শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


বাবাকে প্রণয়কান্তি যা জানিয়েছিল সেটা ভয়ঙ্কর। অর্কপ্রভ দাশগুপ্ত এবং রমেশ আগরওয়াল মিলে সরাসরি বসুন্ধরা ভিলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। সানন্দার ওপর প্রতিশোধ ছিল অর্কপ্রভর লক্ষ্য। আগরওয়ালকে সামনে রেখে তার পিছনে ছিল বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজের বিরুদ্ধে থাকা ছোটবড় অনেকগুলো ব্যবসায়িক সংস্থা। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণয়ের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি করেছিল আগরওয়াল অ্যান্ড সন্স-এর মালিক রমেশ আগরওয়াল। আগরওয়াল-এর বাবা কৈলাসপ্রভু আগরওয়াল বহুবছর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্টের চেয়ারের জন্যে লড়াই করেও বিনয়কান্তি দত্তকে হারাতে পারেননি। বাবার পরাজয়ের শোধ তুলতে ছেলে দীর্ঘদিন ধরে ঘুঁটি সাজিয়েছে। প্রণয় বুঝতেই পারেনি প্রণয়কে এতদিন ধরে রমেশ আগরওয়াল বসুন্ধরা গ্রুপের ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করে এসেছে। গৌরব সেনগুপ্তর মত ফাইনান্সের একজন ব্রিলিয়ান্ট এক্সিকিউটিভকে কোম্পানির থেকে চিরদিনের মত সরিয়ে দেওয়ার ছকটাও আগরওয়ায়া এবং তার সহযোগী বিরোধীশক্তির বুদ্ধি। প্রণয় সেখানে দাবার বোর্ডের ঘুঁটির মতো আগুপিছু নড়াচড়া করেছে।
এই প্রণয়কে দিয়ে বসুন্ধরা ভিলার আসল দলিলের স্ক্যানকপি হস্তগত করেছে ডাক্তার অর্কপ্রভ দাশগুপ্ত এবং আগরওয়াল অ্যান্ড সন্স-এর মালিক রমেশ আগরওয়াল, আর পিছনে রয়েছে বসুন্ধরা ভিলার লুকিয়ে থাকা বিরোধী গোষ্ঠী। বিভিন্ন জায়গাতে প্রভাব এবং অর্থের সাহায্যে স্ক্যানকপি অনুযায়ী হবহু জালদলিল বানানোর কাজ শুরু হয়েছিল, সেই জালদলিল নিয়ে আদালতে যাবার পরিকল্পনা করছিল অর্কপ্রভ এবং রমেশ আগরওয়াল তার মধ্যে হঠাৎ করে অরুণাভ’র ঘটনা ঘটে যাওয়া এবং প্রণয়কান্তির চলে যাওয়ায় সম্ভবত ওদের পরিকল্পনা একটু পিছিয়ে গিয়েছে। যেহেতু এই অন্যায়টার মধ্যে প্রণয়কান্তি নিজে জড়িয়ে আছে। তাই সে সব স্বীকার করে আজ ফোন করেছে। প্রণয়ের অনুরোধ এক্ষুনি যেন এই ব্যাপারে বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানি যথাযথ ব্যবস্থা নেয়! অসুস্থ না হলে বিনয়কান্তি দত্ত এই পরিস্থিতি সামলে নিতেন আর যাঁরা আছেন তাঁদের কারও অসম্মান না করেই প্রণয়কান্তি জানালো এখনই সবটা তারকবাবুকে জানানো দরকার। তারকবাবুর সঙ্গে এখনও অস্ট্রেলিয়ায় বুবু মানে গৌরবের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। গৌরবকে জিজ্ঞেস করলে সে এমন কিছু একটা মাথা থেকে বের করবে যেটা অর্কপ্রভ বা রমেশ ভাবতেও পারবে না। আজ প্রণয়কান্তি বোঝে যে বুবু একটা জিনিয়াস তাকে হিংসে করাটা প্রনয়কান্তির পক্ষে নেহাতই বোকামি ছিল। বিনয়কান্তি দত্তের পর বসুন্ধরা গ্রুপে গৌরভ সেনগুপ্তের মতো ব্যবসায়িক বুদ্ধি আর কারও নেই।
আরও পড়ুন:

বসুন্ধরা এবং…, ৩য় খণ্ড, পর্ব-৫০: পুনরুত্থান

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে

প্রণয়ের কথা মতো আমার বাবা অমলকান্তি দত্ত এক্কেবারেই সময় নষ্ট না করে তারক নিয়োগীকে সব জানিয়েছিলেন। প্রণয়ের পরামর্শের কথা জানিয়েই তারকবাবুকে বুবু বা গৌরবের সঙ্গে এই বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ায় কথা বলতে অনুরোধ করেন আমার বাবা অমলকান্তি। সব শোনার পর বিদেশ থেকে গৌরব জানতে চেয়েছিল দাদু বিনয়কান্তি দত্ত এখনও সিগনেচার করতে বা থাম্ব ইম্প্রেশন দিতে পারছেন কিনা! উত্তরটা ইতিবাচক শুনে বিদেশে বসেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে নিয়েছিলেন গৌরব সেনগুপ্ত। বাড়িতে বিনয়কান্তি দত্তের মেডিকেল রুমেই উকিল রেজিসট্রার ডেকে ভিডিয়োগ্রাফি করে বসুন্ধরা ভিলার সেই পুরনো বাড়ির দলিলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমেন্ডমেন্ট করা হল যেগুলো সেই আগের পুরনো দলিলকে বেশ কয়েকজায়গায় আইনমাফিক বদলে দিল। ফলে এত খরচপাতি এবং প্রভাব খাটিয়ে বিরোধীশক্তির পুরনো দলিলের নকল করার সব প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিলেন গৌরব সেনগুপ্ত।
সেইসব ব্যবসায়িক আইনের কুটকচালিতে না গিয়ে বাবা মাকে জানিয়ে দিলেন—
—আমি না থাকাকালীন কখনো বাবলি বা প্রনয়ের যদি ফোন আসে তাহলে বলো দলিলের সমস্যা মিটে গিয়েছে!
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৮: মা সারদার ‘পরকে আপন করা’

