
শহর শিলচর দক্ষিণ অসমের বরাক নদীর তীরে উপস্থিত। শহরের একটু বাইরে গেলেই এদিক-ওদিক থেকে উঁকি দেয় বড়াইল পাহাড়। শহরের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে বরাক নদী। এক সময় এই বরাক নদীর জলে রিভার ডলফিন পাওয়া যেত। বেশ কয়েক বছর আগেও এই নদীর জলে রিভার ডলফিন দেখা গিয়েছে বলে খবরের কাগজে বেড়িয়ে ছিল। আজ শহর শিলচর বড় ব্যস্ত। আসে পাশের শহরতলি, গ্রাম, চা বাগান গুলির ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা এবং যোগাযোগ ব্যবস্তা আরও অনেক কিছু জড়িয়ে রয়েছে এই শিলচরের সঙ্গে। রয়েছে উনিশের অমর গাঁথা। মল, বড় বড় দোকানপাট সময়ের হাত ধরে অন্য শহরের সঙ্গে এই শহরেও এসেছে। অনেক হাসপাল, ছোট-বড় কারখানা, বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ সব মিলিয়ে আজকের এই শিলচর শাহর।
হারানচন্দ্র রাহার কাছাড়ের ইতিহাস কেন্দ্রিক উপন্যাসে শিলচরকে শিলাচল বলা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা শিলাচলকে শিলচরে রূপান্তরিত করেন । ত্রিপুরার বিখ্যাত ঐতিহাসিক কৈলাসচন্দ্র সিংহের বিভিন্ন নিবিন্ধে শিলাচলের উল্লেখ রয়েছে। এই সূত্র ধরে ড. অমলেন্দু ভট্টাচার্য শিলাচলকালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের ‘শিলচরের কড়চা’ নামক গ্রন্থের পরিচিতিতে ব্রিটিশের আগে শিলচরের নাম শিলাচল ছিল বলে মত পোষণ করেছেন।
হারানচন্দ্র রাহার কাছাড়ের ইতিহাস কেন্দ্রিক উপন্যাসে শিলচরকে শিলাচল বলা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা শিলাচলকে শিলচরে রূপান্তরিত করেন । ত্রিপুরার বিখ্যাত ঐতিহাসিক কৈলাসচন্দ্র সিংহের বিভিন্ন নিবিন্ধে শিলাচলের উল্লেখ রয়েছে। এই সূত্র ধরে ড. অমলেন্দু ভট্টাচার্য শিলাচলকালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের ‘শিলচরের কড়চা’ নামক গ্রন্থের পরিচিতিতে ব্রিটিশের আগে শিলচরের নাম শিলাচল ছিল বলে মত পোষণ করেছেন।
শেষ কাছারি রাজা গোবিন্দ চন্দ্র ১৮৩০ সালে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর কোনও উত্তরাধিকার না থাকায় ১৮৩২ সালে উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের হাতে কাছাড়ের শাসন ভার চলে যায়। কিছুদিন শিলচরের পাশে বরাক নদীর তীরে দুধপাতিলে তার পর শিলচর থেকেই শাসনকার্য চলতে থাকে। শুরুর দিকে নাগা, লুসাই, কুকি উপজাতির লোকেরা খুব উপদ্রপ করত। তাদের উপদ্রপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ইংরেজ সরকার আধা সামরিক বাহিনী গঠন করে।
আরও পড়ুন:

অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব-৪৪: কামিনীকুমার চন্দ এক অবিস্মরণীয় নাম

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-২০: সঙ্কল্পজাতক
