বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


হাড়োয়ায় পীর গোরাচাঁদের দরগা।

চন্দ্রকেতুগড় স্থানটির কথা আজ অনেকের কাছে সুপরিচিত। উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপায় রয়েছে রাজা চন্দ্রকেতুর গড় বা দুর্গের ভগ্নাবশেষ। চন্দ্রকেতুর কথা যতটুকু জানা যায় তা লোকমুখে প্রচারিত অলৌকিক নানা কাহিনি। তাই সত্যিই চন্দ্রকেতু নামে কোনও রাজা ছিলেন কিনা বা থাকলে কবে ছিলেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু বেড়াচাঁপায় দুর্গের ভগ্নাবশেষ এবং অসংখ্য পুরাবস্তুর আবিষ্কার ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে খুবই আগ্রহের বিষয়। রাজা চন্দ্রকেতুকে নিয়ে লোকমুখে প্রচারিত নানা কাহিনির মধ্যে অন্যতম কাহিনিটি এইরকম—

বালান্ডার হিন্দু রাজা চন্দ্রকেতুর জামাই বরাহ ও মেয়ে খনা গণনা করে জানতে পারেন যে তাঁদের রাজবংশে এক ঘোর অমঙ্গল আসতে চলেছে। তখন রাজা চন্দ্রকেতু অমঙ্গল দূর করার জন্য সাড়ম্বরে চণ্ডীপুজোর আয়োজন করেন। এই সময় তাঁর রাজ্যে ইসলাম ধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে হাজির হন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক পীর। তাঁর নাম গোরাচাঁদ। মুখে মুখে প্রজাদের মধ্যে পীর গোরাচাঁদের অলৌকিক ক্ষমতার কথা প্রচারিত হয়ে গেল। খবর গেল চন্দ্রকেতুর কাছে।
সব শুনে পীর গোরাচাঁদের সঙ্গে পরিচয় করতে তাঁর ইচ্ছে হল। তাঁর আমন্ত্রণে পীর গোরাচাঁদ চন্দ্রকেতুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। কিন্তু রাজা পীর গোরাচাঁদের অলৌকিক ক্ষমতার কথা বিশ্বাস করলেন না। উভয়ের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হল। রাজা চন্দ্রকেতু পীর গোরাচাঁদকে চ্যালেঞ্জ করলেন যে তাঁর কাছে থাকা লোহার কলাকে পাকা কলাতে পরিণত করে দিতে হবে। গোরাচাঁদ তা-ই করে দিলেন। কিন্তু তাতেও রাজা চন্দ্রকেতু বিশ্বাস করলেন না। বললেন, রাজপ্রাসাদের চতুর্দিকে লোহার বেড়ায় চাঁপা ফুল ফোটাতে পারলে তবেই তিনি তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা স্বীকার করবেন। পীর গোরাচাঁদ সত্যিই লোহার বেড়ায় চাঁপাফুল ফোটালেন। সেই থেকে ওই স্থানের নাম হয় বেড়াচাঁপা। কিন্তু চন্দ্রকেতু তাতেও পীর গোরাচাঁদের ক্ষমতাকে স্বীকার করলেন না। তিনি তাঁর দরবারের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই বীর হামা ও দামাকে নির্দেশ দিলেন গোরাচাঁদকে বন্দী করতে।

কিন্তু গোরাচাঁদ তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে হামা ও দামার সব শক্তি অপহরণ করে নিলেন। ফলে চন্দ্রকেতুর সাথে গোরাচাঁদের যুদ্ধ হয়ে উঠল অনিবার্য। যুদ্ধে জয়ী হয়ে চন্দ্রকেতু জয়ের সংবাদ জানানোর জন্য রীতি অনুযায়ী সাদা পায়রা না উড়িয়ে ভুল করে পরাজয়ের সংকেত কালো পায়রা উড়িয়ে দেন। সেই পায়রা দেখে রাজপ্রাসাদের অন্তঃপুরবাসিনীরা শোকে কালীদহে ডুবে আত্মহত্যা করেন। এদিকে চন্দ্রকেতু রাজপ্রাসাদে ফিরে যখন দেখেন কেউ বেঁচে নেই তখন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তিনি ফের যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যান পীর গোরাচাঁদকে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে পীর অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তখন শোকাকুল রাজা চন্দ্রকেতুও কালীদহে ডুবে আত্মহত্যা করেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৮: সুন্দরবনের তিন গাজী—রক্তান গাজী, তাতাল গাজী ও শতর্ষা গাজী

অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৪: বরাকপারের কথা

কে এই পীর গোরাচাঁদ? আনুমানিক ১২৬৫ সালে আরবের মক্কায় তাঁর জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ আব্বাস আলী রাজী। তাঁর বাবার নাম হজরত করিমউল্লাহ ও মায়ের নাম মায়মুনা সিদ্দিকা। তরীকা সুফি মতে দীক্ষা নিয়ে তিনি চতুর্দশ শতকের শুরুতে ভারতে ইসলাম ধর্মের প্রচারে আসেন। তাঁর দীক্ষা গুরুর নির্দেশে পীর গোরাচাঁদ বারাসাতের রায়কোলা গ্রামে আরও একুশজন পীরভাইয়ের সাথে কিছুদিন অবস্থান করে ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেন। তারপর গোরাচাঁদ-সহ মোট বাইশজন পীর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েন। তাই ওই স্থান এখনও বাইশ আউলিয়ার থান নামে পরিচিত। এরপর তিনি আসেন হাতিয়াগড় পরগনায়। তখন হাতিয়াগড়ের রাজা ছিলেন মহিদানন্দ নামে নিম্নবর্ণের একজন হিন্দু শাসক। তাঁর দুই পুত্র অকানন্দ ও বকানন্দ পীর গোরাচাঁদকে ধর্মপ্রচারে বাধা দেন। ফলে অকানন্দ ও বকানন্দের সাথে পীর গোরাচাঁদের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

পীর গোরাচাঁদের সমাধি।

যুদ্ধে পীর গোরাচাঁদ ভয়ানক আহত হন। আহত পীর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোনওমতে পালিয়ে এলেন ভার্গবপুর জঙ্গলে। এই অবস্থায় পীর গোরাচাঁদকে সেবা-শুশ্রুষা করেন স্থানীয় দুই গোয়ালা কানু ঘোষ ও কিনু ঘোষ। কিন্তু পীর আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। প্রায় আশি বছর বয়সে ফাল্গুন মাসে তাঁর মৃত্যু হয়। কানু ও কিনু ঘোষ ভার্গবপুরে পীরকে কবরস্থ করেন। ওই স্থানে মাটির নিচে পীরের হাড় আছে বলে পরবর্তীকালে ভার্গবপুরের নাম হয় হাড়োয়া। সুন্দরবন অঞ্চলের অন্যতম একটি স্থান হল এই হাড়োয়া। এখানে পীর গোরাচাঁদের দরগায় ফাল্গুন মাসে তাঁর মৃত্যুর দিন স্মরণ করে প্রতি বছর উৎসব হয় ও মেলা বসে। এখনও ওই দুই গোয়ালার বংশধররা প্রতি বছর উৎসবের শুরুতে সর্বপ্রথম বিপুল পরিমাণ দুধ ঢেলে দরগা ধুয়ে দেন।
আরও পড়ুন:

সেদিন ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন আনন্দ দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সিনেমাপ্রেমী থেকে বরেণ্য সেই পরিচালককে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৭: হারায়ে খুঁজি চন্দ্রনাথ

অবশ্য কারও কারও ধারণা পীর গোরাচাঁদ ভারতে এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাই তাঁর নাম গোরাচাঁদ। কোনও মুসলমানের নাম গোরাচাঁদ হতে পারে না। আর তাঁর নামের সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের অপর নাম গোরাচাঁদের মিল থাকলেও যেহেতু শ্রীচৈতন্য তাঁর সময়ের অনেক পরে জন্মেছিলেন তাই তাঁর নামকরণে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব থাকার কথা নয়। প্রচলিত এক কাহিনি হল, পীরসাহেব দেখতে ছিলেন অতি সুন্দর। রাজা চন্দ্রকেতুর স্ত্রী রানি কমলা তাঁর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে ‘গোরাচাঁদ’ নামে সম্বোধন করেন। সেই থেকে নাকি তাঁর আসল নাম পরিবর্তিত হয়ে গোরাচাঁদ হয়ে যায়।

