শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


প্রতীকী ছবি, সৌজন্যে: সত্রাগ্নি

।। গন্তব্য ভবিষ্যৎ।।

বিনয়কান্তির উত্তর শুনে স্বর্ণময়ী বসুন্ধরা হতবাক হয়ে গেল। বিনয়কান্তি বললেন,
মেজ খোকাকেও তৈরি হতে বল। সেও যাবে শান্তির সঙ্গে।

স্বর্ণময়ী তখনও ধাতস্থ হতে পারেনি। কী হচ্ছে সেটা সে কিছু আন্দাজ করতে পারছে না। কিন্তু কী কেন ওই সব বারবার জিজ্ঞেস করে স্বামীকে বিরক্ত করার মতো মহিলা স্বর্ণময়ী নয়। এত বছর ধরে সে বিনয়কে চেনে, স্বামীর ওপর তার পূর্ণ আস্থা রয়েছে।

বিনুকে একটু জল দে স্বর্ণ, তুই একটু জল খা। আমার কাছে একটু বোস দেখি।

স্বর্ণ এই সংকটের মুহূর্তে বিনয়কে বিব্রত না করে একটু জল এগিয়ে দিল। জলটা মুখে দেবার আগেই ঘরের টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল।

মুখের জল নামিয়ে বিনয় গিয়ে রিসিভারটা তুলতে যাচ্ছিল, বসুন্ধরা হাত দেখান।

আমি ধরছি—ছোট নাতিই হবে। তুমি মুখের জলটা খেয়ে কথা বল।

হ্যালো! কে? তারক? ভাবলাম আমার ছোট্টু বুঝি। হ্যাঁ বাবা আমি তো ঠিক আছি। হ্যাঁ, বিনু’র ফোনে পাবে কি করে ওতো সেই থেকে আমার ঘরেই। দাঁড়াও বাবা তুমি লাইনটা ধরে থাকো। বিনু তুমি কি এখানেই কথা কইবে, নাকি ওপরের ঘরে—

না না দাও, সময় বড় অল্প।

দাঁড়াও দাঁড়াও। স্বর্ণ দে তো মা এই টেলিফোনের লাইনটা খুলে ওই সোফার পাশের প্লাগে জুড়ে বিনু একটু বসে ধীরে-সুস্থে কথা বলুক। তারক ধরে রাখো বাবা টেলিফোন ছেড়ো না।

এই অদ্ভুত মুহূর্তেও বসুন্ধরাকে দেখে বিনয়কান্তির অবাক লাগলো। সেই বসুন্ধরা ছেলেকে নিয়ে ফরিদপুরের কোটালিপাড়ায় নিজের ভাই ভাইয়ের বউদের সংসারে আশ্রিত থাকতো। সেই বসুন্ধরা যে দিনের-পর-দিন সন্ধ্যা থেকে রাত বাখুণ্ডায় বা কলকাতার ফড়েপুকুরে গুহবাড়ির হেঁসেল সামলাতো। তেলিপাড়া লেনের এজমালি উঠোনে বসে বাসন মাজত। আবার এখন বসুন্ধরা ভিলায় বসে এই পরিস্থিতিতেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। তারকের সঙ্গে বিনয়কান্তির গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকতে পারে। তাই নিজের বিছানা থেকে স্বর্ণকে বলল, ফোনটাকে ঘরের অন্য দেওয়ালের প্লাগে লাগিয়ে দিতে। যাতে বিনয় নিভৃতে সোফায় বসে পরামর্শ করতে পারে।

হ্যালো। হ্যাঁ, আমি তোমার টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

বিনয় কথা শুরু করলে স্বর্ণকে পাশে বসায় বসুন্ধরা। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

