গোবিন্দরামপুরে বিশালাক্ষী মন্দিরে শীতলা ও মনসা দেবীসহ বিশালাক্ষী। ছবি: লেখক।
জন্মাবধি ‘বিশালাক্ষী’ শব্দটি আমার কাছে অতি পরিচিত। কারণ দুটো—প্রথমত, আমার বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে যে গ্রাম তার নাম বিশালাক্ষীপুর। দ্বিতীয়ত, আমার গ্রাম গোবিন্দরামপুরের উত্তর প্রান্তে রয়েছে প্রাচীন এক বিশালাক্ষী মন্দির। ওই মন্দিরে এখনও প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় ধূমধাম সহকারে পুজো হয়। পুজো উপলক্ষ্যে তিন দিন ধরে মেলা ও যাত্রাপালা হয়। যদিও পুরোনো মন্দিরের স্থানে নতুন মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা আগের থেকে কিছুটা কমেছে কিন্তু আজও ট্র্যাডিশন বজায় আছে।
তাছাড়া কাকদ্বীপ শহরেই রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রাচীনতম বিশালাক্ষী মন্দির যা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে কাকদ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ। প্রকৃতপক্ষে ছোটবড় বিশালাক্ষী মন্দির রয়েছে আমার আশেপাশের প্রায় সব গ্রামেই।
তাই হয়তো বিশালাক্ষী নামে অসংখ্য দোকান দেখা যায় কাকদ্বীপ শহর এবং আশেপাশের গ্রাম ও গঞ্জ এলাকায়। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জেলায় পুজো হলেও দুই ২৪ পরগনা জেলায় বিশালাক্ষী দেবীর পুজো হয় সবচেয়ে বেশি। তাই হয়তো বিশালাক্ষী নামে বহু গ্রাম রয়েছে দুই ২৪ পরগনা জেলায়। তবে এই দেবী অনেক জায়গায় ‘বাসলী’, ‘বাশুলী’ বা ‘বাঁশুলী’ নামেও পূজিতা হন। তাই মেদিনীপুরে ‘বাশুলী চক’ বা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ‘বাসুলডাঙা’ নামে গ্রাম দেখা যায়।
তাছাড়া কাকদ্বীপ শহরেই রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রাচীনতম বিশালাক্ষী মন্দির যা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে কাকদ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ। প্রকৃতপক্ষে ছোটবড় বিশালাক্ষী মন্দির রয়েছে আমার আশেপাশের প্রায় সব গ্রামেই।
তাই হয়তো বিশালাক্ষী নামে অসংখ্য দোকান দেখা যায় কাকদ্বীপ শহর এবং আশেপাশের গ্রাম ও গঞ্জ এলাকায়। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ জেলায় পুজো হলেও দুই ২৪ পরগনা জেলায় বিশালাক্ষী দেবীর পুজো হয় সবচেয়ে বেশি। তাই হয়তো বিশালাক্ষী নামে বহু গ্রাম রয়েছে দুই ২৪ পরগনা জেলায়। তবে এই দেবী অনেক জায়গায় ‘বাসলী’, ‘বাশুলী’ বা ‘বাঁশুলী’ নামেও পূজিতা হন। তাই মেদিনীপুরে ‘বাশুলী চক’ বা দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ‘বাসুলডাঙা’ নামে গ্রাম দেখা যায়।
বিশালাক্ষী দেবীর মূর্তির মুখশ্রী অতি সুন্দর দেবী লক্ষ্মী বা সরস্বতীর মতো। এলোকেশী বা মুকুট পরিহিতা। গায়ের রং হলুদ। দেবী ত্রিনয়নী, উন্নত নাসাবিশিষ্ট এবং দ্বিভূজা। এক হাতে খড়্গ ও অন্য হাতে কৃপাণ। যদি অস্ত্র না থাকে তবে হাত থাকে বরাভয় মুদ্রায়। কোথাও কোথাও অবশ্য চতুর্ভূজা মূর্তিও দেখা যায়। তাঁর পদতলে থাকেন শিব বা মহাকাল। আমার দেখা সমস্ত বিশালাক্ষী মন্দিরে তাঁর সাথেই পূজিতা হন দেবী শীতলা