রবিবার ১৯ মে, ২০২৪


অনন্যমনা এক পুরুষ চলেছেন স্বর্গের পথে। সে পথ সাধারণের পথ নয়। সে পথের যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছেন। মহাদেবের দেওয়া দেবশক্তি পেয়েছেন তিনি। কে সে যাঁর কাছে এমন এক শক্তি রয়েছে? সেই ভেবে আর সব দেবতারাও ছুটে এসেছেন তাঁকে চোখের দেখা দেখতে। তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন নিজের নিজের সেরা অস্ত্রখানি। দেবরাজ ইন্দ্রও এসেছেন রথে চড়ে। এতদসত্ত্বেও অর্জুন নির্বিকার। দৃষ্টি তাঁর অনেক দূরের দিকে। ইন্দ্র বোঝেন সে কথা। এর আগের সাক্ষাৎকারে ইন্দ্র তাঁকে স্বর্গের লোভ দেখিয়েছিলেন। অর্জুন এক লহমায় তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্দ্র বোঝেন, এমন পুরুষ স্বর্গের অলংকার। আর তাছাড়াও অর্জুনের প্রতি তাঁর দুর্বলতা স্বাভাবিক। এমন পুত্রকে কাছে পাওয়ার যে কি সুখ! ইন্দ্র অর্জুনকে স্বর্গে আমন্ত্রণ জানালেন।

তবে এবার অন্যভাবে। অর্জুনের মনের ইচ্ছা বুঝতে পারেন তিনি। পিতা হয়ে এটুকু তো বুঝতেই হবে। তার ওপর এ তো আর যে সে ছেলে নয়! অর্জুনকে তিনি কিছুটা আদেশের সুরেই বলেন, স্বর্গে যেতে হবে তোমায়। দেবতাদের তোমাকে প্রয়োজন। আর স্বর্গে গেলেই সেখানে তোমায় যাবতীয় স্বর্গীয় অস্ত্র দান করব। এমন এক প্রস্তাবের পর আর না করবার কোনও কারণই থাকতে পারে না। তাই অর্জুন চলেছেন।
ইন্দ্রের প্রকাণ্ড আর অদ্ভুত সে রথের চালক মাতলি। মাতলির কথায় অর্জুন তীর্থের জলে স্নান করে পিতৃতর্পণাদি সেরে পর্বতরাজ হিমালয়ের কাছে বিদায় নিয়ে সে রথে আরোহণ করলেন। দেবতার আশীর্বাদে দেবত্বশক্তির অধিকারী অর্জুন বহু পথ পেরিয়ে, বহু রাজর্ষি, সিদ্ধপুরুষ, তপস্বিগণের বাসভূমি অতিক্রম করে মনোরম স্বর্গীয় পথে অবশেষে অমরাবতীতে এসে পৌঁছলেন। দিব্য সে দেশে দিব্যসুর ধ্বনিত হচ্ছিল। অপ্সরা আর গন্ধর্বেরা অর্জুনকে যথোচিত সম্বর্ধনা জানাল। ইন্দ্র আজ বড় সুখী। উপযুক্ত পুত্র তাঁর কাছে উপস্থিত। পাশে বসিয়ে পিতা পুত্রকে স্নেহে ভরিয়ে দিলেন। তারপর যত্ন করে মহাস্ত্রবিদ্যা শেখালেন। একসময় অস্ত্রশিক্ষা শেষ হল। পুত্রকে কাছে পেয়েও মন ভরেনি দেবরাজের। অর্জুনকে ডেকে আরও কিছুকাল স্বর্গে বাস করবার আদেশ করলেন।
গন্ধর্ব চিত্রসেনের সঙ্গে অর্জুনের পরিচয় করিয়ে দিয়ে ইন্দ্র বললেন, ‘অর্জুন কেবল অস্ত্রশিক্ষা নয়, তুমি মনুষ্যজগতে দুর্লভ নৃত্য গীত বাদ্য শিক্ষা করো।’ দেবতা উজাড় করে দিতে চাইলেন পুত্রকে। চিত্রসেন অর্জুনের সখা হলেন। গন্ধর্বের কাছে স্বর্গীয় নৃত্যগীতাদি শিখে অর্জুন অপার্থিব আনন্দ অনুভব করলেন বটে। কিন্তু নিজের মা ভাই আর স্ত্রীর দৈন্যদশার কথা কোথাও মনের কোণে কাঁটার মতো বিঁধেই রইল। স্বর্গ, দেবত্ব কোনওকিছুই তাঁকে সেই অসীম সুখ দিতে পারল না। অর্জুনের অস্থিরতা ইন্দ্রের চোখ এড়াল না। তিনি মনে করলেন, হয়তো বা স্বজন ছেড়ে এত দূরের পথচলার জন্য একাকীত্বের কারণে তাঁর এমন উচাটন দশা। হয়তো বা অপ্সরাসঙ্গসুখ পেলে এমন দশা কিছুটা হলেও কাটবে। এই সব ভেবে অপ্সরাশ্রেষ্ঠা উর্বশীকে ডেকে পাঠালেন তিনি।
ইন্দ্রের আদেশে উর্বশী অভিসারের উপযুক্ত বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে উপস্থিত হলেন সেই গৃহে, যেখানে অর্জুন বাস করছিলেন। অর্জুন উর্বশীকে দেখামাত্রই করজোড়ে তাঁকে মা বলে ডেকে অভিবাদন করলেন। উর্বশী সেই ডাকে ক্ষুব্ধ হলেন। পুরুষ তাঁকে চায়। পুরুষশ্রেষ্ঠ তাঁকে পায়। সেই তিনি আজ এসেছেন অর্জুনের কাছে। অর্জুনের মাতৃসম্বোধনে তিনি অসন্তুষ্টই হলেন। উর্বশীর অসন্তোষে লজ্জিত হলেন অর্জুন। পূর্বজদের স্মরণ করলেন তিনি। অপ্সরা উর্বশী তাঁর পূর্বপুরুষ রাজা পুরূরবার পত্নী। তাঁকে কামনা করবার কথা তিনি মনের কোণেও ঠাঁই দিতে পারেন না। দুহাত দিয়ে নিজের কানদুটো ঢেকে তিনি বলে ওঠেন, হে মাতঃ, আমার কাছে যেমন মাতা কুন্তী, যেমন শচীমাতা, ঠিক আপনিও তেমনি। দয়া করে প্রসন্ন হন আপনি।’ উর্বশী বলে ওঠেন, ‘হে বীর, আমরা অপ্সরারা সকলেই অনিয়ন্ত্রিত, সর্বপুরুষভোগ্যা। তাই আমি কখনওই আপনার মাতৃস্থানীয়া হতে পারি না।’

