আমাদের গ্রামের বাড়ির বাস্তুজমিতে দুটো পুকুর ছিল। একটা পুকুর বাড়ির লাগোয়া, আর একটা বাড়ির পেছনে প্রায় ৫০ ফুট দূরে। বাড়ি লাগোয়া পুকুরের উত্তর দিকে জাল ফেললে জালে পোড়া মাটির বাসনের প্রচুর ভাঙা টুকরো উঠত। তাতে জাল প্রায়শই ছিঁড়ে যেত। আমরা পুকুরে স্নান করতে বা মাছ ধরতে নামলে ওই অংশ এড়িয়ে যেতাম কারণ তা না হলে ভাঙা টুকরোয় পা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা। ছোটবেলা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ওইরকম ভাঙা টুকরো পুকুরের ওই অংশে নিঃশেষ হয়নি। মাটি ক্ষয়ে গেলে নীচে থেকে নতুন নতুন ভাঙা টুকরো উঠে আসে।
প্রায় চার দশক আগে ওই পুকুর খনন করার সময় একটি সম্পূর্ণ অক্ষত পোড়া মাটির পাত্র পাওয়া যায়। পাত্রটির আকৃতি ছিল অনেকটা গেলাসের মতো, তবে তলার দিকটা সমতল নয়, বরং উত্তলাকার। ফলে খাড়াভাবে পাত্রটিকে কোথাও বসানো সম্ভব নয়। পাত্রটি লম্বায় ছিল প্রায় দশ ইঞ্চি, আর ব্যাস প্রায় চার ইঞ্চি। পাত্রের ভেতরের দিক মসৃণ হলেও বাইরের দিকে পুরোটাই তির্যক আঁচড় কাটা দাগ। ভাঙা টুকরোগুলোতেও ওইরকম দাগ থাকত।
আমার ঠাকুরমা বলতেন, এগুলো ‘নুনের কুড়ি’। চার-পাঁচ দশক আগেও সুন্দরবন এলাকায় নোনা জল থেকে যে নুন তৈরি করা হত এবং সেই নুনের উপরেই সব মানুষকে নির্ভর করতে হত তা তো আশৈশব আমার চোখে দেখা। আমাদের বাড়িতেও নোনা জল থেকে নুন তৈরি করা হত। আমাদের বাড়ির সামনে প্রায় ১০০ ফুট দূরে ছিল একটা খাল। বাবা বলতেন, এর নাম ঘিয়াবতীর শাখা খাল। চার-পাঁচ দশক আগেও দেখেছি ওই খালে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা খেলত।
ঠাকুরমার মুখ থেকে শুনেছি, আমাদের উঠোনের সামনে পর্যন্ত জোয়ারের জল পৌঁছে যেত। তার মানে সুদূর অতীতে বর্তমানের খালটি অনেক চওড়া ছিল। হয়তো একসময় তা নদী ছিল। আর তার তীরে নিশ্চিতভাবে ছিল এক জনপদ যারা লবণ তৈরি করত। হয়তো কয়েকশো বা সহস্রাধিক বছর আগে তা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর নদীর পলি জমে তৈরি হয় উঁচু স্থলভাগ। নদী পর্যবসিত হয় খালে। আর সেই নতুন স্থলভাগের উপরে তৈরি হয় নতুন ম্যানগ্রোভ অরণ্য। প্রায় দু’শো থেকে আড়াইশো বছর আগে সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে বর্তমান জনপদগুলি গড়ে ওঠে। সুতরাং একথা হলফ করে বলা যায় যে, সুন্দরবন অঞ্চলে ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে যে লবণ শিল্প আমি শৈশবে দেখেছি তা আসলে কয়েকশো বছরের এক পুরোনো শিল্প।
প্রায় চার দশক আগে ওই পুকুর খনন করার সময় একটি সম্পূর্ণ অক্ষত পোড়া মাটির পাত্র পাওয়া যায়। পাত্রটির আকৃতি ছিল অনেকটা গেলাসের মতো, তবে তলার দিকটা সমতল নয়, বরং উত্তলাকার। ফলে খাড়াভাবে পাত্রটিকে কোথাও বসানো সম্ভব নয়। পাত্রটি লম্বায় ছিল প্রায় দশ ইঞ্চি, আর ব্যাস প্রায় চার ইঞ্চি। পাত্রের ভেতরের দিক মসৃণ হলেও বাইরের দিকে পুরোটাই তির্যক আঁচড় কাটা দাগ। ভাঙা টুকরোগুলোতেও ওইরকম দাগ থাকত।
