ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
দ্রোণের পড়াশুনো শুরু হল পিতার আশ্রমে তাঁরই তত্ত্বাবধানে। ভরদ্বাজের সে আশ্রমে যেমন শিখতে এসেছিলেন অগ্নিবেশ্যের মতো মুনির ছেলে তেমনি ঋষির বন্ধুরাজা পৃষতের পুত্র দ্রুপদও। প্রায় সমবয়সি ছিলেন দ্রোণ আর দ্রুপদ। কিন্তু তা সত্ত্বেও উভয়ের যে ছিল অনেক ফারাক। একজন গরিব ব্রাহ্মণের ছেলে। রাজার সন্তান অপরজন। কিন্তু শিশুমন কি আর সেসব ভেদজ্ঞান বোঝে? বন্ধুত্ব হল দুজনের। খেলা আর পড়া দুটোতেই একে অপরের অপরিহার্য সঙ্গী হলেন। তারপর একদিন রাজার ছেলের পড়াশোনার পাট চুকল। বিচ্ছেদ হল দুই প্রিয়সখার। দ্রুপদ ফিরে গেলেন নিজের রাজ্যে। যাওয়ার আগে বলে এবার যে তাঁর রাজা সাজার সময়! পিতার দেহত্যাগের পর পাঞ্চালদেশের রাজা হলেন তিনি। ছোটবেলার বলখেলার দিন রইল পিছনে পড়ে। আর এদিকে দ্রোণ আরও জ্ঞানার্জনে নিমগ্ন করলেন নিজেকে। দুজনের জীবন বইতে লাগল ভিন্ন খাতে।
এদিকে পিতার কাছে শিক্ষালাভ সম্পন্ন হলে দ্রোণ বিবাহ করলেন সংসারী হবার ইচ্ছায় আবার কতকটা পুত্রকামনাতেও বটে। কৃপাচার্যের ভগিনী গৌতমী কৃপী তেমন সুন্দরী ছিলেন না বটে। তবে তিনি পুরুষানুক্রমে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী হয়েছিলেন। দ্রোণের যাবতীয় ধর্মকর্মের যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন তিনি। গৌতমীর গর্ভে দ্রোণের এক সন্তানও জন্মে। সে আবার জন্মের সময় বিকট শব্দ করেছিল। কতকটা ঘোড়ার শব্দের মতো। তার নাম দিলেন দ্রোণ অশ্বত্থামা। সংসারাশ্রমে প্রবেশ করেও দ্রোণের জ্ঞানস্পৃহা কমেনি। পিতার আশ্রমে নিত্য শস্ত্রশাস্ত্র চর্চার পরেও আরও অধিকতর পিপাসার উপশমে পরশুরামের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন আর তাঁর কাছ থেকেও শিখে নিলেন শস্ত্রবিদ্যার খুঁটিনাটি। ফিরে আসার পর তাঁর মনে হল, অনেককাল পিতার আশ্রমে কালক্ষেপ করেছেন। এবার ভাগ্যান্বেষণের সময় এসেছে। সমস্ত দিক থেকেই তিনি আচার্য হবার উপযুক্ত। কোথায় যাবেন? কোন রাজার দরবার তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দেবে? এ সময়ে প্রথমেই মনে এল ছোটবেলার সখার কথা। আজকের সংসারের কঠোর দিনেও সে দিনগুলোর কথা স্মৃতিতে অমলিন। বন্ধু তাঁকে কখনওই নিরাশ করবে না। বড় আশায় বুক বেঁধে যাত্রা করেন তিনি পাঞ্চালের পথে। দ্রোণের সে কল্পলোকের বিলাসযান আছড়ে পড়ল বাস্তবের রূঢ় মাটিতে যখন দ্রুপদ তাঁকে বন্ধু হিসেবে স্বীকার করতে চাইলেন না মোটেই। সে ছিল এক অন্য আমল, যখন তাঁদের পিতারা ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সেই পৃষতরাজার পুত্র আজ পিতার বন্ধুর পুত্রকে, তাঁর ছেলেখেলার সঙ্গীকে সখা বলে মানতে নারাজ। এমন অসম