শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


বৈরাগ্যের রং গৈরিক। ছবি: প্রচেতা।

 

বৈরাগ্য

কীরা কাকিমাকে আপন করে না নিতে পারার আরেকটা কারণ হল, সে তো ঠিক বাঙালি বাড়ির বউ মানুষ নয়। শক্তপোক্ত কর্মঠ একজন ডাক্তার। আপ্রাণ শেখার ইচ্ছে থাকলেও বাংলাটাকে সে একেবারেই বুঝতে পারত না। ফলে ভাষার দূরত্বটাই মানসিক দূরত্বের আরেকটা কারণ হয়ে উঠেছিল। আরও কারণ আছে ফুলকাকার বিয়ে হল ৭১ সালে ৭২ এ জন্মালো বড় মেয়ে রোসিন। পুত্রবধূর মতোই বড় নাতনিকে ছবিতে দেখলেন স্বর্ণময়ী। তখন মোবাইল ফোনও নেই ভিডিও কল নেই, ছবি ছাড়া দেখবেন কিসে। দু-বছর পর ৭৩-এ জন্মালো ছোট মেয়ে শ্যানন। তার কথাও অন্যের কাছে জানলেন, শুনলেন আর দেখলেন ছবিতে।

ফুল কাকার সঙ্গে ট্রাঙ্ককলে কথা হয়েছে। কীরা কাকিমা খুব কষ্ট করে প্রতিবার বিজয়া বা নববর্ষে চোটলাগা বাংলায় বলেছেন, “সুব্যো বিজায়া মা। অমাদের প্র—ণাম নিবেন”। কিন্তু তাতে বরফ গলেনি। আরও দু’বছর পর ৭৫ সালের পুজোতে বসুন্ধরা ভিলায় সপরিবারে এলেন ফুলকাকা। পঞ্চমী থেকে একাদশী আমার মা কীরা কাকিমাকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। বিদেশি বউকে দেশি সাজে বেশ মানিয়েছিল এবং স্বর্ণময়ী যে ভিতরে ভিতরে খুশি হয়েছিলেন সে কথা বলা বাহুল্য। ফুটফুটে দুই নাতনিকে দেখে আরও খুশি হয়েছিলেন বিনয়কান্তি এবং স্বর্ণময়ী। সে সাক্ষাতে দূরত্ব হয়ত কিছুটা কমেছিল মানসিক চিড়টুকু ভাঙ্গা কাচের মতো জোড়া গিয়েছে কিন্তু মিলিয়ে দেওয়া যায়নি।
সেই চিড়ই নতুন করে দেখা দিল, রোসিন শ্যাননের বিয়েতে আমার মা সুরঙ্গমার যাওয়া নিয়ে। বসুন্ধরা ভিলার সাদা ধবধবে চেহারাতে যাতে কোনওভাবে কলঙ্কের কালি না লাগে তার জন্য সুরঙ্গমার বিদেশ যাত্রা ভয়ংকর জরুরি ছিল। কিন্তু না বিনয়কান্তি না স্বর্ণময়ী কাউকেই সেই নিদারুণ সত্যিটা স্বীকার করতে পারেনি সুরঙ্গমা। নিঃশব্দে রোসিনর বিয়ে আর শ্যাননের আংটি বদলের অনুষ্ঠানের আড়ালে কীরা কাকিমার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে ঋতুর অবৈধ গর্ভপাত করানো হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: ৩য় খণ্ড, পর্ব-১১: শাশুড়িমা বসুন্ধরার আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি স্বর্ণময়ী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ

কীরা কাকিমা জানিয়েছিলেন যারা এই ঘটনা জেনেছেন তাদের বাইরে আর কারও এসব জানার প্রয়োজন নেই। তাই ডাক্তার হয়ে ফুলকাকা ব্রিস্টলে বসে বা লন্ডনে পড়তে থাকা শ্যানন কিছুই জানতে পারেনি। রোসিন আর তার হবুবর জেমস অ্যাডাম ছিল আটালান্টায়। তাদের এসব জানার কথাও নয়। সিএনএন থেকে ছুটি নিয়ে চার্চের বিয়ের দুদিন আগে তারা আয়ারল্যান্ডে এল ফুলকাকা আর শ্যানন এল আগের দিন। লয়েড ব্যাঙ্কের গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্বে থাকা অ্যান্ডি অ্যালেন এল জেমস-রোসিনের চার্চের বিয়ের দিন কাকভোরে। কীরা কাকিমার পরিকল্পনা মতো মা, মুমু, ঋতু আর ঋতম পৌঁছল এসবের দশদিন আগে।