আমার ঠাকুরমা বলতেন, এগুলো ‘নুনের কুড়ি’। চার-পাঁচ দশক আগেও সুন্দরবন এলাকায় নোনা জল থেকে যে নুন তৈরি করা হত এবং সেই নুনের উপরেই সব মানুষকে নির্ভর করতে হত তা তো আশৈশব আমার চোখে দেখা। আমাদের বাড়িতেও নোনা জল থেকে নুন তৈরি করা হত। আমাদের বাড়ির সামনে প্রায় ১০০ ফুট দূরে ছিল একটা খাল। বাবা বলতেন, এর নাম ঘিয়াবতীর শাখা খাল। চার-পাঁচ দশক আগেও দেখেছি ওই খালে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা খেলত।
ঠাকুরমার মুখ থেকে শুনেছি, আমাদের উঠোনের সামনে পর্যন্ত জোয়ারের জল পৌঁছে যেত। তার মানে সুদূর অতীতে বর্তমানের খালটি অনেক চওড়া ছিল। হয়তো একসময় তা নদী ছিল। আর তার তীরে নিশ্চিতভাবে ছিল এক জনপদ যারা লবণ তৈরি করত। হয়তো কয়েকশো বা সহস্রাধিক বছর আগে তা কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর নদীর পলি জমে তৈরি হয় উঁচু স্থলভাগ। নদী পর্যবসিত হয় খালে। আর সেই নতুন স্থলভাগের উপরে তৈরি হয় নতুন ম্যানগ্রোভ অরণ্য। প্রায় দু’শো থেকে আড়াইশো বছর আগে সুন্দরবনের জঙ্গল হাসিল করে বর্তমান জনপদগুলি গড়ে ওঠে। সুতরাং একথা হলফ করে বলা যায় যে, সুন্দরবন অঞ্চলে ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে যে লবণ শিল্প আমি শৈশবে দেখেছি তা আসলে কয়েকশো বছরের এক পুরোনো শিল্প।
অতীতে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের জনপদগুলিতে বাড়িতে তৈরি করা লবণই সম্বৎসর লবনের চাহিদা মেটাত। নভেম্বর থেকে মে মাস ছিল লবণ তৈরির জন্য উপযুক্ত সময়। এপ্রিল মাসে নোনা জলের লবণক্ততা সবচেয়ে বেশি থাকে বলে ওই মাসে সবচেয়ে বেশি লবন তৈরি করা হত। আমার বাড়ির সামনে যে খালটি ছিল তাতে ভরা জোয়ারের সময় দুই পাড় ছাপিয়ে দু’পাশের নীচু জমিতে জল ভরে যেত। ওই নীচু জমিগুলি আল দিয়ে ছোট ছোট প্লট করে ঘেরা থাকত। ভাটার সময় জল নেমে গেলে আলে নোনা জল আটকা পড়ে যেত। রোদের তাপে জল শুকিয়ে যেত কয়েক দিনের মধ্যেই। তখন দেখা যেত প্লটগুলোতে মাটির উপরে সাদা হয়ে নুন-মাটি জমে রয়েছে। সেই মাটি কোদাল দিয়ে হালকা করে চেঁছে সংগ্রহ করা হত।
বাড়িতে আগেই প্রস্তুত থাকত তলায় একটা ছিদ্রযুক্ত মাটির হাঁড়ি। সেই হাঁড়ির ভেতরে কিছু খেজুর পাতা রেখে দেওয়া হত। তারপর সংগৃহীত নুন-মাটির সাথে নোনাজল মিশিয়ে ওই হাঁড়িতে ঢালা হত। খেজুর পাতা ফিল্টারের কাজ করত। নুন-মাটি গোলা জল ফিল্টার হয়ে ছিদ্র দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়লে নীচে একটি বড় হাঁড়ি বা কড়াইতে তা সংগ্রহ করে রাখা হত। এবার ওই হাঁড়ি বা কড়াই ভরা জল উনুনে বসিয়ে ফুটিয়ে নিলে জল বাষ্পীভূত হয়ে উৎপন্ন হত সাদা লবণ। অনেক সময় লবণ দলা পাকিয়ে থাকত। তখন সামান্য আঘাত করে সেই দলাকে ভেঙে গুড়ো করে নেওয়া হত। মাটির হাঁড়িতে সেই নুন রেখে মুখে মাটির সরা চাপা দিয়ে শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা হত। বাড়িতে কাজের লোকের সাহায্য নিয়ে মা-ঠাকুমাকে এ ভাবেই নুন তৈরি করতে দেখেছি।