বন্ধুত্ব কীভাবে মানবেন তিনি? এমন সব নানান যুক্তি দিয়ে অপমান করলেন দ্রোণকে তীব্রভাষায়। হয়তো সমকক্ষ দ্রোণের উপস্থিতি তিনি রাজ্যে মেনে নিতে পারেননি, হয়তো বা ছেলেবেলার সে সুখস্মৃতি তাঁর মনেও ছিল অটুট, কিন্তু আজ রাজা তিনি। কীভাবেই বা এমন কাউকে মেনে নেবেন নিজের রাজ্যে যে আজ কপর্দকহীন হলেও অনায়াসে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হবার ক্ষমতা রাখেন। হয়তো মনে পড়ে গেল খেলাচ্ছলে করা সে শপথ, যাতে তিনি ভরসা দিয়েছিলেন প্রিয়সখাকে রাজ্যসুখ একসঙ্গেই ভোগ করবেন। বন্ধুও হবে তাঁর সে রাজত্বের অংশীদার! নিজের সে দুর্বলতা আড়াল করতেই হয়তো বা জর্জরিত করলেন তাঁকে বাক্যবাণে, ফিরিয়ে দিলেন প্রিয়সখাকে, অস্বীকার করলেন ফেলে আসা মুহূর্তগুলো।
ভগ্নহৃদয়ে দ্রোণ ফিরে গেলেন। মনে তাঁর অপমানের তীব্র আগুন জ্বলছে। সে মুহূর্তে কোনও কর্তব্য স্থির করতে পারলেন না তিনি। তবে প্রতিশোধের চিন্তা অবচেতনে দৃঢ়প্রোথিত হল। কিছুদিন পরিচয় গোপন করে শ্যালক কৃপাচার্যের কাছে রইলেন তিনি। কৃপ তখন কুরুবালকদের অস্ত্রবিদ্যা শেখাচ্ছেন। হস্তিনাপুরে তাঁর অধিষ্ঠান। তখনও কি আর দ্রোণ জানতেন যে তাঁর ভবিষ্যৎ-এর অন্ন এ রাজ্যেই স্থির হয়ে আছে!
এদিকে গৃহে অন্নাভাব থাকলে কী হবে? বিদ্যা তো আর সুপ্ত থাকে না! দ্রোণের ছেলে অশ্বত্থামা ততদিনে পিতার কাছে সমস্ত বিদ্যা শিক্ষা করেছেন। কৃপের শিক্ষাদানের পরে কুন্তীর ছেলেদের তিনি শেখাতেন অস্ত্রবিদ্যা। তবে অবশ্যই সবার অগোচরে। ছেলেদের ছেলেমানুষির মাঝেই চলত সে শিক্ষা। ফলে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। তারপর একদিন ছেলেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ হল দ্রোণের। বড় অদ্ভুত সে সাক্ষাৎ। ছেলেরা বল খেলছিল। সে বল গিয়ে পড়ে কুয়োয়। দ্রোণাচার্য তা দেখে তাঁর বিশেষ অস্ত্রবিদ্যা প্রয়োগ করে যখন সে বল তুলে দিলেন, অবাক হল তারা কৃশকায়, সাধারণদর্শন এক ব্রাহ্মণের এমন অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে। কুরুবালকেরা সেসব কথা গিয়ে জানাল তাদের পিতামহকে। বিচক্ষণ ভীষ্ম দ্রোণের সংবাদ রাখতেন। প্রকৃত বিদ্বানের বিদ্যাবত্তা কখনও অগোচরে থাকে না। ভীষ্ম তৎক্ষণাত্ স্থির করলেন, কুরুবালকদের উন্নততর অস্ত্রশিক্ষার জন্য দ্রোণই উপযুক্ত গুরু। শান্তনুনন্দন ভীষ্মের মতো বুদ্ধিমান বিচক্ষণ পুরুষ যখন দ্রোণকে তাঁর হস্তিনাপুরে আগমনের হেতু জিজ্ঞাসা করলেন, দ্রোণ জানালেন সমস্ত বৃত্তান্ত, উগরে দিলেন ক্ষোভ, ভাগ করে নিলেন অপমানের সে দাহ।
