রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য।

ত্রিপুরা খুবই প্রাচীন এক রাজ্য। সমুদ্র গুপ্তের শিলালিপিতেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সমতট ও কামরূপের মতো ত্রিপুরাও সম্রাট সমুদ্র গুপ্তকে কর প্রদান করতো। সুপ্রাচীনকালে এই রাজ্যের আয়তনও ছিল বিরাট। কেউ কেউ বলেছেন, একদা সমুদ্রতট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এর সীমা। ত্রিপুরার রাজাদের ইচ্ছা ও নির্দেশে রচিত হয়েছিল ‘রাজমালা’। মূলত রাজা ও রাজবংশের গুণকীর্তন নির্ভর কাব্যগ্রন্থ এটি। অবশ্য ‘রাজমালা’য় বর্ণিত পঞ্চদশ শতকের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ ইতিহাসের সঙ্গে মোটামুটি সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা।
ত্রিপুরার রাজাগণ চন্দ্র বংশ উদ্ভূত বলে বর্ণিত আছে ‘রাজমালা’য়। চন্দ্র বংশের নৃপতি যযাতি পুত্র দ্রুহ্যকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। মহাবল দ্রুহ্য কিরাত ভূমিতে এসে পরাজিত করেন কিরাত নৃপতিদের। তারপর কোপল নদীর তীরে গড়ে তোলেন ত্রিবেগ নগরী। তিনি জয় করেন অনেক দেশ। কালক্রমে তাঁর বিজিত সব দেশ ‘ত্রিবেগ’ নাম লাভ করে। সুদূর অতীতের সেই ত্রিবেগ নগরীর সঠিক অবস্থান নির্ণয় আজ দুরূহ। কেউ বলেছেন, গঙ্গাসাগর সঙ্গমের সন্নিহিত সাগরদ্বীপে নির্মিত হয়েছিল নগরী ত্রিবেগ। কেউ আবার ‘কোপল’কে বলেছেন ব্রহ্মপুত্র এবং এই ব্রহ্মপুত্রের তীরেই ত্রিবেগ নগরীর কথা উল্লেখ করেছেন তারা।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৮: সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-পরিচয়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

দ্রুহ্যের অনেককাল পর সিংহাসনে বসেন দৈত্য। তারপর আসেন ত্রিপুর নামের এক অত্যাচারী নৃপতি। তার অত্যাচারে অতিষ্ট প্রজাগণ। একদিন ভক্তদের আকুল প্রার্থনায় মহাদেব ত্রিশূলের আঘাতে বধ করলেন ত্রিপুরকে। তারপর মহাদেবের আশীর্বাদে ত্রিপুরের রাণি হীরাবতী জন্ম দিলেন ত্রিলোচনের। একদিন রাজা হলেন প্রজাবৎসল, ধর্মপ্রাণ ত্রিলোচন। সুবড়াই রাজা নামে পরিচিত হলেন তিনি। মহাদেবের আদেশে চতুর্দ্দশ দেবতার পুজো শুরু করেছিলেন ত্রিলোচন। সেই থেকে ত্রিপুরার রাজাদের কুল দেবতা চতুর্দ্দশ দেবতা। যুথিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়ে ত্রিলোচন হস্তিনাপুর গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যে বয়ন শিল্পের উন্নয়নে বিস্তর চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩২: কলি কলিং

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

ত্রিপুরার পরবর্তীকালের রাজা কুমারও খুব ধার্মিক ছিলেন। মনু নদীর তীরে ছাম্বুল নগরে তিনি শিবের আরাধনা করেছিলেন। ছাম্বুল নগরে সরিয়ে এনেছিলেন রাজধানী। প্রচলিত বিশ্বাস সেই ছাম্বুল নগর মনু নদী তীরবর্তী আজকের কৈলাসহর। আর কুমার শিবের আরাধনা করেছিলেন ঊনকোটিতে। এই ভাবে সুপ্রাচীনকাল থেকেই ত্রিপুরার রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছে নানা জায়গায়। ক্রমেই উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সরে আসে রাজধানী।

চতুর্দশ দেবতার প্রাচীন মন্দির।

কৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর সুবিখ্যাত ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্ৰন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ত্রিপুর রাজবংশ ক্রমে ক্রমে দক্ষিণ দিকে রাজ্য বিস্তারে যত্নবান হয়েছিলেন। তারা উত্তর কাছাড় থেকে ক্রমে ক্রমে মধ্য কাছাড় এবং সেখান থেকে দক্ষিণ কাছাড়, পরে সেদিনের কৈলাসহর উপ বিভাগের অন্তর্গত ফটিয়াকুলি, মানিকচন্দন প্রভৃতি নানা স্থানে রাজধানী নির্মাণ করিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

ক্রমে ক্রমে ত্রিপুর নৃপতিরা কৈলাসহরের নিকটবর্তী স্থান পরিত্যাগ করে আরও দক্ষিণদিকে সরে গিয়েছিলেন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে যুঝার ফা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লিকা রাজাকে পরাস্ত করে অধিকার করেন রাঙামাটি। সেখানে স্থাপন করেন তাঁর রাজধানী। সেই থেকে সুদীর্ঘকাল রাঙামাটি ছিল ত্রিপুরার রাজধানী। এই রাঙামাটিই আজকের উদয়পুর। জুঝারফা প্রথম ত্রিপুরাব্দের সূচনা করেছিলেন।—চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content