রবিবার ১৯ মে, ২০২৪


ছবি সংগৃহীত।

লোমশমুনি আর ভাইদের সঙ্গে করে যুধিষ্ঠির একের পর এক তীর্থ দর্শন করছেন। পাণ্ডবভাইয়েরা লোমশমুনির কথায় কনখলে গঙ্গাস্নান করলেন। এরপর মুনি যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে রাজন! ওই দূরে অতি মনোরম স্থূলশিরা মুনির আশ্রম দেখা যাচ্ছে। চলো আমরা সেই আশ্রমে প্রবেশ করি। তবে প্রবেশ করার আগে সকলে একটা কথা মনে রেখো, এ স্থানে এলে মান আর ক্রোধ ত্যাগ করতে হয়।’ মুনি বলে চলেন, ‘হে পাণ্ডুপুত্র! স্থূলশিরা মুনির আশ্রমের পশেই এই রৈভ্যমুনির আশ্রম। এখানে ভরদ্বাজমুনির পুত্র যবক্রীত বিনষ্ট হয়েছিলেন। আজ তোমাদের আমি কবি যবক্রীতের কাহিনি শোনাবো।’

ভরদ্বাজ যে কেবল মুনিশ্রেষ্ঠ ছিলেন তাই নয়, তিনি যোগী ছিলেন। তাঁর কথা, তাঁর পুত্রের কথা শুনতে উত্সুক হলেন যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির বলেন, ‘কর্ম্মভির্দেবকল্পানাং কীর্ত্ত্যমানৈর্ভৃশং রমে।’ ‘এই সমস্ত দেবতুল্য ব্যক্তিগণের আখ্যান শুনলে আমার মনে অসীম আনন্দ হয়।’ লোমশমুনিকে শুধু একবার বলার অপেক্ষা। কতশত গল্পেরা লুকিয়ে রয়েছে এই সমস্ত তীর্থের আনাচেকানাচে। তিনি হলে কথক। গল্পেরা তাঁর সাথে ঘোরে ফেরে। তিনি বলে চলেন তাঁর নিজের গতিতে।
ভরদ্বাজমুনি আর রৈভ্যমুনি এঁরা দু’জনে দু’জনের অতিপ্রিয় বন্ধু ছিলেন। একে অপরকে এতটাই পছন্দ করতেন যে তাঁরা পরস্পরের কছে বাস করতেন। রৈভ্যমুনির দু’ জন পুত্র ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল, অর্ব্বাবসু আর পরাবসু। ভরদ্বাজমুনির একমাত্র পুত্রের নাম ছিল যবক্রীত। রৈভ্যমুনি আর তাঁর পুত্রেরা অত্যন্ত বিদ্বান ছিলেন। আর অন্যদিকে ভরদ্বাজমুনির যে বিদ্যাবত্তা তেমন ছিল তা নয়। তবে তপস্যা ছিল। তাঁর সেই তপস্যার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন তাঁর পুত্র যবক্রীত। সেই আশ্রমে যাঁরাই আসতেন তাঁরা সকলে রৈভ্যমুনি আর সন্তানদের প্রশংসা করতেন। তপস্বী ভরদ্বাজের বিষয়ে কিছুই বলতেন না। এই বিষয়টা যবক্রীতের সহ্য হত না। যদিও এতে রৈভ্য আর ভরদ্বাজের সখ্যতায় কোনো বাধা পড়েনি।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৫: বালক অষ্টাবক্রের বুদ্ধিবলে পিতা কহোড় পেলেন নবজীবন

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, বাড়তি রক্তচাপ চিন্তা বাড়াচ্ছে? উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী করবেন, কী করবেন না