ও মনসা। কোনও কোনও জায়গায় আবার পূর্ণ মূর্তির পরিবর্তে মূণ্ড প্রতীকে পূজা হয়। বিশালাক্ষীর পূজা পদ্ধতিতেও নানা স্থানে নানা বৈচিত্র্য দেখা যায়। অধিকাংশ স্থানে বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ্য মতে পুজো হলেও কোথাও কোথাও পুরো তান্ত্রিক মতে বা কোথাও কোথাও তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্য মতের মিশ্র নিয়মে পুজো হয়। অবর্ণ হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে সাধারণতঃ নিম্নশ্রেণির দেয়াসী ব্রাহ্মণ বা অব্রাহ্মণ পুরোহিত পুজো করেন।
অধিকাংশ মন্দিরে ছাগ বলি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। আমিষ ও নিরামিষ দু’প্রকার নৈবেদ্য দেওয়ার প্রথাও রয়েছে। সাধারণত প্রতি সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার পুজো হলেও বার্ষিক আড়ম্বরপূর্ণ পুজো হয় মাঘী পূর্ণিমায় বা বৈশাখ মাসে। যেখানে হিন্দুপ্রধান বসতি সেখানে সাধারণতঃ পাকা মন্দির রয়েছে। যদিও প্রাচীন সুন্দরবন অঞ্চলে বিশালাক্ষীর অধিকাংশ মন্দিরই ছিল মাটি-নির্মিত চালাঘর। সময়ের সঙ্গে তা পাকা মন্দিরে উন্নীত হয়েছে।
অধিকাংশ মন্দিরে ছাগ বলি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। আমিষ ও নিরামিষ দু’প্রকার নৈবেদ্য দেওয়ার প্রথাও রয়েছে। সাধারণত প্রতি সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার পুজো হলেও বার্ষিক আড়ম্বরপূর্ণ পুজো হয় মাঘী পূর্ণিমায় বা বৈশাখ মাসে। যেখানে হিন্দুপ্রধান বসতি সেখানে সাধারণতঃ পাকা মন্দির রয়েছে। যদিও প্রাচীন সুন্দরবন অঞ্চলে বিশালাক্ষীর অধিকাংশ মন্দিরই ছিল মাটি-নির্মিত চালাঘর। সময়ের সঙ্গে তা পাকা মন্দিরে উন্নীত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২০: তোমরা যা বলো, তাই বলো…
বিশালাক্ষী দেবীর অবয়ব ও পূজা পদ্ধতি দেখে আমাদের মনে করা স্বাভাবিক যে তিনি একজন পৌরাণিক দেবী। এ বিষয়ে কিন্তু লোক-গবেষকদের নানা মত রয়েছে। তবে সব বিশেষজ্ঞ একটা বিষয়ে একমত যে তিনি আদতে হিন্দুকূলের দেবী নন। যদি তা-ই হত, তবে ভারতের সমস্ত প্রদেশের হিন্দুদের কাছে তিনি উপাস্য দেবী হতেন এবং তাঁর মূর্তির গঠন ও পূজা-পদ্ধতি সম্বন্ধে শাস্ত্রীয় উল্লেখ পাওয়া যেত। তাছাড়া শাস্ত্রীয় দেবী হলে তিনি অনেকের গৃহদেবী হিসেবেও মর্যাদা পেতেন। কিন্তু এগুলির কোনও বৈশিষ্ট্যই বিশালাক্ষীর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। বরং লৌকিক দেবদেবীর সমস্ত বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, বিশালাক্ষী হলেন একজন অনার্য দেবী। ‘The Cult of Village Gods of West Bengal’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “The Goddess Vasuli, obviousy a non-Aryan name is sometimes called Visalakshi.” সত্যিই বাশুলী, বাসলী বা বিশালাক্ষী নামের অর্থ স্পষ্ট নয়। লক্ষ্যণীয়, বিশাল অক্ষি অর্থে যদি বিশালাক্ষী নাম হত, তবে নামের শেষে দীর্ঘ ই-কার থাকার কথা নয়। আর তাঁর মূর্তিতে বিশাল অক্ষিও নেই। সুতরাং নামের বিচারে তিনি অশাস্ত্রীয় দেবী।
