রবিবার ১৯ মে, ২০২৪


যাত্রা যেন আর ফুরায় না। কত পথ পেরিয়ে এসেছেন পাণ্ডবেরা। আরও কত চলার বাকি। প্রতি পথের বাঁকে নিজেকে নতুন করে গড়ে নেওয়ার পালা। যুধিষ্ঠিরের স্থৈর্য, ক্ষমা, ভীমের প্রতাপ, অর্জুনের শস্ত্রদক্ষতা কোনওটাই আসন্ন মহারণে ফেলনা নয়। এবার সকলে মিলে এই পথটা পার করবার পালা। বড় সহজ নয় সে পথ। কারণ যদি যুদ্ধ হয়, তবে রাজ্যের বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ পুরুষেরা কৌরবদের পক্ষেই যুদ্ধ করবেন, একথা এতদিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমানে লড়বার জন্য আরও বলশালী হতে হবে, আরও কৌশল রপ্ত করতে হবে।

তাই ব্যাসদেবের পরামর্শে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির প্রিয় ভাই অর্জুনকে ডেকে পাঠালেন। অর্জুনকে জানালেন তাঁর মনোগত বাসনা। ইন্দ্রপুত্র অর্জুন। তপোবলে দেবরাজ ইন্দ্রকে যদি তিনি তুষ্ট করতে পারেন, তবে হয়ত দৈবীকৃপা লাভ হতে পারে। অস্ত্রশিক্ষার দৈবী পদ্ধতিও অর্জুনের করায়ত্ত হওয়া সম্ভব হতে পারে। অর্জুনের প্রতি যুধিষ্ঠিরের অগাধ আস্থা। তাই তাঁকে ডেকে বলেন, ‘অর্জুন দেবতাদের খুশি করতে হবে তোমাকে। পৌঁছতে হবে ইন্দ্রের কাছে। তিনি তুষ্ট হলে স্বর্গীয় সমস্ত অস্ত্র কৌশল তুমি জানতে পারবে।’

অর্জুন ভাইয়ের কথা পালন করতে রাজি হলে যুধিষ্ঠির তাঁকে প্রতিস্মৃতি মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। একাগ্রচিত্তে এই ইন্দ্রমন্ত্রের জপ করলে দেবতা প্রসন্ন হবেন। আর দেবতা প্রসন্ন হলে অর্জুন সহজেই অস্ত্রবিদ্যার পাঠ নিতে সমর্থ হবেন। বৃত্রাসুরের ভয়ে সমস্ত দেবতারা নিজের নিজের শক্তি ইন্দ্রের কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন। সুতরাং ইন্দ্রের শরণাপন্ন হলে অভীষ্টসিদ্ধি হতে পারে।
যুধিষ্ঠিরের আদেশে, সকলের শুভেচ্ছা সঙ্গে নিয়ে অর্জুন একাগ্রচিত্তে ইন্দ্রমন্ত্র স্মরণ করতে করতে রওনা দিলেন। বহু পথ, নগর, জনপদ, বিপদ বাধা পার করে অর্জুন হিমালয়ে এসে পৌঁছালেন। পথে চলতে চলতে অর্জুনকে যেন তীব্র মানসিক তেজ ভর করেছিল। পাশাখেলার আসরের অসম্মান যেন অবচেতনে তাড়িয়ে নিয়ে চলছিল তাঁকে। সর্বশস্ত্রে নিপুণ হতে হবে। তবেই শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের আগে কোনও ফাঁক যেন না থাকে। তীব্র জেদ ঘিরে ধরে তাঁকে। ইন্দ্রচিন্তায় ডুবে যান তিনি। যেন কোনও এক ঘোরের বশে এগিয়ে চলেন দিনরাত এক করে।
ইন্দ্রকীল পর্বতে পৌঁছতেই তাঁর অবচেতনে কে যেন বলে ওঠে ‘থাম এবার’। সম্বিত ফেরে তাঁর। এদিক ওদিক তাকিয়ে এক গাছের তলায় এক রোগাসোগা অথচ বেশ উজ্জ্বল চেহারার তাপসকে দেখতে পেলেন। সেই তাপস হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, ‘কে তুমি? এই স্থান তপস্বী ব্রাহ্মণদের, যাঁরা ক্রোধ কিংবা আনন্দ উভয়কেই বিসর্জন দিয়েছেন। এমন স্থানে অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়ে তোমার কেনই বা আগমন?’ তাপস দৃঢ়স্বরে আবারো বলে উঠলেন, ‘হে বীর! অস্ত্রত্যাগ কর। তপোবলে তুমি এমন স্থানে উপস্থিত হতে পেরেছো, যা সাধারণের অগম্য।’ অর্জুন লক্ষ্যে স্থির ছিলেন।

তাপসের এ কথা তাঁকে টলাতে পারল না। তাপস তখন বলে উঠলেন, ‘অর্জুন! আমি দেবরাজ ইন্দ্র। তুমি বর নাও’। অর্জুনের প্রাণের দেবতাকে চোখের সামনে দেখে কৃতাঞ্জলিপুটে বলে উঠলেন, ‘হে দেব আমার একমাত্র অভীষ্ট হল আপনার কাছ থেকে যাবতীয় অস্ত্রবিদ্যা শেখা।’ ইন্দ্র বলেন, ‘তুমি এখানে এসেছ। আর তোমার অস্ত্রে কি প্রয়োজন? তোমার পরম গতি লাভ হয়েছে। তুমি স্বর্গ প্রার্থনা কর।’ অর্জুন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বর্গের লোভও তাঁকে টলাতে পারে না। তিনি বলে ওঠেন —
আমার ভাইয়েরা আজো বনে বনে দীনবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমতাবস্থায় শত্রুদের অপমানের প্রতিশোধ না নিয়ে আমি স্বর্গ এমনকি দেবত্বও চাই না। ইন্দ্র খুশি হলেন। অর্জুনের একাগ্রতা পরীক্ষা করতে চাইছিলেন তিনি। অর্জুন সে পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। ইন্দ্র বলে ওঠেন, ‘হে অর্জুন! তুমি সমস্ত দিব্য অস্ত্র লাভ করবে। কিন্তু তার আগে তোমাকে মহাদেবের দর্শনলাভ করতে হবে। তাঁর দর্শন পেলে তোমার অভীষ্টসিদ্ধি হবে।’

অর্জুন বুঝলেন তাঁর যাত্রা এখনও বাকি। তিনি এগিয়ে চললেন, লক্ষ্য স্থির রেখে, সংহতচিত্ত হয়ে, জপ করতে করতে।

Skip to content