শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কর্মব্যস্ত সিএনএন নিউজ রুম। ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

আলোড়ন

অরুণাভর সঙ্গে দেখা হওয়ার দিন, বাসরাস্তা ট্রামলাইন টপকেবাবলি বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মাঝ রাস্তার শিবমন্দির-এর ফুল মিষ্টির দোকানের আড়ালে চলে গিয়েছিল। জবাফুলের ঝুলন্ত মালার আড়াল থেকে দেখতে লাগল অরুণাভ হাজরা রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। অরুণাভ একবার ঘাড় ফিরিয়ে বাবলিকে খুঁজল। তারপর এগিয়ে গেল তাঁর গন্তব্যে।
হয়তো হাজরা রোডের পাশেই কোথাও গাড়ি রেখেছিল। অরুণাভর হয়তো ইচ্ছে ছিল বাবলি তার গাড়িটা একবারটি দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করুক। না-ই বা ড্রাইভে গেল। বাবলি বোধহয় একটু বেশি রূঢ় ব্যবহার করে ফেলল। কিসের এত ভয় বাবলির? কাকে ভয়? নাঃ প্রণয়কে বাবলি ভয় করে না। সুজাতাকেও নয়। ওদের দুজনের প্রতি করুণা হয় বাবলির। বসুন্ধরা ভিলা তার সুপ্রাচীন সুকঠিন ঐতিহ্য পরম্পরা কিছুর ভয় নেই বাবলির। বাবলির ভয় নিজেকে। নিজেকে মনের ভয়ংকর ঝড়কে বড় ভয় বাবলির। তাই সে সংযমের শামুকের খোলের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে। আর ভয় বাপির কাছে ছোট হয়ে যাবার।

তরুণকান্তির স্ত্রী নেই সন্তান নেই। সহানুভূতিশীল আত্মীয় আছেন ক’জন আর আপন বলতে আছে সন্তানসম বাবলি। প্রণয় যদি একটু ভালবাসা দিত বাবলির মনে আজকের ভয় আজকের সংকোচ থাকতো না। প্রণয়ের অবহেলাই বাবলির ভয়ের কারণ। অসাবধানে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়। তাহলে তরুণকান্তি কি নিয়ে বাঁচবেন। “ম্যারেজেস মেড ইন হেভেন” তাই যদি হবে তাহলে সুজাতার সঙ্গে তরুণকান্তির বা প্রণয়ের সাথে বাবলির বিয়ে হল কেন?বোধহয় কিশোরী বয়সে বাবাকে হারানোর পর আরেক অসহায় বাবার সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ঈশ্বর!

চটি ছেড়ে জলে হাত ধুয়ে প্রসাদ আর ফুল নিয়ে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে গেল বাবলি। ব্যাঙ্কে আসে তবে মন্দিরটায় আসা হয় না। মন্দিরের ভেতরে মা কালীর সামনে দাঁড়িয়ে বাবলি ভাবছিল সে নিজেকে কতখানি বদলে ফেলেছে। কতখানি সাবধানী হয়েছে সে। এখন যে মানসিক অবস্থা তাতে মুহূর্তের দুর্বলতায় ভুল হয়ে যেতে পারে। তাই বাবলি ভীষণ সাবধানী। বিবাহিতা বলেই কি সাবধানী? বিবাহিত পুরুষ নাকি নারী? কারা বেশি সাবধানী?

বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে বালিগঞ্জ প্লেসে যাবার বাংলা ‘দ’-য়ের মতো গলিটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসব ভাবছিলো বাবলি। অসাবধানী বা বেহিসেবী হবার জন্য নারী বা পুরুষ নয় দায়িত্ববোধটা জরুরী।
সুরঙ্গমার ঘরের ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ারে হিন্দি রক্তকরবী দেখে সকলে মুগ্ধ। সকলে বলতে মা- ন’কাকা তরুণকান্তি সুপ্রিয়া বউদি শ্রীতমা আর বাবলি নিজে। বাবা ছিলেন না। আমি বাবা সানন্দা সকলে মিলে সেই ভিডিও পরে দেখেছি। সেদিন বাবলিকে জড়িয়ে ধরে মা বলেছিলেন—
—তুই এত ভালো অভিনয় করিস আর এতদিন আমাকে কিছু বলিস নি
বাবলি হাসতে হাসতে বলেছিল—
—সুরঙ্গমা সেনগুপ্তর মুখে এতটা প্রশংসা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে সে জোমা। কলেজের অ্যামেচার পারফরমেন্স।
উত্তেজিত হয়ে ন’কাকা তরুণ কান্তি বলে উঠেছিলেন—
—মোটেই না। আচ্ছা সেজবৌদি এটা আমাদের ঠাকুরদালানে বড় স্ক্রিনে দেখানো যায় না।
স্বাভাবিক আপত্তি জানিয়েছিল বাবলি।
—না না সে সবের কোনও প্রয়োজন নেই। এ নিয়ে আমি আবার কোন নতুন অশান্তি চাই না বাপি।
—তোর এমন একটা ট্যালেণ্ট কেউ জানতে পারবে না !!
মা বলেছিলেন—
—পরিবেশ পরিস্থিতিতে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয় ঠাকুরপো। এক্সিবিশনে দেখা না গেলেও কোহিনুর কোহিনুরই থাকে। দশটা লোক চোখে দেখে পরখ করে তার গুণকীর্তন করেনি বলে কোহিনুরের দ্যূতি এতটুকুও কমে না।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং..., ২য় খণ্ড, পর্ব-৪৯: বাবা এই লেখাটা শুরু করেছিলেন ২০০৯ নাগাদ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

কিন্তু অশান্তি হয়েছিল। সেই ভিডিও ক্যাসেট বাবলির কাছে পৌঁছলো কী করে সেই নিয়ে অনেক জবাবদিহি সহ্য করতে হয়েছে তাকে। প্রণয় সেখানেই থামেনি। বাবলির গতিবিধি জানতে তার পেছনে ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি লাগিয়েছিল প্রণয়। পরে বিস্তারিত সে কাহিনীতে ফিরব। তার আগে ফিরতে হবে সেই বহুল প্রতীক্ষিত অঘটন উপাখ্যানে।

তনুদাদা আর ঋতু যখন মাঞ্চেস্টার গিয়েছিল তখন রোসিন সাওদার্ন ন্যু হ্যাম্পশায়ার ইয়ুনিভার্সিটিতে মাস কমিউনিকেশনের ফাইনাল ইয়ারে। তারপর সে খবরের দুনিয়ায় পৃথিবী বিখ্যাত সিএনএন-এ চাকরি পেয়ে গেল। পোস্টিং সিএনএন এর হেডকোয়ার্টার-এ। মার্কিন মিডিয়া ব্যারন টেড টার্নার ও রিসি স্কনফেল্ড -এর গড়া এই কেবল নিউজ নেটওয়ার্ক বা সিএনএন-এর হেডকোয়ার্টার জর্জিয়ার আটলান্টা সিটির কাছেই সিএনএন সেন্টার-এ।

ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে রোসিন পাড়ি দিল ম্যানচেস্টার থেকে আটলান্টা। গাড়ির রাস্তায় মার্কিন হিসেবে ১১৭০ মাইল মতো। আমাদের হিসেবে ১৮৮৫ কিলোমিটার। মানে কলকাতা থেকে মুম্বই। কিন্তু তখন জর্জিয়া থেকে আটলান্টা সরাসরি কোনও ফ্লাইট ছিল না। ঘুরপথে সাড়ে চার পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাবে। আর গাড়িতে গেলে এই দূরত্ব টপকাতে সময় লাগে সাড়ে সতেরো ঘণ্টা। আমাদের এখানে কলকাতা মুম্বই গাড়ির দূরত্বে প্রায় ৩৫ ঘণ্টা। তফাৎটা রাস্তার জন্যে। এখানে গড়ে ঘণ্টায় ৫০-৫৫ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলতে পারে। মার্কিন মুলুকের সেটা প্রায় দ্বিগুণ ১০৯ থেকে ১১০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। দেশের অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা করতে সড়ক পথের উন্নতি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নানা সমস্যার মোকাবিলা করে আমাদের সরকার এখন সেই দিকে নজর দিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪: কৃষ্ণভাবিনী দাসী— প্রথম মহিলা ভ্রমণ কাহিনিকার