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ

ঈশ্বর পৃথিবীর সবকিছুতে সময়ের নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। বাড়ির দলিলের এই আইন মোতাবেক পরিবর্তনটা জরুরি ছিল। তাই বিনয়কান্তি দত্ত শারীরিকভাবে সজ্ঞানে ছিলেন। বসুন্ধরা ভিলায় এখন আর ছন্দ নেই সুর নেই, সর্বত্র যেন সুরতাল ছন্দহীন সময়ের ক্রমাগত ক্ষয়। বাড়িতে দু-দুজন অত্যন্ত সংকটজনক রোগী। ব্যবসায়ের আগের সময়কার রমরমা কমে আসছে। বসুন্ধরার স্বপ্নে দেখা সেই সকলকে নিয়ে ভরা সংসারের শিকড়ের মাটি আলগা গিয়েছে।

ঠিক এমন সময়ে আবার ঝড়বৃষ্টি বজ্রবিদ্যুতে ভরা এক কালবৈশাখীর উথালপাথাল সন্ধ্যেবেলায় বসুন্ধরা ভিলায় মহীরুহের পতন ঘটল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৬: রাজনৈতিক পরিসরে অখ্যাতি ও সন্দেহর আবিলতা থেকে কি মুক্তি সম্ভব?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়

ক’দিন ধরেই শরীরের নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল আশঙ্কা বাড়াচ্ছিল। ডাক্তাররা সচেতন ভাবে সব রকমের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন কিন্তু বাইরে ঝড়ের দাপাদাপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিনয়কান্তির মাথার কাছে রাখা মনিটরে তাঁর হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করছিল। গত প্রায় তিনদিন আমার দাদু বিনয়কান্তি দত্তের আজীবন ছায়াসঙ্গী তারক নিয়োগী অফিস করছেন না। দাদুর পায়ের কাছে একটা চেয়ার নিয়ে তার পাটা ধরে মাথা নিচু করে বসে আছেন সেই প্রৌঢ়। আর মাঝে মাঝেই চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসা চশমার কাঁচ মুছছেন ধুতির খুঁট দিয়ে। আমার মা সুরঙ্গমা বহুবার বহু অনুরোধ করেও তারক নিয়োগীকে খাওয়াতে পারেননি। অগত্যা ওই ঘরে বসেই গত তিনদিন ধরে সামান্য একবারই একটু ব্রেড স্যুপ খেয়েছেন সারাদিনে। রাতেও ব্রড স্ট্রিটের গেস্টহাউসে ফেরেননি। এখানকার আউটহাউসে স্নান সেরে এসে আবার বসে পড়েছেন দাদুর পায়ের কাছে। ঝড়বৃষ্টির আওয়াজ সে ঘরে পৌঁছোয়নি। বিকেলবেলায় একবার তার ক্লিনিকে যাবার আগে সানন্দা এসে দাদুকে দেখে গিয়েছে মায়ের ঘর থেকে ফুল কাকার কীরা কাকিমার সঙ্গে দাদুর শরীরের টেস্ট প্যারামিটার নিয়ে কথাবার্তা বলেছে। গত তিনদিনের ক্লান্তিতে তারক নিয়োগীর চোখ লেগে এসেছিল।
আরও পড়ুন:

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক

হঠাৎ যেন দেখলেন দাদুর মাথার দুপাশে খুব চেনা দুজনকে। একজন খুব যত্ন করে বিনয়কান্তি দত্তের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর অন্যজন বিনয়ের বুকে আলতো হাত রেখে মাথা নিচু করে আছেন। প্রথমজন মাথার কাছে বসুন্ধরা দত্ত আর অন্যপাশে তাঁর বুকে হাত রেখে -স্বর্ণময়ী। বিনয় কান্তি চোখ বুজে অসাড়ে শুয়ে আছেন। তারক নিয়োজিত চমকে উঠলেন
—একী! মা, তোমরা এসেছ কেন?
—বিনু’র পা’টা এবার ছাড়ো তারক!
—মানে?
স্বর্ণময়ী মাথা নিচু করে বললেন—
—বাবু আপনি ওঁকে ধরে রাখলে আমরা নিয়ে যাব কি করে?
আচমকা সমস্ত ক্লান্তি শান্তি ছিটকে গেল তারক নিয়োগীর শরীর থেকে। এক ঝটকায় জেগে উঠলেন ঘরে কেউ কোথাও নেই – নার্স বা ডাক্তার তারাও সম্ভবত বাইরের ঘরে। ঘরের যন্ত্রপাতি গুলো সব চলছে কিন্তু মাথার পাশের মনিটরের চোখ যেতেই শরীরের ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল । চরম সংগ্রামী সেই উত্থানের জীবন এখন সরলরেখা হয়ে গেছে। নিঃশব্দে মহীরুহ পতন ঘটে গেছে বসুন্ধরা ভিলায়। —চলবে।
 

পরের সপ্তাহে তিন অধ্যায়ে বিন্যস্ত বসুন্ধরা এবং… ৩য় ও শেষ অধ্যায়ের সর্বশেষ ১৫৬তম পর্ব।

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content