ইংরেজরা মূলত ব্যবসায়িক দিক থেকেই সব পদক্ষেপ নিত। ১৮৫৫ সালে কাচড়ে চা আবিষ্কারের পরই এই উপত্যকা ইংরেজদের নজরে পরে। চা বাগান কর্তৃপক্ষের সুবিধার্থে গঠন করা হয় ‘সুরমা ভ্যালি লাইট হর্স কোর’। সেই সময় থেকেই শিলচর ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র স্থল হয়ে ওঠে। ১৮৯৩ সালে শিলচরের মিউনিসিপ্যালটি গঠিত হয়। শিলচর ধীরে ধীরে রূপ পরিবর্তন করতে থাকে। চা উৎপাদন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে এই উপিত্যকাটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার চেহারাও উন্নীতি ঘটতে শুরু হয়। ১৮৯৯ সালে শিলচরে রেলচালু হয়। ১৯০১ সালে শিলচর ভ্রমণে গেলেন লর্ড কার্জন। শিলচর গভর্নমেন্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক অভয়াচরণ দাশের পুত্র আশুতোষ দাশ ছিলেন ইলাকশন ট্রাইব্যুনাল এর চেয়ারম্যান। তিনি তাঁর ‘জীবন স্মৃতি’ গ্রন্থে কার্জনের শিলচর আসার ঘটনার বর্ণনা করেছেন। শিলচর থেকে লর্ড কার্জন মণিপুর গিয়েছিলেন। আশুতোষবাবু নিজের বাড়ি থেকে কার্জনের সেই যাত্রা দেখতে পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তাঁর বাড়ি ছিল বর্তমান শিলচরের সেন্ট্রাল রোডের থেকে উকিল পট্টির দিকে যাবার মুখেই কামিনী কুমার চন্দের বাড়ির উল্টো দিকেই।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫০: রোজই দেখি আলাস্কা পর্বতশৃঙ্গের বাঁ দিকের চূড়া থেকে সূর্য উঠতে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৯: উদ্বোধনের ঠাকুরঘরে মা সারদার সঙ্গে স্বামী অরূপানন্দের কথোপকথন
আশুতোষ দাশ লিখেছেন, “১৯০১ সাল হইবে, যখন তদানীন্তন বড়লাট লর্ড কার্জন Lord Curzon শিলচর হইয়া মণিপুরে গেলেন , ওখানে বড়লাটের দরবার বসিল ; সিলেট, কাছাড় দুই জেলার ভূস্বামী ও খেতাবধারী লোকেরা নিমন্ত্রিত হইয়া আসিলেন। Free Manson এর প্রকাণ্ড হলঘরে দরবার বসিল। sir Henry Cotton তখন আসামের প্রাদেশিক শাসনকর্তা (Chief Commissioner)। Lord Curzon যেদিন Surma valley Light Horse এর ভলিউন্টার্স দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া অশ্বারোহণে মণিপুর রওয়ানা হইলেন, আমাদের বাড়ি হইতে তাহা দেখিলাম।’
এখানে যে free manson এর কথা বলা হয়েছে তার পুরো নাম ‘international free manson of brotherhood’ নামের মূলত ইংরেজদের একটি সংস্থা। ইংরেজ সাহেবরা ছাড়া রায়বহাদুর হরিচরণ দাস এবং কামিনী কুমার চন্দ ছিলেন সেই সংস্থার শিলচর শাখার ভারতীয় সদস্য। কথিত আছে কার্জন লক্ষীপুরের পাশে ‘দিলখুশ’ চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে গিয়েছিলেন। ম্যানেজারের স্ত্রী তাঁর নিকট আত্মীয়া ছিলেন। কার্জনের নৈশভোজের জন্য নাকি ইতালিয়ান টাইলস দিয়ে এক আকর্ষণীয় টেবিল নির্মিত হয়েছিল, সেই টেবিল এখনও আছে চা বাগানের বাংলোতে।
এখানে যে free manson এর কথা বলা হয়েছে তার পুরো নাম ‘international free manson of brotherhood’ নামের মূলত ইংরেজদের একটি সংস্থা। ইংরেজ সাহেবরা ছাড়া রায়বহাদুর হরিচরণ দাস এবং কামিনী কুমার চন্দ ছিলেন সেই সংস্থার শিলচর শাখার ভারতীয় সদস্য। কথিত আছে কার্জন লক্ষীপুরের পাশে ‘দিলখুশ’ চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে গিয়েছিলেন। ম্যানেজারের স্ত্রী তাঁর নিকট আত্মীয়া ছিলেন। কার্জনের নৈশভোজের জন্য নাকি ইতালিয়ান টাইলস দিয়ে এক আকর্ষণীয় টেবিল নির্মিত হয়েছিল, সেই টেবিল এখনও আছে চা বাগানের বাংলোতে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯২: দুর্গা টুনটুনি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?