(বাঁ দিকে) কাকদ্বীপে নবনির্মিত বিশালাক্ষী মন্দির। গোবিন্দরামপুর গ্রামে নবনির্মিত বিশালাক্ষী মন্দির (ডান দিকে)। ছবি: লেখক।
বিজয়চন্দ্র মজুমদারও লিখেছেন, “বিশালাক্ষী দ্রাবিড়দেশাগত, আর্য-পূর্ব যুগে এদেশে অস্ট্রিক দ্রাবিড়দের প্রাধান্য ছিল। তাঁরা মাতৃপূজক ছিলেন, জানা যায় সে সময় তন্ত্রসাধনা প্রবল ছিল। অনুমান করা যায় বিশালাক্ষী (তখন বাসলী ছিলেন) অনার্যদের তান্ত্রিক দেবী আদিতেই ছিলেন।” ওড়িশায় বাসুলী নামে এক অনার্য দেবীর পুজো হয়। পুরীতে ঘোড়ামুখ বাসুলী পূজিতা হন। জগন্নাথ মন্দিরের পাশেই রয়েছে বাসুলী দেবীর মন্দির। আবার পুরীর কাছে বাসুলীসাহী পাড়ায় রয়েছে মানুষের মুখবিশিষ্ট বাসুলীদেবী। কোথাও কোথাও মুন্ড প্রতীক বা শিলাখণ্ড হিসেবেও পূজিতা হন। কর্ণাটকেও অনার্য দেবী ‘বিসলমারী’-র সঙ্গে বিশালাক্ষী দেবীর অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়। আর তাই লোকবিশেষজ্ঞদের অনুমান, বিশালাক্ষী আদিতে দ্রাবিড়দের দেবী ছিলেন। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর মতে, “কোন এক কালে, কারণ বিশেষে বহুজন পূজ্য হওয়ায়, পরবর্তীকালে আর্য হিন্দুযুগে শাস্ত্রীয় দেবকুলের দেবীর সম-মর্যাদা লাভ করেছেন ও স্বমহিমায় ব্রাহ্মণশাসিত সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।”
অন্য এক মতে বিশালাক্ষী হলেন আদতে এক তান্ত্রিক দেবী। কারণ তান্ত্রিক মতে পূজার সময় মদ, মাংস, পোড়া মাছ ইত্যাদি নৈবেদ্য দেওয়ার রীতি কোথাও কোথাও বিশালাক্ষী পূজার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। মধ্যযুগে লিখিত মঙ্গলকাব্য ‘বাসুলীমঙ্গল’-এ বিশালাক্ষীকে তান্ত্রিক দেবী রঙ্কিণী বাশুলী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
“গলে নর শির মালা,
শিরে শোভে শশীকলা,
প্রেতাসনে রঙ্কিণী বাশুলী।”
অন্য এক মতে বিশালাক্ষী হলেন আদতে এক তান্ত্রিক দেবী। কারণ তান্ত্রিক মতে পূজার সময় মদ, মাংস, পোড়া মাছ ইত্যাদি নৈবেদ্য দেওয়ার রীতি কোথাও কোথাও বিশালাক্ষী পূজার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। মধ্যযুগে লিখিত মঙ্গলকাব্য ‘বাসুলীমঙ্গল’-এ বিশালাক্ষীকে তান্ত্রিক দেবী রঙ্কিণী বাশুলী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
শিরে শোভে শশীকলা,
প্রেতাসনে রঙ্কিণী বাশুলী।”
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-১১: ঘরের কাছে জলমহল—চাঁদনি জলটুঙ্গি
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর মহাতান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের লেখা ‘বৃহৎতন্ত্রসার’ গ্রন্থে বিশালাক্ষীর ধ্যানমন্ত্রের সন্নিবেশ বিশালাক্ষীর তান্ত্রিকযোগের সম্ভাবনাকে পোক্ত করে। সম্ভবত, ওই সময় বিশালাক্ষী পূর্ণ তান্ত্রিকমতেই পূজিতা হতেন। পরবর্তীকালে আর্য-অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণের সময় বাশুলী দেবী বিশালাক্ষী নাম নিয়ে হিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