তারকবাবু জানালেন, গাড়ি পৌঁছতে দেরি দেখে নিজেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে লালবাজার পৌঁছে গিয়েছেন। তবে নিজের মালপত্রের ব্যাগটা মেসবাড়ির একতলার অফিসঘরে রেখে এসেছেন। বলে রেখেছেন বসুন্ধরা ভিলার থেকে গাড়ি এলে ড্রাইভার যেন ওর ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে নেয়। লালবাজারের গেট টপকে রাধাবাজার স্ট্রিটের গলিতে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করে। তারকবাবু বিনয়ের সঙ্গে কথামতো লালবাজারে পৌঁছে জয়েন্ট সিপি মি: পুরকায়স্থ’র সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন সিপি সাহেব নিজে ব্যাপারটা দেখছেন। ওরা সৌরভের সঙ্গে সঙ্গে অন্য ছেলেদেরও লালবাজার থেকে ছেড়ে দেবে। সিপি সাহেব সব ছেলেপুলেকে পুলিশের গাড়ী করে যে যার এলাকায় পৌঁছে দিতে বলেছেন। মি: পুরকায়স্থ বাবুকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। কথাটা শোনার পর বিনয়কান্তির চোখদুটো ভিজে গেল। বসুন্ধরা বারবার বলতেন সৎ ভাবে মনেপ্রাণে কিছু চাইলে ঈশ্বর সেই আকুল আবেদনে সাড়া দেন। তখনই চমৎকার ঘটে।

আজকের বিনয়কান্তির বন্ধু হলেন এখনকার কলকাতার পুলিশ কমিশনার। তখন তিনি ছিলেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের সিনিয়র অফিসার। তার সূত্রেই বিনয়কান্তি টেলিফোনে কথা বলতে পেরেছিল সেই সময়কার জয়েন্ট সিপির সঙ্গে। যার সূত্রে কথা বলা সেই বিনয়কান্তির স্পেশাল ব্রাঞ্চের বন্ধু সিপিকে জানিয়েছিল যে, ছেলেটিকে ধরা হয়েছে সে প্রাক্তন শেরিফ বিনয়কান্তি দত্তের নাতি। ছেলেটির বাবা অল্পবয়সে মারা গিয়েছে। বিনয় কান্তি দত্তের বিধবা মেয়ে বড়ছেলে সৌরভকে নিয়ে বসুন্ধরা ভিলাতে থাকে। ছোট ছেলেটি কালিম্পং এ বোর্ডিং স্কুলে পড়ে।
আরও পড়ুন:

২য় খণ্ড, পর্ব-১৩: লাল রেক্সিনে মোড়া ‘কোটেশনস অফ চেয়ারম্যান মাও সেতুং’

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১: নাথানিয়্যাল গোবিন্দ সোরেনের গল্প

দশভুজা: আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

সিপি কথা বলতে রাজি হলে বিনয় বলেছিল—

কমিশনার সাহেব আপনি বুঝতে পারছেন যে আমার নাতি বা এই কম বয়েসি ছেলেপুলেরা কোনভাবেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নয়। অমিতাভ সেন বা তার স্ত্রীকে সকালেই গ্রেপ্তার করা হলে আমার নাতিদের কেউ ধরা পড়তো না। টিউশন চলাকালীন গ্রেফতার করায় সকলকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে গেছে। এটাতো ঠিকই যে আমি আমার নাতির জন্যই আপনার কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে আমার করজোড়ে মিনতি যে আপনারা এই কম বয়েসি ছেলেদের সকলকে ছেড়ে দিন। কমিশনার সাহেব আমার দৃঢ়বিশ্বাস পুলিশ এদের থেকে কোন তথ্য পাবে না। আমার নাতির কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি তাতে ওরা সকলেই মাস্টারমশাই আর তার স্ত্রীকে খুব সম্মান করত। কিন্তু এখন যেসব আইন-কানুনের কড়াকড়ি তাতে এরা যদি একবার ফেঁসে যায়। তাহলে এই ছেলেগুলো চিরকালের মতো সমাজের চোরাস্রোতে ভেসে যাবে। ওদের জীবনে অপরাধের একটা দাগ পড়ে যাবে। দয়া করে এরকম কিছু করবেন না। ওদের আড়ালে যারা বিচারে অপরাধমূলক কাজকর্ম করছে শাস্তি তাদের দিন।

বসুন্ধরা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর চেয়ারম্যান, চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট বা কলকাতার প্রাক্তন শেরিফ না হলেও বিনয়কান্তির কথার যুক্তি ও দাবি মেনে কমিশনার সাহেব এই কথাগুলোই শুনতেন। কিন্তু ওখানে পৌঁছনোর জন্য স্পেশাল ব্রাঞ্চের সিনিয়র অফিসারের বন্ধুত্বটা খুব প্রয়োজনীয় ছিল।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫২: প্রাকৃতিক উপায়ে মাছের ফলন বাড়াতে পুকুরে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার ভারসাম্য ঠিক রাখা জরুরি

