বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ, ২০২৫


শিলচর শহরের একটি পুজো মণ্ডপ।

দুর্গাপুজো বাঙালি হিন্দুদের জাতীয় উৎসব হলেও অসমে বহু কালকাল ধরে দুর্গাপুজো বেশ ঘটা করেই হয়। কালিকাপুরাণে কামরূপ বা অসমকে দেবী পুজোর কেন্দ্র স্থল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। “অন্যত্র বিরলা দেবী কামরূপে গৃহে গৃহে”। অসমীয়া সাহিত্যের বৈষ্ণব যুগের কবি রাম সরস্বতী মহিষাসুর বধের গল্পটি রচনা করেছেন। দেবী তীর্থ কামাখ্যার মন্দির রয়েছে গুয়াহাটিতে। সুতরাং দেবীর পুজো-আরাধনা এখানে প্রাচীনকাল থেকেই চলছে।
অসমীয়া লোক-সাহিত্যে দেবী দুর্গার প্রসঙ্গ এসেছে বহু বার। কামাখ্যা মন্দির ছাড়াও অসমে বিভিন্ন সময় দেবী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পূজিতও হয়েছে। কোঁচ রাজত্বকাল থেকেই অসমে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। তবে সেই সময় রাজ পরিবারের মধ্যেই সেই পুজো সীমিত ছিল বলে জানা যায়। শোনা যায়, কোঁচ রাজা ধর্ম নারায়ণ দেবী মনসা এবং দেবী দুর্গার পুজোর প্রচার করেছিলেন। দরঙের রাজা মোদ নারায়ণ রচিত দশভুজা দুর্গার স্তুতিগান রচনা করেন। কথিত আছে, আহোম রাজা শিবসিংহের স্ত্রী রানি ফুলেশ্বরী বৈষ্ণবধর্মী মহন্তদেরকে দুর্গাপুজোর লাল চন্দন এবং বলির রক্ত দিয়ে টিকা দিয়েছিলেন। মোহন্তরা এতে অপমানিত বোধ করেন এবং তা যুদ্ধে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৪৫: স্বাধীনোত্তর শহর শিলচর

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?

রাজা স্বর্গদেও মহাসমারোহে সঙ্গে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। আহোম রাজা স্বর্গদেও গদাধর সিং রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় জনসাধারণের প্রবেশ অধিকার দিয়েছিলেন। ১৮৮৯ সালে আহোম যুবরাজ ঘনকান্তা সিংহ সর্ব প্রথম গুয়াহাটির উজান বাজার রাজবাড়িতে পারিবারিক স্তরে দুর্গাপুজো শুরু করেন। এক সময় ঘটা করে দুর্গাপুজো করলেও পরবর্তীকালে পুজোর খরচা বহন করা রাজপরিবারের পক্ষে বেশ শক্ত হয়ে পড়েছিল। তাই এই পুজো জনসাধারণের হাতেই তুলে দেওয়া হয়। উজান বাজার বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে প্রতি বছর দুর্গাপুজো হয়ে থাকে। পুরনো দুর্গাপুজো গুলোর মধ্যে লক্ষ্মীপ্রসাদ বড়ুয়া বাড়ির পুজো অনেক পুরনো। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে দুর্গাপুজোর সংখ্যা একটা দুটো করে বাড়তে লাগল। ১৮৯৭ সালে ডিব্রুগড়ে তিনকুনিয়া পাড়া সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটি গঠিত হয় এবং পুজো শুরু হয়।
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৯: আকাশ এখনও মেঘলা

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৪: বৈষম্যের চোরাবালি ভাবনার কিনারায়

অসমের তেলের শহর তিনশুকিয়াতেও ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়। তিনশুকিয়াতে গোপাল চন্দ্র এবং রবি চন্দ্র নামের দুই ভাই দুর্গাপুজো শুরু করেন। এই পুজো শুরু হবার পিছনে একটি বেশ মনোরম গল্প রয়েছে। তখন ব্রিটিশ শাসনকাল। তিনশুকিয়াতে রেল লাইন এসেছে, তেল এবং কলার খননকার্য শুরু হয়েছে। রবি চন্দ্র এবং গোপাল চন্দ্র এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। তারা লক্ষ্য করলেন, এই দুর্গাপুজোর সময় পশ্চিমবঙ্গ, উড়িশা এবং অন্যান্য জায়গা থেকে আগত শ্রমিকরা বাড়ি চলে যায়। তা ফিরতে আসতে অনেক দেরি করে ফেলে। এর ফলে কাজের অনেক ক্ষতি হয়। তাই তারা তিনশুকিয়াতে দুর্গাপুজো করা শুরু করলেন। এ পুজোয় সবাই অংশগ্রহণ করতে পারল। শোনা যায়, এই দুই ভাই ধুতি পরে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তিনশুকিয়ার সাধারণ মানুষকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতেন। মিষ্টি, কাপড় ইত্যাদি বিতরণও করতেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৩: সাত-সহেলি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৬: ভারতীয় পারিবারিক জীবনে স্নেহময় জ্যেষ্ঠর ভূমিকায় রামচন্দ্র কতটা আকর্ষণীয়?

