বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


উন্নতমানের প্রোটিনের উৎসের কারণে মাছের এত কদর। মাছের তেল যে মাছ বা মাছের কোষকলার মতো উপকারী সে কথা হয়তো অনেকেরই অজানা থাকতে পারে। মাছের দেহ কোষের সঙ্গেই থাকে তেল। এই তেলের উপাদানে আছে বেশ কিছু ফ্যাটি অ্যাসিড। তার মধ্যে আবার কিছু আছে দীর্ঘ শৃঙ্খল ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা সিক্স গ্রুপের কিছু ফ্যাটি অ্যাসিড। অবশ্যই সঙ্গে কিছু সম্পৃক্ত ও অল্প অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডও খানিকটা থাকে। আনুপাতিক হারে বিবেচনা করলে সামুদ্রিক এবং মোহনার মাছের তেলে দীর্ঘ শৃঙ্খল ওমেগা থ্রি-র পরিমাণ কিছুটা বেশি থাকে। আর মিষ্টি জলের মাঝে সেই পরিমাণ থাকে না, বরং বেশ খানিকটা কমই থাকে।

বাইরে থেকে যোগান দেওয়া খাবারের উপাদানের হেরফের ঘটাতে পারলে অবশ্য সেই পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলা যায় এবং সামুদ্রিক মাছের পরিমাণের কাছাকাছি চলে আসে। পুষ্টিগুণের বিচারে এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড মূলত ইপিএ এবং ডিএইচএ—এই দুটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। অন্তত আমাদের শারীরিক এমন কি মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখবার জন্যে।
রক্তবাহী ধমনীতে সম্পৃক্ত চর্বি জমে বাধা সৃষ্টি হতে পারে কখনও কখনও। আর যদি এ ভাবে বাধা সৃষ্টি হয় তবে এই রক্ত প্রবাহ থমকে যায় সাময়িকভাবে। তখন হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। মাছের তেল খেতে পারলে এই বাধা সৃষ্টি বা প্লাকের সমস্যা অনেকটা কমে। আবার মস্তিষ্কের তো অর্ধেকেরই বেশি এই সমস্ত বিভিন্ন ফ্যাটি অ্যাসিডে ভর্তি থাকে।

বেশ কয়েকটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মাছের তেল বা তা দিয়ে তৈরি ক্যাপসুল নিয়মিত কিছুদিন খেতে পারলে রোগীর ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন হয়। এমনকি অবসাদজনিত উপসর্গ থাকলে সেটাও মাছের তেলের প্রভাবে কিছুটা কম হয়। মাছের তেল এই অবসাদ কমাতে কিছুটা হলেও সক্ষম। গবেষণার ফলাফলে প্রমাণিত যে, মাছের তেল বেশ কার্যকরী।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৭: প্রবাল প্রাচীর আমাদের ভবিষ্যতের ওষুধের ভাণ্ডার

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯: সুন্দরবনের লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা

এছাড়াও প্রদাহ উপশমকারী ও অস্থিসন্ধির অনমনীয়তা এবং এমনকি আর্থারাইটিসের জটিলতা কম হতে দেখা গিয়েছে মাছের তেল বা তার ক্যাপসুল খাওয়ার ফলে। মাছের তেল কিন্তু ছোট মাছে প্রায় থাকে না। বড় মাছেই এই তেলের মাত্রা কিছুটা বেশি থাকে। অর্থাৎ মাছ খেয়ে মাছের তেলের উপযোগিতা পেতে হলে বড়মাছই শ্রেয়। যদিও অনুপুষ্টির অপরিসীম ভাণ্ডার ছোট মাছে অল্প পরিমাণে এগুলি থাকে।
একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে আমাদের একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়, তাতে দেখানো হয়েছিল কাতলা মাছে স্বাভাবিকভাবে এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো একটু কমই থাকে। কিন্তু পুকুরে চাষের সময়ে বাইরে থেকে যোগান দেওয়া খাবারের তারতম্য ঘটাতে পারলে ওদের এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি বিশেষ করে ইপিএ এবং ডিএইচএ অনেকটাই বাড়ানো সম্ভব। তাই যারা সামুদ্রিক মাছ খেতে পছন্দ করেন না, তারা এই চাষকৃত কাতলা বা অনুরূপ মাছ খেলে উপকৃত হতে পারেন।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৫: রাজবাড়ি এবং অভিনব বিবাহপর্ব

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

বাজারে অনেক বাঙালি ক্রেতাকে দেখেছি, বড় মাছ কাটবার পরে ভিসেরা বা তার নাড়িভুঁড়ি অংশটিকে মাছের তেল মনে করে নিয়ে যান। হয়তো বা রান্না করে খানও। কিন্তু এটা যে আদৌ তেল নয়, তা মাছ বিক্রেতা বা মাছের খরিদ্দার কেউই বুঝতে চাইবেন না। এতে বরং এতটাই সম্পৃক্ত চর্বি থাকে যা নিয়মিত খেলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। সকলের জানা দরকার, বাজারের মাছওয়ালারা এটিকে মাছের তেল বললেও আদতে এটি তেল নয়। এটি হল মাছের ক্ষুদ্রান্ত বৃহদান্ত্রের বাইরে লেগে থাকা মাছের সম্পৃক্ত ফ্যাট বা চর্বি।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১: ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির এক অনন্যসাধারণ কোচ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ

আরেকটির বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চাই। সেটি হল, অনেকে আমাদের মধ্যে শুঁটকি মাছ খেয়ে থাকেন। এটা হয়তো ঠিক যে, শুঁটকি মাছের এমন কিছু পদ আছে যা ক্রেতারা হয়তো পছন্দ করেন। হয়তো বা এই কারণে বাজারে টাটকা মাছ পাওয়া গেলেও তারা শুঁটকি মাছ কখনও কখনও কিনে খান। আমাদের বাজারে প্রায়শই যে সব শুঁটকি মাছ বিক্রি হতে দেখি সেগুলো খুব স্বাস্থ্য সম্মত ও পরিচ্ছন্নভাবে বানানো হয় না। এমনকি সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আনবার পর সমুদ্র উপকূলে যখন সেই মাছ শুকানো হয় তখন অনেকে কীটবিতারক রাসায়নিকও ব্যবহার করে থাকেন।
শুঁটকি মাছে পোকামাকড় যাতে না লাগে বা পাখীরা না খায় এটিই মূলত রাসায়নিক ব্যবহারের উদ্দেশ্য হলেও এর ফলে যে ক্রেতার স্বাস্থ্যহানি হবে—এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। একান্তই যদি শুঁটকি মাছ কিনতে চান যারা, তারা যেন স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে পরিচ্ছন্ন উপায়ে প্যাকিং করা এবং এফএসএসএআই-এর শংসাপত্র-সহ প্যাকেটজাত শুঁটকিই অবশ্যই ব্যবহার করবেন। সেক্ষেত্রে এই স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার কারণ থাকবে না আশা করা যায়। নিমপীঠে অবস্থিত বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অফ বায়োটেকনোলজির বিজ্ঞানীরা, সাগরদ্বীপে, শুঁটকি মাছ প্যাকেটজাত করে থাকেন এবং তা বাজারে পরিচ্ছন্ন প্যাকে শংসাপত্র-সহ পাওয়া যায়।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content