এতো গাড়ির ভিড় তখন শিলচরে নিশ্চয়ই ছিল না। সাধারণ মানুষ খুব একটা ঘোরার গাড়িও ব্যবহার করতেন না। তবে ইংরেজরা ঘোড়া এবং ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতেন।বর্তমান শিলচরের ডিএসএ-এর মাঠ এবং পুলিশ প্যারড গ্রাউন্ড মিলিয়ে ডিসেম্বোর মাসের শেষের কদিন ইংরেজরা সেখানে ঘৌড় দৌড়ের ব্যবস্থা করতেন। সেই ঘৌড় দৌড় এক অনুষ্ঠানে পরিণত হত। শুধু ঘোড়ার পিঠে চড়ে রেস লাগানোই নয় ,আরও অনেক রকমের খেলা হত সেখানে। ঘোড়ার ব্যবহার সমাজে বহু দিন ধরেই চলে আসছে। রেলস্টেশন স্থাপিত হওয়ার পর শিলচরে ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যাও বেড়ে যায়। সেই ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহারের বর্ণনা আমারা দেবব্রত দত্তের ‘পৌরসভার ইতিহাস’ শত বর্ষের স্মারক গ্রন্থে পাই, “ঘনিয়ালা রাস্তাটা করে সান্ধ্য ভ্রমণকারীদের জন্য সুবিধা হবে, যারা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে হওয়া খান তারাও নিশ্চিন্তে ঐ রাস্তায় হওয়া খেতে পারবেন।” শহরের আয়তনও খুব বেশি ছিল না ।ইংরেজ আমলের শুরুর দিকে জানিগঞ্জ এলাকা ছিল মূলত শহরের প্রাণ কেন্দ্র। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই শহরের রাস্তার কাজ শুরু হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৫: বনবাসে অর্জুনের অসংযত জীবন, আশ্রয়দাতার বিশ্বাসভঙ্গ কি অনুসরণযোগ্য আচরণ?
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে মানুষের জীবনও দ্রুত হতে থাকল তাই ধীরে ধীরে মোটর গাড়ি দেখা দিতে লাগল শহরের বুকে। শোনা যায়, ১৯১২ সালে দুধ পাতিল চা বাগানের একটি মোটর গাড়ি ছিল। সেই সময়ের গল্প যেন আজ এক ছবির মতো। আজ শহরের রাস্তায় কত রকম গাড়ি। গাড়ির ভিড়, আর এক সময় এই রাস্তায় একটি গাড়ি বেরোলে হয়তো ছোট ছোট বাচ্চারা তার পেছনে ছুটেছে। গাড়ি দেখতে ভিড় করেছে। চা বাগানের ম্যানেজারদের একে একে গাড়ি হল। শহরের নামী দামি ব্যক্তিদেরও বাড়িতেও গাড়ি এল। তবে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার যে খুব উন্নতি হয়েছিল তেমনটা নয়, কারণ বর্তমান সদরঘাটের ব্রিজ তখন ছিল না। নদীর পথে অর্থাৎ জুরিন্দা বা নৌকো করে যাতায়াত করতে হত। সদরঘাটেই ছিল স্টিমার ঘাট। জাহাজ চলাচলও করেছে এই ঘাট থেকেবি।

স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পর অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে বরাক নদীর উপর ব্রিজ নির্মিত হয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি নিয়ে এসেছে। বর্তমান শিলচরের ব্যস্ত জীবনের সাথে পুরনো সেই দিনের কথা গুলি মেলালে কেমন জানি গল্প গল্প মনে হয়। ভাবতে অবাক লাগে একদিন এই শহরেই চলেছে ঘোড়ার গাড়ি। শহর তার নিজস্ব গুণে বেড়ে চলেছে আর শহরের আনাচে কানাচে উকি মারছে ফেলে আসা দিনের কিছু চিহ্ন।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।