বিশালাক্ষী দেবী যে অনার্য সমাজ থেকে সোজাসুজি হিন্দু সমাজে আসেননি তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে নেপাল থেকে সংগৃহীত কয়েকটি চর্যাপদ থেকে। অধ্যাপক-গবেষক ড. শশীভূষণ দাশগুপ্ত এই চর্যাপদগুলি আবিষ্কার করেন। এই চর্যাপদ হল সহজযানী বৌদ্ধদের সাহিত্য। মহাযানী বৌদ্ধরা বুদ্ধদেবের সঙ্গে অন্যান্য দেবদেবীরও আরাধনা করতেন। বঙ্গদেশে একাদশ-দ্বাদশ শতকে তান্ত্রিকবাদের প্রভাবে মহাযানী বৌদ্ধদের চারটি শাখা তৈরি হয়, যথা মন্ত্রযান, কালচক্রযান, বজ্রযান ও সহজযান।
এই সহজযানী বৌদ্ধদের সাহিত্য হল চর্যাপদ। আবিষ্কৃত চর্যাপদে ‘বাচ্ছলী’ নামে এক দেবীর উল্লেখ রয়েছে যা থেকে বিশেষজ্ঞদের ধারণা বাচ্ছলী আর বাশুলী অভিন্ন। অর্থাৎ তান্ত্রিকদেবী বিশালাক্ষী পরিণত হলেন সহজযানী বৌদ্ধদের উপাস্য দেবীতে। পাল রাজাদের আমলে সুন্দরবন অঞ্চল ছিল বৌদ্ধ প্রভাবিত। উত্তর ২৪ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়, দক্ষিণ ২৪ পরনার মথুরাপুর, ভাঙ্গড়, পাথরপ্রতিমা, বাইশহাটা, কঙ্কণদীঘি, জয়নগর, ভরতগড় প্রভৃতি জায়গা থেকে প্রাপ্ত বৌদ্ধ মূর্তি বা স্তূপ তার প্রমাণ দেয়। ফলে সুন্দরবন অঞ্চলে তখন বিশালাক্ষী দেবীরও প্রবল প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। বৌদ্ধ পরব ধর্মচক্র প্রবর্তন ও সূত্রপাঠ হয় মাঘী পূর্ণিমায়। আর বার্ষিক বিশালাক্ষী পূজাও হয় ওই তিথিতে। এগুলো বিশালাক্ষীর বৌদ্ধযোগের প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
বিশালাক্ষী দেবী যে অনার্য সমাজ থেকে সোজাসুজি হিন্দু সমাজে আসেননি তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে নেপাল থেকে সংগৃহীত কয়েকটি চর্যাপদ থেকে। অধ্যাপক-গবেষক ড. শশীভূষণ দাশগুপ্ত এই চর্যাপদগুলি আবিষ্কার করেন। এই চর্যাপদ হল সহজযানী বৌদ্ধদের সাহিত্য। মহাযানী বৌদ্ধরা বুদ্ধদেবের সঙ্গে অন্যান্য দেবদেবীরও আরাধনা করতেন। বঙ্গদেশে একাদশ-দ্বাদশ শতকে তান্ত্রিকবাদের প্রভাবে মহাযানী বৌদ্ধদের চারটি শাখা তৈরি হয়, যথা মন্ত্রযান, কালচক্রযান, বজ্রযান ও সহজযান।
এই সহজযানী বৌদ্ধদের সাহিত্য হল চর্যাপদ। আবিষ্কৃত চর্যাপদে ‘বাচ্ছলী’ নামে এক দেবীর উল্লেখ রয়েছে যা থেকে বিশেষজ্ঞদের ধারণা বাচ্ছলী আর বাশুলী অভিন্ন। অর্থাৎ তান্ত্রিকদেবী বিশালাক্ষী পরিণত হলেন সহজযানী বৌদ্ধদের উপাস্য দেবীতে। পাল রাজাদের আমলে সুন্দরবন অঞ্চল ছিল বৌদ্ধ প্রভাবিত। উত্তর ২৪ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়, দক্ষিণ ২৪ পরনার মথুরাপুর, ভাঙ্গড়, পাথরপ্রতিমা, বাইশহাটা, কঙ্কণদীঘি, জয়নগর, ভরতগড় প্রভৃতি জায়গা থেকে প্রাপ্ত বৌদ্ধ মূর্তি বা স্তূপ তার প্রমাণ দেয়। ফলে সুন্দরবন অঞ্চলে তখন বিশালাক্ষী দেবীরও প্রবল প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। বৌদ্ধ পরব ধর্মচক্র প্রবর্তন ও সূত্রপাঠ হয় মাঘী পূর্ণিমায়। আর বার্ষিক বিশালাক্ষী পূজাও হয় ওই তিথিতে। এগুলো বিশালাক্ষীর বৌদ্ধযোগের প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ শতকে বাংলায় সেন রাজাদের রাজত্বকালে সহজযানী বৌদ্ধরা বিপন্ন হয়ে পড়ে, কারণ সেন রাজারা ছিলেন হিন্দু এবং স্বভাবতই বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। ফলে ওই সময় সহজযানী