স্বাধীনতার আগে শিলং অসমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘদিন পর্যন্ত শিলং অসমের রাজধানী ছিল। সুতরাং শিলংয়ের কথাও উল্লেখ করতেই হয়। এও শোনা যায়, শিলং এ গোরখারাই প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেছিল। খুব সম্ভবত ১৮৬৪ -৬৫ সালে গোর্খা রেজিমেন্ট শিলং এ দুর্গাপুজো শুরু করে। প্রথম দিকে ঘটেই পুজো করা হত। তবে সেই সঙ্গে অস্ত্র পুজোও করা হত। তার পর ১৮৯৬ সাল নাগাত ধীরে ধীরে সর্বজনীন দুর্গাপুজো শুরু হল। এগিয়ে এল সনাতন ধর্মসভা কমিটি। বর্তমানে যা লাবানহারি সভা নামে পরিচিত। চারদিক দিয়ে পাহাড়ে ঘেরা শিলং-এ দেবী মূর্তি জোগাড় করাও যথেষ্ট সহজ ছিল না। পশ্চীমবঙ্গ থেকে কিছুটা রাস্তা ট্রেনে কিছুটা স্টিমারে করে গুয়াহাটি পর্যন্ত মূর্তি নিয়ে আসা হত। কিন্তু পাহাড়ের ঘাটি পেড়িয়ে গুয়াহাটি থেকে শিলং মূর্তি নিয়ে যেতে হত গরুর গাড়ি করে। আর তাতেই প্রায় দু-তিন দিন সময় লেগে যেত। কিন্তু শুধু মূর্তি হলেই তো হবে না, পুজো করার জন্য তো পুরোহিতেরও দরকার। পুরোহিত আসতেন সিলেট থেকে পায়ে হেঁটে পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে। শিলং-এ এখন অনেক পুজো হয় তবে হরি সভার পুজো দেখতে মানুষ এখনও দলে দলে ভিড় করেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯o: মা সারদার কথায় ‘ঈশ্বর হলেন বালকস্বভাব’

১৮৩২ সালে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কাছাড়ের শাসনভার গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে কাছাড়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র স্থল হয়ে ওঠে কাছাড়ের শিলচর শহর। শুরুর দিকে এই উপত্যকার কিছু উপজাতিদের (বিশেষ করে লুসাই, নাগা, কুকি) মধ্যে সংর্ঘষ হত। তাদের উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে ইংরেজ সরকার আধা সামরিক বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনীর অধিকাংশই ছিল গোর্খা। এই গোর্খা রেজিমেন্টই বর্তমানে অসম রাইফেল নামে পরিচিত। এই বাহিনীর সেনারাই প্রথম শিলচর শহরে দুর্গাপুজো শুরু করেছিল। তাদের প্রতিমা বিসর্জন সেই সময়ের শিলচরের এক উল্লেখ যোগ্য বিষয় ছিল। ফাঁকা বন্দুক বাজিয়ে, সামরিক শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার সভা যাত্রা বেড় করা হত। বাঙালি জনবসতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাপুজোর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেল।

গুয়াহাটির পাণ্ডু রেস্ট ক্যামের পুজো।

‘অতীতের শিলচর ঐতিহ্যের শিলচর’ বইটিতে লেখক দেবাশিস দাস লিখেছেন “শিলচরে সম্ভবত স্বর্গীয় দুর্গাশঙ্কর দত্ত মহাশয়ের বাড়িতে সর্ব প্রথম পারিবারিক দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। মূলত ময়মনসিংহের অষ্টগ্রামের বাসিন্দা দুর্গাশঙ্করের পিতা স্বর্গীয় গৌরীশংকর দত্ত মহাশয় দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। দেশ বিভাগের পর অনেক পরিবারের বাড়ির দুর্গাপুজো নিজের মূলবাড়ি থেকে শহরে স্থানান্তরিত করেন। “শিলচরে বারোয়ারি পুজো প্রথমে শুরু হয় জানিগঞ্জ এলাকার ভুঁইয়াদের বাড়িতে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ পুজো তাদের পরিবারের পুজো হয়ে উঠে এবং জানিগঞ্জের ব্যবসায়ীরা পৃথক একটি পুজোর সূচনা করেন।

আজ শিলচর কিংবা গুয়াহাটির পুজোর সংখ্যা যেমন অনেক বেড়েছে, তেমনিই বেড়েছে থিম পুজোর সংখ্যাও। এই দুর্গাপুজো মূলত বাঙালিদের এক বিশেষ অনুভূতি আবেগের জায়গা নিয়ে থাকলেও অসমের সব শ্রেণির মানুষের কাছেই কিন্তু এ এক বিশেষ উৎসব। হরেক ভাষাভাষীর এই রাজ্যে যেমন মহা উৎসবে উৎযাপিত হয় বিহু তেমনি দুর্গাপুজোর সময় শহর এবং গ্রামগুলিও সেজে উঠে আপন রঙে। —চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content