বাড়ি বদলাতে বদলাতে কীরা কাকিমা গ্রেঞ্জগর্ম্যান এলাকায় থাকতেন। তখন কীরা কাকিমা সেখানের রিচমন্ড সার্জিকাল হসপিটালের বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। ফুলকাকার সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ হয়েছে। দুই মেয়ে কাছে নেই। আছে নিজের অস্তিত্ব কিছু বইপত্র আর কাজ। তাই ঘর আর ঘর নেই ঘুমোবার জায়গা হয়ে গিয়েছে। সারাটা দিন হসপিটালেই কেটে যায়। হাঁটাপথে যাতায়াত। অবশ্য মায়েরা যাবার জন্যে ঠিকপাশে একটা ভিলা ভাড়ায় নিয়েছিলেন কীরা কাকিমা। মায়ের কাছে শুনলাম কীরা কাকিমার বুকশেলফে পৃথিবীবিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে জ্বলজ্বল করছে বাবার লেখা গল্প উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। কীরা কাকিমা তাঁর চেনা পরিচিতদের গর্ব করে বলতেন দিস রাইটার ইস নান আদার দ্যান মাই এল্ডার ব্রাদার।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪০: মা সারদার নিজবাটি

আবার সেই গভীর গোপন ঘটনায় ফিরি। ঋতু ঠিক একটা দিন হাসপাতালে ছিল তারপরের দিন বাড়িতে। এই ঘটনার গ্লানি ঋতুকে ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে দিয়েছিল। একটা নিদারুণ লজ্জায় সে সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকতো। প্রথমে কীরা কাকিমা তাকে কিছু বলেননি। অ্যাবরশন হবার পর একদিন ঋতুকে বোঝালেন হালে যাকে কাউন্সেলিং বলে। তবে একা ঋতুকেই। মুমুদাদাকে কিছু বলেননি। কথোপকথনটা বাংলা করলে যেটা দাঁড়ায় তা হল—

—দেখো ঋতু! তুমি, বরং বলা ভালো তোমরা—অ্যাডাল্ট! একটা ইমোশনাল মানসিক শারীরিক অবস্থায় একটা ঝুঁকি নিয়েছিলে। কিন্তু ঝুঁকিটা পেরতে পারনি। এই রিলেশন এই সিদ্ধান্তকে সাপোর্ট করে না। তাই আমাদের সেই পয়েন্ট অফ ডিসপুটকে এলিমিনেট করতে হয়েছে। জীবনটাকে আবার নতুনভাবে শুরু করো না হলে এই ঘটনা তোমাকে মানসিক রুগী করে দেবে। এমন কিছু করো যাতে এসব ভাবার সময়ই না পাও।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৬: সুখের লাগিয়া

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

কীরা কাকিমার কথাগুলো ঋতুর মনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে হয়। এরপর ঋতুর সন্ন্যাসিনীর মতো জীবনযাত্রা বা অনাথ পথশিশুদের নিয়ে অবিরাম কাজ করে যাওয়ার পিছনে কিছুটা হলেও সেদিনের সেই কথোপকথন কাজ করেছিল। আর আগুনে ঘি ঢেলেছিল তনুদাদার বিরাট অংকের ইন্স্যুরেন্সের টাকা।

এই জন্যই বারবার ঈশ্বর আমাদের জীবনের ম্যানুয়াল সিগন্যালিংয়ের যুগে রেলওয়ে লাইন্সম্যানের মতো অবিরাম দিক বদল করে দিচ্ছেন। আমি একটি লাইনে চলতে চলতে যেখান পৌঁছবো ভেবেছিলাম সেখানে যাওয়ার আগেই নিখুঁতভাবে চলার পথ গন্তব্য বদলে দিচ্ছেন তিনি। তবে আমি চলছি বলেই এক লাইন থেকে ঈশ্বর নির্দেশিত পাশের অন্য একটি লাইনে যেতে পারছি। থেমে থাকলে তা হয়ত সম্ভব হত না। কাউকে তিনি কলকাতার রাস্তায় ঘোরা জাহাজের মাল বোঝাইয়ের এজেন্ট থেকে হিন্দিছবির শাহেনশা হতে পাঠিয়ে দেন। পোর্ট কমিশনারের সাধারণ লোয়ারডিভিশন ক্লার্ক থেকে বাংলা ছবির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক নায়ক করে তোলেন। রেলওয়ে টিকিট কালেক্টর থেকে ক্যাপটেন কুল বা জাহাজঘাটার পাট ব্যবসায়ীর নগণ্য কর্মীকে বিনয়কান্তি দত্ত করে তোলেন সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content