দ্রোণের অবচেতনের সে প্রতিশোধস্পৃহা আজ তাঁর চেতনাজুড়ে। দ্রুপদের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব একমাত্র গুণবান শিষ্যের দ্বারা। কুরুবালকদের দ্বারাই সে সম্ভব হতে পারে। হস্তিনাপুরে তিনি পেলেন তাঁর উপযুক্ত সম্মান। শিষ্যদের মধ্যে অর্জুনের মনোযোগ, ক্ষিপ্রতা ছিল সবচাইতে বেশি। খুব শীঘ্রই তা দ্রোণের নজরে এল। আর তাছাড়া অর্জুনের গুরুভক্তিও ছিল অধিক। পুত্র অশ্বত্থামাকে সকলের সঙ্গে শিক্ষা দানের সময় সকলের মুহূর্তের অগোচরে বিশেষ শিক্ষাদানের বিষয়টি অপর কুরুবালকদের দৃষ্টি এড়ালেও অর্জুন তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তায় সেটাও অধিগত করতেন। এইভাবে ধীরে ধীরে একদিকে যেমন তিনি অস্ত্রবিদ্যায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলেন আবার গুরুরও অতিস্নেহের পাত্র হয়ে উঠতে লাগলেন। এভাবে নানান উপায়ে কুরুবালকদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পন্ন হল। তারপর কোনও একদিন দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে কৃপাচার্যের উপস্থিতিতে ধৃতরাষ্ট্রাদি কুরুবংশের প্রধান পুরুষদের সম্মুখে এক সভায় কৌরব আর পাণ্ডবভাইয়েরা সকলে অধীত অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শন করল। সভান্তে পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের অস্ত্রজ্ঞ জেনে দ্রোণ তাঁর গুরুদক্ষিণা চাইলেন। এতদিনে তাঁর সে অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। কুরুবালকদের নির্দেশ দিলেন তিনি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে জীবন্ত অবস্থায় বন্দি করে নিয়ে আসতে হবে তাঁর কাছে। এই হবে তাদের গুরুদক্ষিণা। অধীত অস্ত্রবিদ্যা প্রয়োগেরও এই যথার্থ সময়। কৌরবপাণ্ডবদের সঙ্গে পাঞ্চালদেশের বীরসৈন্যদের প্রবল যুদ্ধ হল। বিশেষত ভীমার্জুনের প্রবল পরাক্রমে বন্দি হলেন দ্রুপদ। গুরুর কাছে রাজা দ্রুপদকে নিয়ে উপস্থিত হলেন পরাক্রমী দ্রুপদ আজ ভগ্নোদ্যম, হৃতসর্বস্ব। তাঁর সে অহংকারও অতীত। দ্রুপদরাজার এমন অসম্মানের চেয়ে আর কীই বা প্রতিশোধ হতে পারে? দুই বন্ধুর দেখা হল আবার জীবনের এক অদ্ভুত মোড়ে। ব্রাহ্মণ দ্রোণ মুক্তি দিলেন দ্রুপদকে। তাঁর হৃতরাজ্যের অর্ধ ফিরিয়ে দিলেন তাঁকেই। ফিরে চাইলেন সেই ফেলে আসা বন্ধুতা। যতই অসহনীয় হোক এ পরিস্থিতি, মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় কি! কপর্দকহীন দ্রুপদ দ্রোণের এ দাক্ষিণ্য, সখিত্ব স্বীকার করলেন বাধ্য হয়ে, হাসিমুখে। মনে মনে তৈরি হয়ে গেল শত্রুতা। আপাত বন্ধুতার আড়ালে উপ্ত হল আগামীর যুদ্ধের বীজ।