এদিকে যবক্রীত মনোকষ্টে ভুগতে ভুগতে একসময় মনস্থির করলেন যে পড়াশোনা না করে কেবল তপোবলে তিনি বেদকে জানবেন। বেদ জানবার জন্য যবক্রীত ভয়ানক তপস্যা শুরু করলেন। শেষে তিনি নিজের শরীরকে আগুনে দগ্ধ করতে লাগলেন। দেবরাজ ইন্দ্র এসব দেখে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে আবির্ভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেন এমন প্রবল তপস্যায় প্রবৃত্ত হয়েছো?’ যবক্রীত বললেন, ‘যে বেদ গুরুমুখ থেকে শুনে আয়ত্ত করতে হয়, সেই বেদ জানতে আমি তপস্যায় প্রবৃত্ত হয়েছি।’ ইন্দ্র সে কথা শুনে বললেন, ‘এ তো ভালো কথা যে আপনি বেদ জানতে চান। সেই বেদ আপনি গুরুমুখ থেকে শুনে অধ্যয়ন করুন।’ যবক্রীত ইন্দ্রের কথা শুনলেন।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, হাঁপানির সমস্যা থেকে ক্যানসার সব রোগের দাওয়াই হলুদ

স্বাদে-আহ্লাদে: ম্যাগি ভালোবাসেন? এই রেসিপি ট্রাই করে দেখেছেন?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের মাছ বৈচিত্র্যের ক্ষতিকারক প্রজাতি হল ক্রোকোডাইল ফিশ

কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আবারও ভয়ানক কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। ইন্দ্র তাঁকে আবারো বারণ করলেন। যবক্রীত জবাব দিলেন, ‘এই তপস্যা দিয়েই আমি বেদ শিখতে চাই। আপনি যদি আমায় বেদজ্ঞান দান না করেন, তবে আমি জ্বলন্ত হোমের আগুনে নিজের অঙ্গ কেটে আহুতি দিয়ে আরও কঠোর তপস্যা আরম্ভ করব।’ যবক্রীত যখন ইন্দ্রের কথা শুনলেন না, তখন অন্য উপায় অবলম্বনের উদ্দেশ্যে এক বৃদ্ধ, দুর্বল যক্ষ্মারোগগ্রস্ত তপস্বী ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করলেন। তারপর যবক্রীত যে ঘাটে রোজ স্নান করতেন, সেই ঘাটে গিয়ে মুঠো মুঠো বালি গঙ্গাজলে ছুঁড়ে ফেলে সেতুবন্ধনের চেষ্টা করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৯: মন্দির হয়ে বৌদ্ধবিহার

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৯: জলে হরি, স্থলে হরি, হরিময় এ জগৎ

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪: শিকারীর গোপন চোখ

যবক্রীত রোগগ্রস্ত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে বৃথা চেষ্টা করতে দেখে হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, ‘কেন আপনি নিরর্থক এমন পরিশ্রম করছেন?’ সেই ব্রাহ্মণ তাঁকে বললেন, ‘সাধারণ মানুষের গঙ্গা পারাপার করতে বড় কষ্ট হয়। তাই আমি সেতু তৈরি করছি।’ তখন যবক্রীত বললেন, ‘এই স্থানে গঙ্গা অতি প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। বালিরাশি দিয়ে এই স্থানে সেতুনির্মাণ অসম্ভব। তাই যেভাবে সেতুনির্মাণ সম্ভব হতে পারে, আপনি সেই চেষ্টা করুন।’

তখন ইন্দ্র তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি যেমন বেদ জানার জন্য এই ভয়ঙ্কর তপস্যা শুরু করেছেন, ঠিক তেমনি আমিও বালি দিয়েই সেতুবন্ধন করব বলে মনস্থির করেছি।’ যবক্রীত বুঝতে পারলেন, ইন্দ্র তাঁকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করেছেন। তিনি ইন্দ্রের শরণাপন্ন হলেন। তারপর দেবরাজ ইন্দ্রের বরে যবক্রীত এবং তাঁর পিতা ভরদ্বাজ মুনি বেদবিদ্যা লাভ করলেন।
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content