হাড়োয়ায় পীর গোরাচাঁদের দরগার নামফলক।

বিদ্যাধরী নদীর তীরে হাড়োয়ায় পীর গোরাচাঁদের দরগা খুবই বিখ্যাত ও দর্শনীয় স্থান। তবে উত্তর ২৪ পরগনা ও বাংলাদেশের অনেক জায়গায় পীর গোরাচাঁদের নজরগাহ বা স্মৃতিসৌধ আছে। যেমন অশোকনগরের কাছে রয়েছে শেরপুরের দরগা। বারাসাতের চন্দনহাটি গ্রামে রয়েছে আর একটি দরগা। বারাসাতের কামদেবপুরে যে দরগাটি রয়েছে সেখানে সেবায়েত হলেন এক হিন্দু পরিবার। রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে অনেক মানুষ এখানে পীরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত ওষুধ নিতে আসেন। এখানেও ফাল্গুন মাসে উৎসব হয়। হাসনাবাদের খুড়র গ্রামে এবং বসিরহাটের ঘোড়ারাশ ও নেহালপুর গ্রামে রয়েছে পীর গোরাচাঁদের আস্তানা।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩: কৈলাসবাসিনী দেবী, অন্তঃপুরের বিপ্লব এবং মহিলা প্রাবন্ধিক

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৭: পুরীতে বাড়ি— রবীন্দ্রনাথের, গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের

বসিরহাটের বামনপুকুর গ্রামের আস্তানাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর চৈত্র মাসে মেলা বসে। দেগঙ্গার গাঙ্গুলিয়া, নারায়ণপুর, হাসিয়া, গাংধুলোট, সাতহাতিয়া, গোঁসাইপুর, এয়াজপুর প্রভৃতি স্থানে পীর গোরাচাঁদের দরগা রয়েছে। কয়েকটি দরগায় সেবায়েতদের উপর পীর গোরাচাঁদের ‘ভর’ হয়। এই অবস্থায় সেবায়েতরা পীরের ‘নির্দেশমত’ ওষুধ পান এবং ভক্তদের রোগ সারাতে তা বিতরণ করেন। সাধারণত প্রতি শুক্রবার এই ‘ভর’ হয়। তবে কোথাও কোথাও শনি ও মঙ্গলবারেও হয়। পীর গোরাচাঁদের দরগায় পীরের ওষুধ পেতে হিন্দু-মুসলিম নির্বেশেষে প্রচুর মানুষ আসেন।

পীর গোরাচাঁদের সঙ্গে অকানন্দের যুদ্ধের কল্পচিত্র।

পীর গোরাচাঁদের মূর্তি অতি বিরল। তবে যেখানে যেখানে তাঁর মূর্তি দেখা যায় তা রীতিমতো যোদ্ধার বেশে। তাঁর পোশাক চোগা-চাপকান, আর মাথায় পাগড়ি। তাঁর ডান হাতে খোলা তলোয়ার। বাহন ঘোড়া। কয়েক জায়গায় হিন্দু সেবায়েত থাকলেও মূলতঃ মুসলমান ফকিররাই পূজা-হাজোতের দায়িত্বে থাকেন। বাতাসা ও মিষ্টি নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। সঙ্গে কেউ কেউ গোলাপজলও দেন।

পীর গোরাচাঁদ এ দেশে আসার আগে বঙ্গদেশে বৌদ্ধ তান্ত্রিক ও শৈব তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্যদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তাঁদের অলৌকিক শক্তি সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করত। তাই পীর গোরাচাঁদের অলৌকিক শক্তি সাধারণ মানুষের মনে বিরাট প্রভাব ফেলে। ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ পীর গোরাচাঁদের ভক্ত হয়ে ওঠে। আর এভাবেই ঐতিহাসিক চরিত্র পীর গোরাচাঁদ হয়ে ওঠেন সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা।—চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content