এদিকে পিতার কাছে শিক্ষালাভ সম্পন্ন হলে দ্রোণ বিবাহ করলেন সংসারী হবার ইচ্ছায় আবার কতকটা পুত্রকামনাতেও বটে। কৃপাচার্যের ভগিনী গৌতমী কৃপী তেমন সুন্দরী ছিলেন না বটে। তবে তিনি পুরুষানুক্রমে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী হয়েছিলেন। দ্রোণের যাবতীয় ধর্মকর্মের যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন তিনি। গৌতমীর গর্ভে দ্রোণের এক সন্তানও জন্মে। সে আবার জন্মের সময় বিকট শব্দ করেছিল। কতকটা ঘোড়ার শব্দের মতো। তার নাম দিলেন দ্রোণ অশ্বত্থামা। সংসারাশ্রমে প্রবেশ করেও দ্রোণের জ্ঞানস্পৃহা কমেনি। পিতার আশ্রমে নিত্য শস্ত্রশাস্ত্র চর্চার পরেও আরও অধিকতর পিপাসার উপশমে পরশুরামের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন আর তাঁর কাছ থেকেও শিখে নিলেন শস্ত্রবিদ্যার খুঁটিনাটি। ফিরে আসার পর তাঁর মনে হল, অনেককাল পিতার আশ্রমে কালক্ষেপ করেছেন। এবার ভাগ্যান্বেষণের সময় এসেছে। সমস্ত দিক থেকেই তিনি আচার্য হবার উপযুক্ত। কোথায় যাবেন? কোন রাজার দরবার তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দেবে? এ সময়ে প্রথমেই মনে এল ছোটবেলার সখার কথা। আজকের সংসারের কঠোর দিনেও সে দিনগুলোর কথা স্মৃতিতে অমলিন। বন্ধু তাঁকে কখনওই নিরাশ করবে না। বড় আশায় বুক বেঁধে যাত্রা করেন তিনি পাঞ্চালের পথে। দ্রোণের সে কল্পলোকের বিলাসযান আছড়ে পড়ল বাস্তবের রূঢ় মাটিতে যখন দ্রুপদ তাঁকে বন্ধু হিসেবে স্বীকার করতে চাইলেন না মোটেই। সে ছিল এক অন্য আমল, যখন তাঁদের পিতারা ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সেই পৃষতরাজার পুত্র আজ পিতার বন্ধুর পুত্রকে, তাঁর ছেলেখেলার সঙ্গীকে সখা বলে মানতে নারাজ। এমন অসম বন্ধুত্ব কীভাবে মানবেন তিনি? এমন সব নানান যুক্তি দিয়ে অপমান করলেন দ্রোণকে তীব্রভাষায়। হয়তো সমকক্ষ দ্রোণের উপস্থিতি তিনি রাজ্যে মেনে নিতে পারেননি, হয়তো বা ছেলেবেলার সে সুখস্মৃতি তাঁর মনেও ছিল অটুট, কিন্তু আজ রাজা তিনি। কীভাবেই বা এমন কাউকে মেনে নেবেন নিজের রাজ্যে যে আজ কপর্দকহীন হলেও অনায়াসে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হবার ক্ষমতা রাখেন। হয়তো মনে পড়ে গেল খেলাচ্ছলে করা সে শপথ, যাতে তিনি ভরসা দিয়েছিলেন প্রিয়সখাকে রাজ্যসুখ একসঙ্গেই ভোগ করবেন। বন্ধুও হবে তাঁর সে রাজত্বের অংশীদার! নিজের সে দুর্বলতা আড়াল করতেই হয়তো বা জর্জরিত করলেন তাঁকে বাক্যবাণে, ফিরিয়ে দিলেন প্রিয়সখাকে, অস্বীকার করলেন ফেলে আসা মুহূর্তগুলো।
ভগ্নহৃদয়ে দ্রোণ ফিরে গেলেন। মনে তাঁর অপমানের তীব্র আগুন জ্বলছে। সে মুহূর্তে কোনও কর্তব্য স্থির করতে পারলেন না তিনি। তবে প্রতিশোধের চিন্তা অবচেতনে দৃঢ়প্রোথিত হল। কিছুদিন পরিচয় গোপন করে শ্যালক কৃপাচার্যের কাছে রইলেন তিনি। কৃপ তখন কুরুবালকদের অস্ত্রবিদ্যা শেখাচ্ছেন। হস্তিনাপুরে তাঁর অধিষ্ঠান। তখনও কি আর দ্রোণ জানতেন যে তাঁর ভবিষ্যৎ-এর অন্ন এ রাজ্যেই স্থির হয়ে আছে!