তবুও অর্জুন নিজের যুক্তিতে অটল রইলেন। তাঁর এই স্বর্গবাসের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ পৃথক। স্বর্গের কোন সুখ তাঁকে সুখী করতে সক্ষম নয়। যে লক্ষ্যে তিনি অবিচল, সে পথে তাঁর আরও বহু পথ হাঁটা বাকি। অর্জুনের অনমনীয় জেদে ক্রুদ্ধ হলেন উর্বশী। অভিশাপ দিলেন, ‘আজ যেভাবে তুমি আমায় ফিরিয়ে দিলে, তুমিও একদিন সম্মানহীন নর্ত্তকের জীবন কাটাবে।’ সে অভিশাপ মাথা পেতে নিলেন অর্জুন। বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল তাঁর মন।

মহাভারতের গল্প বলছেন সৌতি। গল্প মানুষকে আনন্দ দেয়, কখনও আবার চরিত্রগুলোর বিষাদে ভরিয়ে তোলে, তাদের সুখদুঃখের সঙ্গী করে। তবে কথকের বলার গুণে অনেকসময়েই মূলগল্পে রঙ লাগিয়ে। অতি সাধারণও তাতে যেমন অসাধারণতা পায়, তেমনি কখনও আবার অনেকজটিল কথাও সরল করে সকলের গ্রহণযোগ্য করে পেশ করেন কথক।

ঋগ্বেদে উর্বশী আর পুরূরবার কথা আছে। পরবর্তীকালের ব্রাহ্মণসাহিত্যে, পুরাণেও উর্বশীর কাহিনী রয়েছে। অর্জুনের পূর্বপুরুষ পুরূরবা তাঁকে কামনা করেছিলেন। বিবাহ হয়েছিল তাঁদের। পুরূরবার পুত্র পুরুর সাঁইত্রিশতম পরবর্তী পুরুষ হলেন অর্জুন। পুরুরবা যে উর্বশীকে বিয়ে করেছিলেন, সেই উর্বশী কীভাবে তাঁর পূর্ণরূপযৌবন নিয়ে পুরুরবার উত্তরবর্ত্তী আটত্রিশতম পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য উপস্থিত হতে পারেন?

যার সঙ্গে দুঃখের কোনও সম্পর্ক নেই, পরম অনন্ত সুখ যা তাই স্বর্গ। উর্বশীশব্দের অর্থ অতিজাগতিক পরম আনন্দ, জাগতিক চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে যে আনন্দ। এমন সুখ, এমন আনন্দ তো সকলেরই চাওয়ার। তবে কি উর্বশী সেই পরমসুখের প্রকাশ যা সকলের কাম্য? সেই অনন্ত সুখ যা লাভ করলে স্বর্গলাভের ফল মেলে? সেই সুখ যাকে দেবতারা কত না রাজরাজড়ারা, পুরুরবা থেকে শুরু করে অর্জুন অবধি ৩৮ পুরুষ ধরে সকলে চেয়ে এসেছেন, খুঁজে ফিরেছেন?

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে


Skip to content