যত পথ এগিয়ে চলেন তত অভিজ্ঞতার ঝুলি যেন কানায় কানায় ভরে ওঠে। জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পান। মান্ধাতার আশ্চর্য জন্মকাহিনী শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হন, ঠিক তেমনি মান্ধাতারাজার বর্ণময় জীবনকাহিনীও মুগ্ধ করে, উদ্বুদ্ধ করে নতুন উদ্দীপনায়। সুপ্রাচীনকালের মান্ধাতারাজা কুরুক্ষেত্র অঞ্চলে বহুতর যজ্ঞ করেছিলেন। তাঁর সুশাসনে ধরাও যেন শস্যশ্যামলা হয়ে উঠেছিল । রাজোচিত কর্তব্য তিনি প্রজাদের যথার্থ পিতা হয়ে উঠেছিলেন ।হতোদ্যম যুধিষ্ঠিরের কাছে এ সবই যেন তীর্থযাত্রার ফল। মান্ধাতার কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের মন ভরে না। তিনি পুনরায় লোমশমুনিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন, ‘হে মুনিবর! আপনি আমায় সোমকরাজার কথা বলুন।
কে ছিলেন এই সোমকরাজা?’ লোমশমুনি বলে চলেন সোমকরাজার কথা। সোমকরাজার কাহিনী বড় আশ্চর্যের। সোমকরাজার বহু ভার্যা ছিলেন। কিন্তু কোন সন্তান ছিলে না। রাজা মনে মনে বহু সন্তানই চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ রাজার একজন ভার্যাই গর্ভবতী হন। পুত্রের নাম দেওয়া হয়, জন্তু। সেই জন্তুকে নিয়ে মায়েদের আদরেরও অন্ত ছিল না, আর উদ্বেগেরও নয়। তাঁরা সকলে পুত্রকে ঘিরে রাখতেন। এদিকে রাজার দুঃখের অন্ত ছিল না। একসন্তান তাঁকে কোন সুখ দিতে পারেনি। তিনি যাজকের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করেন পুত্রার্থে যজ্ঞ করবেন। যাজক তাঁকে পরামর্শ দেন ওই একপুত্র দিয়েই যদি যজ্ঞ করা হয় তবে অন্য রানীদের গর্ভেও রাজার পুত্রের জন্ম হবে। ফলে রাজার বহু পুত্রের সাধ মিটবে। সোমকরাজা যাজকের এই বিধান মেনে নিলেন। যজ্ঞের আয়োজন সম্পূর্ণ হল।
আরও পড়ুন:
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫০: পিতার দেহ থেকে মান্ধাতার জন্ম হল
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৯: গুরুদেবের দেওয়া গুরুদায়িত্ব
এদিকে মায়েরা জন্তুকে হারানোর শোকে পাগলপারা হলেন। যাজকও নাছোড়। তিনি যখন পণ করেছেন আর রাজার অনুমতি মিলেছে, জন্তুকে দিয়ে পুত্রার্থে যজ্ঞ তিনি করবেনই। যাজকের আর রাজার যুগ্ম ইচ্ছার জয় হল। যজ্ঞ হল। জন্তু যজ্ঞীয় পশু হলেন। মায়েরা পুত্রশোকে আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লেন। এরপরেই রানীরা গর্ভবতী হলেন। যাজক বলেছিলেন জন্তু আবার ফিরে আসবেন রাজার সন্তানদের মধ্যে দিয়ে। সন্তানের জন্ম হলে জগতের নিয়মে মায়েদের জন্তুর শোক প্রশমিত হল।
আরও পড়ুন:
হেলদি ডায়েট: একটুতেই নখ ভেঙে যায়? নখের স্বাস্থ্যের জন্য এই সব খাবার পাতে রাখতেই হবে
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৩: সবুজের নেশায় অভয়ারণ্য
অন্যদিকে যথাসময়ে কালের নিয়মে সোমকরাজা পরলোকগমন করলেন। সেখানে তাঁর যাজককে ঘোর নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। যাজক বললেন, ‘হে রাজন! আপনাকে আমি প্ররোচিত করে যজ্ঞ করিয়েছিলাম, আজ তার ফল ভোগ করছি।’ রাজা সোমক ধর্মরাজকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘হে ধর্ম্মরাজ! আপনি আমার যাজককে মুক্ত করুন। আমার জন্যই তাঁর নরকভোগ হচ্ছে।’
ধর্ম্মরাজ বলেন, ‘হে মহারাজ! একের ফল অপরে ভোগ করতে পারে না। আপনি নিজের কর্মবশে স্বর্গলাভ করেছেন। ঠিক তেমনি আপনার যাজকও কর্মফল ভোগ করছেন।’ সোমকরাজা এ কথা শুনে বলেন, ‘আমি স্বর্গসুখ চাই না। বরং যাজকের সাথে একত্রে নরকবাস করতে চাই।’ ধর্ম্মরাজ সে কথায় সম্মতি দিলেন। সোমকরাজা আর তাঁর যাজক একসঙ্গে নরকভোগ করলেন। তারপর যখন ফলভোগ শেষ হল, উভয়ে স্বর্গে ফিরে গেলেন।
ধর্ম্মরাজ বলেন, ‘হে মহারাজ! একের ফল অপরে ভোগ করতে পারে না। আপনি নিজের কর্মবশে স্বর্গলাভ করেছেন। ঠিক তেমনি আপনার যাজকও কর্মফল ভোগ করছেন।’ সোমকরাজা এ কথা শুনে বলেন, ‘আমি স্বর্গসুখ চাই না। বরং যাজকের সাথে একত্রে নরকবাস করতে চাই।’ ধর্ম্মরাজ সে কথায় সম্মতি দিলেন। সোমকরাজা আর তাঁর যাজক একসঙ্গে নরকভোগ করলেন। তারপর যখন ফলভোগ শেষ হল, উভয়ে স্বর্গে ফিরে গেলেন।
আরও পড়ুন:
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৩: মেডিকেল কলেজ থেকে বিশ্বকাপ
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩: নিয়মিত সাধন ভজন সাধককে ঈশ্বরের স্বরূপ চিনিয়ে দেয়
যুধিষ্ঠির লোমশমুনির কাছে সোমকরাজার সে আশ্চর্য কাহিনী শোনেন। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে চলেন সোমকরাজার আশ্রমের দিকে। যাঁর সদ্গুণের প্রভাব হয়তো এখনও মিশে রয়েছে এখানকার বাতাসে। যুধিষ্ঠির একে একে সজ্জন রাজাদের যজ্ঞস্থল দর্শন করেন। তীর্থের মাহাত্ম্য, পুণ্যাত্মা রাজর্ষিদের জীবনকথা শুনে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে তাঁর মন ভরে ওঠে। এই কি তবে তীর্থযাত্রার ফল!
* মহাভারতের আখ্যানমালা (Mahabharater Akhayanmala – Mahabharata) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।