এদিকে গৃহে অন্নাভাব থাকলে কী হবে? বিদ্যা তো আর সুপ্ত থাকে না! দ্রোণের ছেলে অশ্বত্থামা ততদিনে পিতার কাছে সমস্ত বিদ্যা শিক্ষা করেছেন। কৃপের শিক্ষাদানের পরে কুন্তীর ছেলেদের তিনি শেখাতেন অস্ত্রবিদ্যা। তবে অবশ্যই সবার অগোচরে। ছেলেদের ছেলেমানুষির মাঝেই চলত সে শিক্ষা। ফলে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। তারপর একদিন ছেলেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ হল দ্রোণের। বড় অদ্ভুত সে সাক্ষাৎ। ছেলেরা বল খেলছিল। সে বল গিয়ে পড়ে কুয়োয়। দ্রোণাচার্য তা দেখে তাঁর বিশেষ অস্ত্রবিদ্যা প্রয়োগ করে যখন সে বল তুলে দিলেন, অবাক হল তারা কৃশকায়, সাধারণদর্শন এক ব্রাহ্মণের এমন অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে। কুরুবালকেরা সেসব কথা গিয়ে জানাল তাদের পিতামহকে। বিচক্ষণ ভীষ্ম দ্রোণের সংবাদ রাখতেন। প্রকৃত বিদ্বানের বিদ্যাবত্তা কখনও অগোচরে থাকে না। ভীষ্ম তৎক্ষণাত্ স্থির করলেন, কুরুবালকদের উন্নততর অস্ত্রশিক্ষার জন্য দ্রোণই উপযুক্ত গুরু। শান্তনুনন্দন ভীষ্মের মতো বুদ্ধিমান বিচক্ষণ পুরুষ যখন দ্রোণকে তাঁর হস্তিনাপুরে আগমনের হেতু জিজ্ঞাসা করলেন, দ্রোণ জানালেন সমস্ত বৃত্তান্ত, উগরে দিলেন ক্ষোভ, ভাগ করে নিলেন অপমানের সে দাহ।
দ্রোণের অবচেতনের সে প্রতিশোধস্পৃহা আজ তাঁর চেতনাজুড়ে। দ্রুপদের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া সম্ভব একমাত্র গুণবান শিষ্যের দ্বারা। কুরুবালকদের দ্বারাই সে সম্ভব হতে পারে। হস্তিনাপুরে তিনি পেলেন তাঁর উপযুক্ত সম্মান। শিষ্যদের মধ্যে অর্জুনের মনোযোগ, ক্ষিপ্রতা ছিল সবচাইতে বেশি। খুব শীঘ্রই তা দ্রোণের নজরে এল। আর তাছাড়া অর্জুনের গুরুভক্তিও ছিল অধিক। পুত্র অশ্বত্থামাকে সকলের সঙ্গে শিক্ষা দানের সময় সকলের মুহূর্তের অগোচরে বিশেষ শিক্ষাদানের বিষয়টি অপর কুরুবালকদের দৃষ্টি এড়ালেও অর্জুন তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তায় সেটাও অধিগত করতেন। এইভাবে ধীরে ধীরে একদিকে যেমন তিনি অস্ত্রবিদ্যায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলেন আবার গুরুরও অতিস্নেহের পাত্র হয়ে উঠতে লাগলেন। এভাবে নানান উপায়ে কুরুবালকদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পন্ন হল। তারপর কোনও একদিন দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে কৃপাচার্যের উপস্থিতিতে ধৃতরাষ্ট্রাদি কুরুবংশের প্রধান পুরুষদের সম্মুখে এক সভায় কৌরব আর পাণ্ডবভাইয়েরা সকলে অধীত অস্ত্রবিদ্যা প্রদর্শন করল। সভান্তে পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের অস্ত্রজ্ঞ জেনে দ্রোণ তাঁর গুরুদক্ষিণা চাইলেন। এতদিনে তাঁর সে অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। কুরুবালকদের নির্দেশ দিলেন তিনি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে জীবন্ত অবস্থায় বন্দি করে নিয়ে আসতে হবে তাঁর কাছে। এই হবে তাদের গুরুদক্ষিণা। অধীত অস্ত্রবিদ্যা প্রয়োগেরও এই যথার্থ সময়। কৌরবপাণ্ডবদের সঙ্গে পাঞ্চালদেশের বীরসৈন্যদের প্রবল যুদ্ধ হল। বিশেষত ভীমার্জুনের প্রবল পরাক্রমে বন্দি হলেন দ্রুপদ। গুরুর কাছে রাজা দ্রুপদকে নিয়ে উপস্থিত হলেন পরাক্রমী দ্রুপদ আজ ভগ্নোদ্যম, হৃতসর্বস্ব। তাঁর সে অহংকারও অতীত। দ্রুপদরাজার এমন অসম্মানের চেয়ে আর কীই বা প্রতিশোধ হতে পারে? দুই বন্ধুর দেখা হল আবার জীবনের এক অদ্ভুত মোড়ে। ব্রাহ্মণ দ্রোণ মুক্তি দিলেন দ্রুপদকে। তাঁর হৃতরাজ্যের অর্ধ ফিরিয়ে দিলেন তাঁকেই। ফিরে চাইলেন সেই ফেলে আসা বন্ধুতা। যতই অসহনীয় হোক এ পরিস্থিতি, মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় কি! কপর্দকহীন দ্রুপদ দ্রোণের এ দাক্ষিণ্য, সখিত্ব স্বীকার করলেন বাধ্য হয়ে, হাসিমুখে। মনে মনে তৈরি হয়ে গেল শত্রুতা। আপাত বন্ধুতার আড়ালে উপ্ত হল আগামীর যুদ্ধের বীজ।