণেই এই দিবস। নারকেলের চাষে দারিদ্র্যের নাশ ইত্যাদি অর্থকরী সম্ভাবনার কথা ভেবেই ইন্টারন্যাশনাল কোকোনাট ডে, আন্তর্জাতিক ডাব-নারিকেল দিবস।

ডাবের জল আর নারকেলের শাঁস… এই নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষ অনেক ভেবেছে। সংস্কৃতে নারিকেল, নালিকের ইত্যাদির কথা শোনা যায়, মারাঠী নরাল শব্দের অস্তিত্বের সঙ্গে নারিকেলের যোগ থাকতে পারে মনে করা হয়। সে যাই হোক, কোথাও কোথাও জেলেরা সমুদ্রে নামার আগে সমুদ্রে নারকেল চড়ায়। আবার, সাহিত্যের পাড়ায় কোনও কবির আপাত দুষ্পাচ্য বাগ্বৈদগ্ধ্যকে কঠোর নারকেলের সঙ্গে তুলনা টানা হয়েছে।
নারকেল ভাঙতে পারলে যেমন স্বাদু শাঁসের কাছে পৌঁছনো যায়, তেমনই নাকি কবি ভারবির বাণী বুঝতে পারলে তা পরম উপাদেয়। না বুঝলে পাঠক-শ্রোতৃবর্গ তেমন পক্ব নয়, সেটাও বুঝি সঙ্গেই বলে দেওয়া গেল। নরনারীর দল নারিকেলে আস্থা রাখে বলা বাহুল্য। নারিকেলের দলও তাদের সহজাত চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।

সে যাই হোক, কাঁচা নারকেল মানে, ডাব বেশি ভালো নাকি, পাকা অন্তরে শ্বেতশুভ্র পরিণত ফল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত হবেই এ ব্যাপারে সন্দেহ নাস্তি। কেউ কেউ বড় হলেও চিরশিশু, বাচ্চাদের সঙ্গেই দোস্তি তাদের বেশি। তারা কি অপাঙক্তেয়? ডাবের জল বহুগুণে মণ্ডিত। পেটখারাপ থেকে অজীর্ণ, অপুষ্টি থেকে বমিতে ডাবের জল ঠিকঠাক। নারকেল হজম করতে তুলনায় অনেক সামর্থ্য দরকার, তাই বোধ হয় যে, বাগ্বৈদগ্ধ্যের সঙ্গে নারিকেলের তুলনা।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫১: ভেলোটা দাঁড়িয়ে হোথা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬২: শ্রীমার দক্ষিণ ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন

ঝুনো নারকেল কিংবা ঝানু গোয়েন্দা, এদের “লেবেল” আলাদা…দুহাতে দুটো নারকেলের মালা নিয়ে ধনঞ্জয়ের একটা আস্ত শ্যাওলা-ধরা উঠোন মুহুর্তে তকতকে করে তোলা গল্প নয়, সত্যিই। যে বহিরাবরণ ভেদ করতে পারলে লোভনীয় শাঁসের হাতছানি, সেই নারকেলের মালার আকর্ষণ নারকেলের নাড়ুর চেয়ে কম নয়। নারকেল বেটে, চেটে, মেখে, কামড়ে, চিবিয়ে যেকোনোভাবে খাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক

শুধু নারকেল নয়, নারকেল গাছও কি কম উপকারের? নারকেল গাছ টাওয়ারের কাজ করে, নারকেল গাছে উঠে বিশ্বদর্শন করা যায়, ডাকাতের হাত থেকে বাঁচতে একবার নারকেল গাছে উঠে পড়তে পারলে আর সমস্যা নেই। সেখানে থেকে যাওয়াও যাবে। ডাবের জল আর নারকেল খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যাবে ক’দিন। পাড়ায় হনুমান এলে নারকেল গাছে চড়ে বসে। নারকেল পাতা দিয়ে ঝাঁটা বানানো যায়। ঝাঁটা ধুলো পরিষ্কারের পাশাপাশি জাতীয় অস্ত্র হিসেবেও উপযোগী। ডাব নারকেল খেয়ে প্রাণরক্ষার পাশাপাশি ছুড়ে আত্মরক্ষাও করা যায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো

ডাবের জলে পেট আর নারকেলের তেলে মাথা ঠান্ডা হয়। ডাব নিয়ে একটা সংশয় মনে থাকে, অতবড় একটা ফলের জলটুকু ছাড়া বাকিটা খাওয়ার কাজে লাগানো যায় না মোটে। মানুষ সেই সমস্যা মিটিয়ে ফেলেছে ডাবচিংড়ি রেঁধে আর ধুনুচিতে ডাবের শুকনো খোলা কাজে লাগিয়ে। কিন্তু বর্ষায় ডাবের খোলায় জল বেঁধে থাকলে মশা ডিম পেড়ে আপনাকে পেড়ে ফেলার ব্যবস্থা করে বছর বছর। ঝাঁটা দিয়ে মশা তাড়ানো সম্ভব কীনা কে জানে! এমন কঠোর-স্বাদুর যুগল বৈপরীত্য মানুষের মধ্যেও থাকে বৈকি! আপাত অগম্য কিন্তু হৃদয়গুণসম্পন্ন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৮: নন্দিতা কৃপালনি— বিশ শতকের বিদুষী

তবে নারকেল হয়ে ওঠা যায় না, গোল হলেই নারকেল হওয়া যায় না, এমন আন্তরিক সৌন্দর্য্য বুঝি অনুকরণে আসে না, স্ফুরিত হয়, জেগে ওঠে। ভৌগোলিকরা বলেন, পৃথিবীটা নাকি কমলালেবু কিংবা ন্যাসপাতির মতো। ভূগোলে তাই বলে হয়তো, তবে পৃথিবীর বুকে জেগে ওঠা জীবনগুলো নারকেলের মতোই, শক্ত…যতো গভীরে যাত্রা করে তার অন্তর্লোকের শুভ্রসৌন্দর্য জেগে ওঠে, আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। যাই হোক, এতকিছু সম্ভব যদি নারকেল গাছগুলো টিকে থাকে তবেই! নতুন ইমারতের শুভ সূচনার নারকেলগুলো তো গাছ থেকেই আসে বটে!
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content