বৌদ্ধরা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। সৃষ্টি হয় সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্ম। কিছু লোকগবেষকের মতে, এর সাথে বিশালাক্ষী দেবীও সহজযানী বৌদ্ধ সমাজ থেকে চলে আসেন সহজযানী বৈষ্ণব সমাজে। বৈষ্ণব পদকর্তা বড়ু চন্ডীদাসের লেখা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর অনেক জায়গায় ‘বাসলী’ দেবীর নামোল্লেখ আছে। অবশ্য বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ বিশালাক্ষীর বৈষ্ণবযোগ স্বীকার করেন না, কারণ ‘বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থে বাসলী বা বিশালাক্ষীর নাম কোথাও উল্লেখ নেই।
সপ্তদশ শতকে কবি কৃষ্ণরাম দাসের লেখা রায়মঙ্গল কাব্যে পুষ্পদত্তের বানিজ্যযাত্রা বর্ণনায় বারুইপুরের বিশালাক্ষী দেবীর কথা উল্লেখ রয়েছে—
“সাধুঘাটা পাছে করি, সূর্য্যপুর বাহে তরী
চাপাইল বারুইপুর আসি।
বিশেষ মহিমা বুঝি, বিশালক্ষী দেবী পূজি
বাহে তরী সাদু গুণরাশি।”
সপ্তদশ শতকে কবি কৃষ্ণরাম দাসের লেখা রায়মঙ্গল কাব্যে পুষ্পদত্তের বানিজ্যযাত্রা বর্ণনায় বারুইপুরের বিশালাক্ষী দেবীর কথা উল্লেখ রয়েছে—
চাপাইল বারুইপুর আসি।
বিশেষ মহিমা বুঝি, বিশালক্ষী দেবী পূজি
বাহে তরী সাদু গুণরাশি।”
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৪: মধুপুর ধাম, বাণেশ্বর মন্দির ও ধলুয়াবাড়ি সিদ্ধ নাথ শিবমন্দির
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১৮: কবি স্নানঘর থেকেও ডাক দিতেন দিনেন্দ্রনাথকে
বারুইপুরে স্টেশনের কাছে কাছারি বাজারে বিশালাক্ষীর যে প্রাচীন মন্দির আছে এখানে সেই কথাই বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘বিশালক্ষী’ বানান সম্ভবত লিপিকরদের ত্রুটিজনিত। দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতি প্রাচীন এই মন্দিরের সঙ্গে কাকদ্বীপ ও করঞ্জলীর প্রাচীন বিশালাক্ষী মন্দিরও বিখ্যাত।
সুন্দরবনের বনজীবী ও জলজীবীদের কাছে বিশালাক্ষী দেবীর প্রভাব অপরিসীম। সুন্দরবনের অরণ্য হাসিল করে মনুষ্যবসতি যত প্রসারিত হয়েছে ততই বিশালাক্ষী দেবীর উপাসনাস্থলের বিস্তার ঘটেছে। তবে সুন্দরবনের মৎস্যজীবী সমাজে বিশালাক্ষী দেবী বেশি পূজিতা হন। দূরবর্তী অঞ্চলের দেবদেবীদের নিজ অঞ্চলে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে মৎস্যজীবীদের। সুন্দরবনে এভাবে অনেক লৌকিক দেবদেবীর আগমন ঘটেছে। বিশালাক্ষীও তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর লেখা ‘বাংলার লৌকিক দেবদেবী’ গ্রন্থে উল্লেখিত পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলে প্রচলিত একটি কাহিনি থেকে এই ধারণা করা মনে হয় অমূলক হবে না। কাহিনিটি এরকম: এক ধীবরের বাড়িতে বালিকাবেশে বিশালাক্ষী দেবী থাকতেন। ফলে ওই ধীবরের আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়। রাজা একথা জানতে পেরে বালিকাটিকে নিজের বাড়িতে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু দেবী প্রস্তরখণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ায় রাজার মনোবাসনা পূর্ণ হয় না। কিন্তু রাজা পরে জানতে পারেন যে ধীবরের বাড়িতে থাকা প্রস্তরখণ্ডটিই সেই বালিকা। তখন রাজা প্রস্তরখণ্ডটি হস্তহত করার চেষ্টা করলে দেবীর নির্দেশে ধীবর সেই প্রস্তরখণ্ড সমুদ্রে ফেলে দেন। পরে এক ব্রাহ্মণ স্বপ্নে সেই প্রস্তরখন্ডের কথা জানতে পেরে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে অধিষ্ঠিত করেন।