বাণিজ্যিকভাবে সুন্দরবনের লবণ-ক্ষেত্র বা খালাড়িগুলোতে লবন শ্রমিক বা মলঙ্গিদের দ্বারা লবণ উৎপাদনের পদ্ধতি ছিল প্রায় একইরকম। এক্ষেত্রে এক একটা খালাড়ি হত প্রায় ৪-৬ বিঘা। আর ছিদ্রযুক্ত মাটির হাঁড়ি লাইন দিয়ে পর পর সাজিয়ে রাখা হত। সমস্ত হাঁড়ি থেকে ফিল্টার হওয়া জল ঝরে পড়ত একটা নালায়। সেই নালা দিয়ে আসা জল জমা হত একটা চৌবাচ্চায়। এই লবণ-জল জ্বাল দেওয়া হত বড়ো বড় উনুনে। এই উনুনকে বলা হত ‘বান’। আর যে ঘরে উনুন থাকত তার নাম ‘ভুনরিঘর’। এক একটা উনুনে তিন-চারটে করে মাটির পাত্রে লবন-জল জ্বাল দেওয়া হত। এই পাত্রকে বলা হত ‘জেলো’। লবণের গুণগত মান নির্ভর করত জ্বাল দেওয়ার ওপর। এজন্য দরকার হত দক্ষ মলঙ্গি, যাদের বলা হত ‘পাকি’। অভিজ্ঞ বা পাকা বলেই হয়তো এদের পাকি বলা হত।
বাড়িতে আগেই প্রস্তুত থাকত তলায় একটা ছিদ্রযুক্ত মাটির হাঁড়ি। সেই হাঁড়ির ভেতরে কিছু খেজুর পাতা রেখে দেওয়া হত। তারপর সংগৃহীত নুন-মাটির সাথে নোনাজল মিশিয়ে ওই হাঁড়িতে ঢালা হত। খেজুর পাতা ফিল্টারের কাজ করত। নুন-মাটি গোলা জল ফিল্টার হয়ে ছিদ্র দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়লে নীচে একটি বড় হাঁড়ি বা কড়াইতে তা সংগ্রহ করে রাখা হত। এবার ওই হাঁড়ি বা কড়াই ভরা জল উনুনে বসিয়ে ফুটিয়ে নিলে জল বাষ্পীভূত হয়ে উৎপন্ন হত সাদা লবণ। অনেক সময় লবণ দলা পাকিয়ে থাকত। তখন সামান্য আঘাত করে সেই দলাকে ভেঙে গুড়ো করে নেওয়া হত। মাটির হাঁড়িতে সেই নুন রেখে মুখে মাটির সরা চাপা দিয়ে শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা হত। বাড়িতে কাজের লোকের সাহায্য নিয়ে মা-ঠাকুমাকে এ ভাবেই নুন তৈরি করতে দেখেছি।
বাণিজ্যিকভাবে সুন্দরবনের লবণ-ক্ষেত্র বা খালাড়িগুলোতে লবন শ্রমিক বা মলঙ্গিদের দ্বারা লবণ উৎপাদনের পদ্ধতি ছিল প্রায় একইরকম। এক্ষেত্রে এক একটা খালাড়ি হত প্রায় ৪-৬ বিঘা। আর ছিদ্রযুক্ত মাটির হাঁড়ি লাইন দিয়ে পর পর সাজিয়ে রাখা হত। সমস্ত হাঁড়ি থেকে ফিল্টার হওয়া জল ঝরে পড়ত একটা নালায়। সেই নালা দিয়ে আসা জল জমা হত একটা চৌবাচ্চায়। এই লবণ-জল জ্বাল দেওয়া হত বড়ো বড় উনুনে। এই উনুনকে বলা হত ‘বান’। আর যে ঘরে উনুন থাকত তার নাম ‘ভুনরিঘর’। এক একটা উনুনে তিন-চারটে করে মাটির পাত্রে লবন-জল জ্বাল দেওয়া হত। এই পাত্রকে বলা হত ‘জেলো’। লবণের গুণগত মান নির্ভর করত জ্বাল দেওয়ার ওপর। এজন্য দরকার হত দক্ষ মলঙ্গি, যাদের বলা হত ‘পাকি’। অভিজ্ঞ বা পাকা বলেই হয়তো এদের পাকি বলা হত।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৭: মদ না খেলে ফ্যাটি লিভার হয় না?