যাই হোক রোসিনের বহুদিনের বন্ধু জেমস। জেমস অ্যাডম। জেমস ব্রিটিশার। কিন্তু কি আশ্চর্য রোসিনার সঙ্গে তার আলাপ হল সাওদার্ন ন্যু হ্যাম্পশায়ার ইয়ুনিভার্সিটিতে মাস কমিউনিকেশন পড়তে গিয়ে। রোসিনের দু বছরের সিনিয়র। জেমস পড়া শেষ করে সিএনএন এ চাকরি করতে শুরু করল। আর তার সূত্রেই রোসিন চাকরি পেল সিএনএন-এ। একেবারে সঠিক অর্থে ফ্রেন্ড ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। জেমস এর সঙ্গে কলেজে আলাপ পরিচিতি হবার পরে পরেই কীরা কাকিমা মাকে সব জানিয়েছিলেন। বাবা মজা করে বলতো আমার ভাইঝির বিয়ে হবে জেমস বন্ডের সঙ্গে। শ্যানন ডাক্তারি পড়ছে। বিলেতের লয়েড ব্যাংকের এক হোমরাচোমরার সঙ্গে তারও মোটামুটি বিয়ে ঠিক। তার নাম অ্যান্ডি অ্যালেন।

ডাক্তারি পড়া শেষ করে কোনও একটা হাসপাতালে জয়েন করবে শ্যানন। তারপর বিয়ে। মাঝখানে তনুদাদার ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে গেল তাই কীরা কাকিমা, মার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে পারেননি। বেশ কিছুদিন কাটার পর ঋতু যখন ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে মা কীরা কাকিমাকে রোসিনের বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। কীরা কাকিমা জানালেন বাড়ির এই অবস্থায় এ নিয়ে কথা বলা যায়নি। মাস দুয়েক পরে রোসিনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। জেমস আর রোসিন দুজনেই ইউএস থেকে ইউকে আসবে।

কীরার ইচ্ছে চার্চে বিয়ের পর ওদের বিয়েটা বাঙালি মতে হোক। ফুলকাকারও সেরকমই ইচ্ছে। রোসিন বা জেমস-এরও এতে কোন আপত্তি নেই। এবং এই বিয়েটা ঠিকঠাক করে দেবার জন্যে আমার মাকে হাতে অন্তত একমাস সময় নিয়ে ইউকে-তে আসতেই হবে। কীরা কাকিমার আরও ইচ্ছে শ্যানন আর অ্যালেন-এর রিং সেরিমনি বা আঙটি-বদলটা সেরে রাখতে। আর এই ডাবল ধামাকা সামলাতে হবে আমার মাকে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৩: গগনেন্দ্রনাথের‌ ঘুড়ি ওড়ানো

কিন্তু এর চেয়ে বড় বিস্ফোরণ আমার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। আচমকা একদিন আমার বোন সানন্দা এল অসময়ে। লাইব্রেরি ঘরে বাবার সঙ্গে এক ঝলক দেখা করেই ওপরে মার কাছে চলে গেল। এটা সানন্দার ক্লিনিকের টাইম। কখনও সখনও হসপিটালও থাকে। এমন একটা সময় তাকে বসুন্ধরা ভিলাতে দেখে মা খুব অবাক।
—কিরে তুই এই সময়? কী হয়েছে?
—গুরুতর ব্যাপার।
কথাটা বলেই সানন্দা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। সানন্দা মাঝেমধ্যে খুব সিরিয়াসলি মজা করতো। মেয়ের সে স্বভাব মা জানতেন।
—ভয় দেখাস না কি হয়েছে খুলে বল।
সানন্দা খাটের উপর বসে পড়ল টেবিলের পাশে রাখা কাচের গ্লাসের ঢাকনা খুলে ঢকঢক করে জল খেলো। তারপর কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজিয়ে থেকে দুম করে বলে উঠলো
—ঋতু প্রেগনেন্ট মা! —চলবে।

আলোড়ন। ছবি: প্রতীকী। সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/ পর্ব-৫১

এরপর আর সুরঙ্গমার কাছে কোন কথা ছিল না। সানন্দাও কথা খুঁজে পাচ্ছে না। মা হয়ে মেয়ের কাছে এসব নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। সে যে ডাক্তার তাঁকে ছাড়া আর কাকে বলবে? সুরঙ্গমা দিশেহারা হয়ে সানন্দার দুটো হাত ধরে বললেন।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content