সুন্দরবনের দু’চার জায়গায় বিশালাক্ষী ব্যাঘ্রদেবী হিসেবেও পূজিতা হন। কাকদ্বীপে বিশালাক্ষী মন্দিরে বিশালাক্ষী দেবীর প্রতিমার পাশে একটি বাঘের মূর্তি এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। সুন্দরবনের মানুষের বিশ্বাস, এখানের সমস্ত লৌকিক দেবদেবীই কোনও না কোনও মঙ্গলকর উদ্দেশ্য সাধন করেন। অরণ্য অধ্যুষিত প্রাচীন সুন্দরবনে তাই দক্ষিণরায় ও বড় খাঁ গাজীর পাশাপাশি বিশালাক্ষীও ব্যাঘ্রদেবী, জঙ্গল-জননী।—চলবে।
সুন্দরবনের বনজীবী ও জলজীবীদের কাছে বিশালাক্ষী দেবীর প্রভাব অপরিসীম। সুন্দরবনের অরণ্য হাসিল করে মনুষ্যবসতি যত প্রসারিত হয়েছে ততই বিশালাক্ষী দেবীর উপাসনাস্থলের বিস্তার ঘটেছে। তবে সুন্দরবনের মৎস্যজীবী সমাজে বিশালাক্ষী দেবী বেশি পূজিতা হন। দূরবর্তী অঞ্চলের দেবদেবীদের নিজ অঞ্চলে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে মৎস্যজীবীদের। সুন্দরবনে এভাবে অনেক লৌকিক দেবদেবীর আগমন ঘটেছে। বিশালাক্ষীও তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর লেখা ‘বাংলার লৌকিক দেবদেবী’ গ্রন্থে উল্লেখিত পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলে প্রচলিত একটি কাহিনি থেকে এই ধারণা করা মনে হয় অমূলক হবে না। কাহিনিটি এরকম: এক ধীবরের বাড়িতে বালিকাবেশে বিশালাক্ষী দেবী থাকতেন। ফলে ওই ধীবরের আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়। রাজা একথা জানতে পেরে বালিকাটিকে নিজের বাড়িতে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু দেবী প্রস্তরখণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ায় রাজার মনোবাসনা পূর্ণ হয় না। কিন্তু রাজা পরে জানতে পারেন যে ধীবরের বাড়িতে থাকা প্রস্তরখণ্ডটিই সেই বালিকা। তখন রাজা প্রস্তরখণ্ডটি হস্তহত করার চেষ্টা করলে দেবীর নির্দেশে ধীবর সেই প্রস্তরখণ্ড সমুদ্রে ফেলে দেন। পরে এক ব্রাহ্মণ স্বপ্নে সেই প্রস্তরখন্ডের কথা জানতে পেরে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে অধিষ্ঠিত করেন।
সুন্দরবনের দু’চার জায়গায় বিশালাক্ষী ব্যাঘ্রদেবী হিসেবেও পূজিতা হন। কাকদ্বীপে বিশালাক্ষী মন্দিরে বিশালাক্ষী দেবীর প্রতিমার পাশে একটি বাঘের মূর্তি এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। সুন্দরবনের মানুষের বিশ্বাস, এখানের সমস্ত লৌকিক দেবদেবীই কোনও না কোনও মঙ্গলকর উদ্দেশ্য সাধন করেন। অরণ্য অধ্যুষিত প্রাচীন সুন্দরবনে তাই দক্ষিণরায় ও বড় খাঁ গাজীর পাশাপাশি বিশালাক্ষীও ব্যাঘ্রদেবী, জঙ্গল-জননী।—চলবে।
(বাঁ দিকে) কাকদ্বীপের বিশালাক্ষীপুর গ্রামের মন্দিরে বিশালাক্ষী দেবী। কাকদীপে বিশালাক্ষী মন্দিরে বাঘ ও ছলনসহ দেবী বিশালাক্ষী (ডান দিকে)। ছবি: লেখক।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।