সুন্দরবনে কতদিন আগে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে তা আজও সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে খ্রিস্টের জন্মের আগে যে সুন্দরবন অঞ্চলে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল তার ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় দু’হাজার বছর আগে নিম্নবঙ্গে অবস্থিত গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের মধ্যে গঙ্গা নদীর মোহনার কাছে বর্তমান সাগরদ্বীপে ছিল সমৃদ্ধ বন্দর-নগর গঙ্গে। সেই বন্দরের মাধ্যমে যেসব জিনিস ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি হত তার মধ্যে সামুদ্রিক লবণ ছিল অন্যতম।
গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের অন্তর্গত আর এক বন্দর ছিল বর্তমান বাংলাদেশের সাতক্ষীরায়। সেই বন্দর দিয়েও রপ্তানি হত সামুদ্রিক লবণ। সাতক্ষীরা জেলার সমুদ্র উপকূলে খেজুরদানা, আড়পাঙাশিয়া ও শেখরটেকে ২০১৮ সালে প্রায় ১২০০ বছর আগের প্রাচীন জনপদের বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। সেখানে যে বাণিজ্যিকভাবে লবন তৈরি করা হত তার নিদর্শন পেয়েছেন নৃতত্ত্ববিদরা। সাতক্ষীরা জেলার খোলপটুয়া নদীর তীরে এবং খুলনা জেলার কটকাতেও প্রাচীন জনপদের যে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে সেখানেও লবন কারখানার প্রমাণ মিলেছে। কটকায় সবচেয়ে পুরানো লবণ কারখানাটি অন্তত ১২০০ বছর আগেকার।
সুন্দরবনের নোনাজলে লবণের পরিমাণ লিটার প্রতি ৩০০০ মিলিগ্রামের বেশি। তাই প্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের অন্যতম জীবিকা ছিল নোনা জল থেকে লবন উৎপাদন। নোনা জল ফুটিয়ে তৈরি করা হত লবন। জ্বালানীর জোগান দিত অরণ্যের কাঠ। যারা এই নুন তৈরির কাজ করত তাদের বলা হত মলঙ্গী। নুন তৈরির জন্য পোড়া মাটির যে ভাঁড় ব্যবহার করা হত তার নাম মলঙ্গা। আর যে স্থানে নুন তৈরি করা হত সেই ক্ষেত্রকে বলা হত খালারি। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এই শব্দগুলো এখনও চালু আছে। বিষ্ণুপুর-১ নং ব্লকে রয়েছে মলঙ্গা ও উস্থি ব্লকে রয়েছে মলঙ্গী নামে জায়গা। যেহেতু ৪০০-৫০০ বছর আগে সুন্দরবনের বিস্তার কলকাতা পর্যন্ত ছিল তাই দক্ষিণ ২৪ পরগনার নানা অঞ্চলে নিশ্চিতভাবেই মলঙ্গীরা বসবাস করত।
গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের অন্তর্গত আর এক বন্দর ছিল বর্তমান বাংলাদেশের সাতক্ষীরায়। সেই বন্দর দিয়েও রপ্তানি হত সামুদ্রিক লবণ। সাতক্ষীরা জেলার সমুদ্র উপকূলে খেজুরদানা, আড়পাঙাশিয়া ও শেখরটেকে ২০১৮ সালে প্রায় ১২০০ বছর আগের প্রাচীন জনপদের বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। সেখানে যে বাণিজ্যিকভাবে লবন তৈরি করা হত তার নিদর্শন পেয়েছেন নৃতত্ত্ববিদরা। সাতক্ষীরা জেলার খোলপটুয়া নদীর তীরে এবং খুলনা জেলার কটকাতেও প্রাচীন জনপদের যে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে সেখানেও লবন কারখানার প্রমাণ মিলেছে। কটকায় সবচেয়ে পুরানো লবণ কারখানাটি অন্তত ১২০০ বছর আগেকার।