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৬: রতনপুর মহামায়া দর্শন

স্বাদে-আহ্লাদে: ‘এগ পকেট’ পছন্দ? তা হলে বাড়িতেই বানান সহজ এই রেসিপি

গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল পদমর্যাদার অফিসারের জায়গা থেকে কমিশনার সাহেব বলেছিলেন।

আমি এখনই কোন কথা দিতে পারছি না। আমি লোকাল থানা এবং রাইটার্সের সঙ্গে কথা বলে দেখি কতদূর কি করা যায়। আপনি জয়েন্ট সিপি মি: পুরকায়স্থ’র সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

তল্লাশি চালিয়ে হয়তো অমিতাভ ও মণীষা সেনের বাড়ি থেকে পুলিশ যথেষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। আর ভয়ে আতঙ্কে হতবাক ছেলেগুলোর কাছ থেকে আর কি-ই বা জানতে পারত পুলিশ। তাই তাদের ছেড়ে দিয়ে কমিশনার সাহেব সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এদিন তাঁর সঙ্গে কথা বলবার সময় মা বসুন্ধরার শিক্ষাই কাজে লাগল।

বাবুর কথা শুনতে শুনতে বিনয় সোফা থেকে দূরে বিছানায় বসা বসুন্ধরাকে দেখছিল। “তোর কোনও সিদ্ধান্তে কারও যে বিপদ না বাড়ে, কারও যেন চোখের জল না ঝরে বিনু সেইটে সবসময় মাথায় রাখবি”—এ কথা একবার নয় বসুন্ধরা বিনয়কে বারবার বলেছেন।

নিজেকে সুবিধেজনক জায়গায় রাখতে মানুষ যুক্তি দেয়। বিনয় তো আর ঈশ্বর নয়। সেও যুক্তি দিত।
আরও পড়ুন:

বাস্তুবিজ্ঞান: পর্ব-১৮: বাস্তু মতে আপনার বাড়ির প্রধান প্রবেশদ্বার কোন দিকে হওয়া উচিত?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব

এ তোমার এক ভারি মুশকিল মা! জীবনের সব সিদ্ধান্ত কি এভাবে আগে থেকে হিসেব কষে নেওয়া যায়! আমার নেওয়া সিদ্ধান্তে কারো লাভ হবে কারো ক্ষতি। যার ক্ষতি হবে সে তো দুঃখ পাবেই মা।

কিন্তু কখনও স্কুলে না যাওয়া সারা জীবন সংসার সামলানো সেই ঘরোয়া মহিলাকে উদ্যোগপতি বিনয়কান্তি দত্ত কখনো থামিয়ে দিতে পারেনি। বসুন্ধরা হাসতে হাসতে বলতেন।

তুই কোতোয়ালিতে চাকরি করিস নাকি আদালতের জজ ম্যাজিস্ট্রেট যে তোর সিদ্ধান্তে লোকের ফাঁসি বা দ্বীপান্তর হবে। তুই এতদিন পরিশ্রম করে খেটে সৎভাবে মাথা উঁচু করে ব্যবসা করেছিস এরপরেও তাই করবি। তোকে দেখে দশটা লোক শিখবে। কারও ক্ষতি না করেও নিজের ভালো করা যায়। সেই চা বাগানে আমার কথা শুনে তোরা যেটা করেছিলি তাতে তো কারো ক্ষতি হয়নি বিনু। তারা সকলে তোদের দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছে। তাদের আশীর্বাদেই তুই আজ এখানে পৌঁছেছিস। মানুষের মনকষ্টে ঈশ্বর রুষ্ট হন বিনু। মানুষ খুশি হলে ঈশ্বরের সেবা হয়। তিনি সামনের সব জট খুলে দেন।

প্রতীকী ছবি, সৌজন্যে: সত্রাগ্নি

 

বসুন্ধরা এবং… ২য় খণ্ড/পর্ব-১৫

“ জানো স্বর্ণ আমার দাদামশাই মানে ফরিদপুর কোটালীপাড়া হাইস্কুলের হেডমাস্টার মশাই ঈশ্বর মুকুন্দ সেনগুপ্ত বলতেন – দাদুভাই বিপদে পড়লে কখনো ভয় পাবেনা। সবসময় মনে রাখবে যিনি বিপদ ঘটান – বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ তিনিই দেখান। তাই তিনি বিপদতারণ।”

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content