সুন্দরবনের নোনাজলে লবণের পরিমাণ লিটার প্রতি ৩০০০ মিলিগ্রামের বেশি। তাই প্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের অন্যতম জীবিকা ছিল নোনা জল থেকে লবন উৎপাদন। নোনা জল ফুটিয়ে তৈরি করা হত লবন। জ্বালানীর জোগান দিত অরণ্যের কাঠ। যারা এই নুন তৈরির কাজ করত তাদের বলা হত মলঙ্গী। নুন তৈরির জন্য পোড়া মাটির যে ভাঁড় ব্যবহার করা হত তার নাম মলঙ্গা। আর যে স্থানে নুন তৈরি করা হত সেই ক্ষেত্রকে বলা হত খালারি। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এই শব্দগুলো এখনও চালু আছে। বিষ্ণুপুর-১ নং ব্লকে রয়েছে মলঙ্গা ও উস্থি ব্লকে রয়েছে মলঙ্গী নামে জায়গা। যেহেতু ৪০০-৫০০ বছর আগে সুন্দরবনের বিস্তার কলকাতা পর্যন্ত ছিল তাই দক্ষিণ ২৪ পরগনার নানা অঞ্চলে নিশ্চিতভাবেই মলঙ্গীরা বসবাস করত।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪১: কান্না হাসির দোল দোলানো ‘একটি রাত’
আলোকের ঝর্ণাধারায়, আলোকের ঝর্ণাধারায়
মোগল যুগ থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসকের সময় পর্যন্ত রাজস্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল সামুদ্রিক লবন। তখন লবণ উৎপাদনকে বলা হত ‘লবন চাষ’। লবণ চাষের জন্য মলঙ্গিরা জমিদারের কাছ থেকে দাদন হিসেবে অগ্রিম অর্থ নিত। তারপর লবণ তৈরি হলে সেই লবণ পূর্ব নির্ধারিত দামে তুলে দিত জমিদারের হাতে। ব্যবসায়ীরা জমিদারের কাছ থেকে সেই লবণ কিনে নিয়ে দেশের দূর দূর প্রান্তে বা বিদেশে রপ্তানি করে দিত। যেহেতু লবণের উৎপাদন ও ব্যবসা সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত হত তাই লবনের দাম ছিল অনেক বেশি। সাধারণ গরিব মানুষের কাছে লবণ ছিল দুর্মূল্য। আর মাঝখান থেকে পকেট ভরত জমিদার ও ব্যবসায়ীরা।
পলাশির যুদ্ধের পর ২৪ পরগনার লবণ উৎপাদনের খালাড়িগুলি চলে এল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তখন সুন্দরবন অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। কোথাও জনবসতির চিহ্ন ছিল না। তখন লবণ মূলত উৎপন্ন হত মেদিনীপুরের হিজলি ও তমলুকে। ওখানে অনেক বড় বড় খালাড়ি ছিল। লবনশিল্পে প্রচুর লাভ দেখে ব্যবসায়ীদের নজর পড়ল সুন্দরবনে। তৈরি হল অনেক সল্ট এজেন্সি যার মধ্যে রায়মঙ্গল সল্ট এজেন্সি উল্লেখযোগ্য। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে সুন্দরবন জুড়ে জঙ্গল হাসিল করে গড়ে উঠতে লাগল একের পর এক খালাড়ি।
কিন্তু জনবসতিহীন এলাকায় লবন তৈরি করবে কে? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা নিয়োজিত লবন কন্ট্রাক্টররা (এদের Salt farmer বা লবণ চাষি বলা হত) ইজারাদারদের মাধ্যমে চুক্তির ভিত্তিতে দূর থেকে ঠিকা মলঙ্গিদের নিয়ে এসে লবণ উৎপাদনের কাজ শুরু করল। কিন্তু কোনও মলঙ্গি স্বেচ্ছায় বিপদসঙ্কুল সুন্দরবনে যেতে চায় না। সেখানে থাকার ঘর নেই, পানীয় জল নেই, জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। ফলে ইজারাদাররা জোরজবরদস্তি মলঙ্গিদের অগ্রিম নিতে বাধ্য করিয়ে সুন্দরবনের খালাড়িতে পাঠিয়ে দিত। কখনও অনিচ্ছুক মলঙ্গিদের ঋণে ফাঁসিয়ে দিয়ে সুন্দরবনে যেতে বাধ্য করা হত। এদিকে অতিরিক্ত লবণ উৎপাদন করলে কোম্পানির কাছ থেকে লবন চাষিরা অতিরিক্ত কমিশন পাওয়ার লোভে মলঙ্গিদের উপর জুলুমবাজি উত্তরোত্তর বেড়ে চলে।
পলাশির যুদ্ধের পর ২৪ পরগনার লবণ উৎপাদনের খালাড়িগুলি চলে এল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তখন সুন্দরবন অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। কোথাও জনবসতির চিহ্ন ছিল না। তখন লবণ মূলত উৎপন্ন হত মেদিনীপুরের হিজলি ও তমলুকে। ওখানে অনেক বড় বড় খালাড়ি ছিল। লবনশিল্পে প্রচুর লাভ দেখে ব্যবসায়ীদের নজর পড়ল সুন্দরবনে। তৈরি হল অনেক সল্ট এজেন্সি যার মধ্যে রায়মঙ্গল সল্ট এজেন্সি উল্লেখযোগ্য। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে সুন্দরবন জুড়ে জঙ্গল হাসিল করে গড়ে উঠতে লাগল একের পর এক খালাড়ি।
কিন্তু জনবসতিহীন এলাকায় লবন তৈরি করবে কে? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা নিয়োজিত লবন কন্ট্রাক্টররা (এদের Salt farmer বা লবণ চাষি বলা হত) ইজারাদারদের মাধ্যমে চুক্তির ভিত্তিতে দূর থেকে ঠিকা মলঙ্গিদের নিয়ে এসে লবণ উৎপাদনের কাজ শুরু করল। কিন্তু কোনও মলঙ্গি স্বেচ্ছায় বিপদসঙ্কুল সুন্দরবনে যেতে চায় না। সেখানে থাকার ঘর নেই, পানীয় জল নেই, জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। ফলে ইজারাদাররা জোরজবরদস্তি মলঙ্গিদের অগ্রিম নিতে বাধ্য করিয়ে সুন্দরবনের খালাড়িতে পাঠিয়ে দিত। কখনও অনিচ্ছুক মলঙ্গিদের ঋণে ফাঁসিয়ে দিয়ে সুন্দরবনে যেতে বাধ্য করা হত। এদিকে অতিরিক্ত লবণ উৎপাদন করলে কোম্পানির কাছ থেকে লবন চাষিরা অতিরিক্ত কমিশন পাওয়ার লোভে মলঙ্গিদের উপর জুলুমবাজি উত্তরোত্তর বেড়ে চলে।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৮: মনে পড়ে পঞ্চমের কণ্ঠে শোলে ছবির সেই বিখ্যাত ‘মেহবুবা মেহবুবা…’ গানটি?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৭: কবিকন্যার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবির সঙ্গে ঘটেনি
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কোম্পানি ছ’টি লবণ এজেন্সি গড়ে তুলেছিল, যথা হিজলি, তমলুক, বাগুন্ডি, বারুইপুর, কলকাতা ও বাখেরগঞ্জ। প্রতিটি এজেন্সির অধীনে থাকত অনেকগুলি লবন চৌকি। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সাগরদ্বীপ, ডায়মন্ডহারবার, ক্যানিং, মাতলা, ভাঙড়, হাড়োয়া, গড়িয়া ইত্যাদি লবন চৌকিগুলি ছিল বারুইপুর এজেন্সির অধীনে। প্রতিটি লবন চৌকিতে থাকত একজন দারোগা, দু’জন পাইক, একজন পিওন এবং তাদের যাতায়াতের জন্য নৌকাসহ মাঝি ও দাঁড়ি। দারোগার কাজ ছিল প্রতিটি লবণ চৌকিতে বেআইনি লবণ অর্থাৎ কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে লবণ তৈরি হচ্ছে কিনা তা নজরদারি করা। শুধু তাই নয়, কোনও মলঙ্গি ব্যক্তিগতভাবে লবণ তৈরি করছে কিনা তা-ও লক্ষ্য রাখা হত। কোম্পানির আইন ছিল, কোনও প্রজা নিজের ব্যবহারের জন্যও লবণ তৈরি করতে পারবে না। যদি কোনও প্রজা এই ‘বেআইনি’ কাজ করে তবে তার জমিদারকেও শাস্তি দেওয়া হবে এই মর্মে কোম্পানি তৈরি করল ‘নজয়েস’ আইন।
এতদসত্ত্বেও বেআইনি লবণ উৎপাদন ও কারবার বন্ধ করা গেল না। এদিকে লবণের উপর কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারের প্রশ্নে ব্রিটিশ সরকার সমালোচনা করল। সরকার প্রস্তাব দিল, লবণ চাষ না করে সুন্দরবনে বরং কৃষিকাজ করার দিকে কোম্পানি নজর দিক। ১৮৪০ সালে সুন্দরবন কমিশনার সিদ্ধান্ত নিল যে সমগ্র সুন্দরবনের সমস্ত লবণ খালাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরিবর্তে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হবে। আর লবণ শিল্প বন্ধ করে দেওয়ায় রাজস্বের যে ক্ষতি হবে তা আমদানি করা লবনের উপর অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়ে পূরণ করা হবে।
এভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুন্দরবন তথা বাংলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী লবণ শিল্পকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করল। মানুষ তার নিত্য প্রয়োজনীয় লবণ নোনা জল থেকে তৈরি করতে পারবে না! তাকে চড়া দাম দিয়ে বিদেশে উৎপন্ন লবন কিনতে হবে! বর্ষার সময় নদীর জলের লবনাক্ততা কমে যাওয়ায় ওই সময় লবণ তৈরি করা যেত না। ওই সময় মলঙ্গিরা চাষবাস করত। বাকি সময় করত লবণ চাষ। কিন্তু লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের সম্পূর্ণত কৃষির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হল। সুন্দরবনের নোনা মাটির উৎপাদনশীলতা এমনিতেই কম। ফলে সুন্দরবনের মানুষ অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। পরিত্যক্ত হতে লাগল একের পর এক খালাড়ি। আমাদের পুকুরের তলায় পাওয়া অসংখ্য ভাঙা ‘নুনের কুড়ি’ কি তাহলে জানান দিচ্ছে যে সেখানে এক সময় খালাড়ি ছিল! সেই ইতিহাস জানার উপায় আজ আর নেই।—চলবে।
এতদসত্ত্বেও বেআইনি লবণ উৎপাদন ও কারবার বন্ধ করা গেল না। এদিকে লবণের উপর কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারের প্রশ্নে ব্রিটিশ সরকার সমালোচনা করল। সরকার প্রস্তাব দিল, লবণ চাষ না করে সুন্দরবনে বরং কৃষিকাজ করার দিকে কোম্পানি নজর দিক। ১৮৪০ সালে সুন্দরবন কমিশনার সিদ্ধান্ত নিল যে সমগ্র সুন্দরবনের সমস্ত লবণ খালাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরিবর্তে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হবে। আর লবণ শিল্প বন্ধ করে দেওয়ায় রাজস্বের যে ক্ষতি হবে তা আমদানি করা লবনের উপর অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়ে পূরণ করা হবে।
এভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুন্দরবন তথা বাংলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী লবণ শিল্পকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করল। মানুষ তার নিত্য প্রয়োজনীয় লবণ নোনা জল থেকে তৈরি করতে পারবে না! তাকে চড়া দাম দিয়ে বিদেশে উৎপন্ন লবন কিনতে হবে! বর্ষার সময় নদীর জলের লবনাক্ততা কমে যাওয়ায় ওই সময় লবণ তৈরি করা যেত না। ওই সময় মলঙ্গিরা চাষবাস করত। বাকি সময় করত লবণ চাষ। কিন্তু লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের সম্পূর্ণত কৃষির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হল। সুন্দরবনের নোনা মাটির উৎপাদনশীলতা এমনিতেই কম। ফলে সুন্দরবনের মানুষ অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। পরিত্যক্ত হতে লাগল একের পর এক খালাড়ি। আমাদের পুকুরের তলায় পাওয়া অসংখ্য ভাঙা ‘নুনের কুড়ি’ কি তাহলে জানান দিচ্ছে যে সেখানে এক সময় খালাড়ি ছিল! সেই ইতিহাস জানার উপায় আজ আর নেই।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।