বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

বাঙালির জীবনে যতই বিভিন্ন ও বিচিত্র পুরাণগাথা থাকুক না কেন, একটি পুরাণ ছাড়া কিন্তু বাঙালিজীবন এক্কেবারে অচল, আর সেটি হল বাঙালির মৎস্যপুরাণ। এই একটি পুরাণই দেশ-বিদেশে বাঙালির মাহাত্ম্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। আমাদের মৎস্যপুরাণে মাছের যাবতীয় পুরাণগাথা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে থাকবেন বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায়

পর্ব- ৪

দীর্ঘদীনের কর্মজীবন এবং পারিবারিক জীবনের অভিজ্ঞতার সূত্রে মাছের পৌষ্টিক গুণাগুণ কীভাবে হাতে ধরে নষ্ট করা যেতে পারে সেই নজির দেখেছি বারবার। বাঙালি পরিবারের মাছ খাওয়া মানেই রান্নার প্রথম দফার কাজ হল মাছটিকে ছাঁকা তেলে কড়া করে ভেজে নেওয়া, যার ফলে মাছের অর্ধেক পুষ্টিগুণ সেখানেই নষ্ট হয়ে যায়। মাছে থাকে দীর্ঘশৃঙ্খল ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। ছাঁকা তেলে মাছ ভাজার ফলে মাছের দীর্ঘশৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিড চলে যায় মাছ ভাজার জন্য ব্যবহৃত তেলটিতে এবং তেলের অপকারী ফ্যাটি অ্যাসিড চলে আসে মাছের মধ্যে। যে কারণে নিয়মিত মাছ খাওয়ার ফলে কিন্তু আমাদের হৃদরোগজনিত সমস্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসার কথা কিন্তু তা একেবারেই আসছে না। এর কারণই হল হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে সবথেকে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে যে দীর্ঘশৃঙ্খল ফ্যাটি অ্যাসিড সেই দুর্মূল্য উপাদানটিই তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তেলের প্রভাবে যার ফলে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণের কাজটিও আর যথাযথভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না।

পৃথিবীর বহু দেশে কেবলমাত্র মাছ খাওয়ার রীতি পদ্ধতির জন্য সেই সমস্ত দেশের মানুষদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা একেবারে নগণ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এস্কিমোদের কথা, এস্কিমোরা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বেশি মাছ খায় এবং অবশ্যই আমাদের মতো ছাঁকা তেলে ভাজা মাছ তারা খায় না, তাদের দেশের মানুষদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কিন্তু শূন্য। আবার জাপানিদের কথাই যদি ধরি, জাপানিরা প্রচুর মাছ খায় এবং তাদের হৃদরোগজনিত সমস্যা প্রায় নেই বললেই চলে, পাশাপাশি জাপানিদের গড় আয়ু নব্বই থেকে পঁচানব্বই বছর। কেউ কেউ একশো বা একশো পাঁচ বছর অব্দিও বাঁচেন। অথচ আমাদের দেশে মানুষের গড় আয়ু সত্তর থেকে পঁচাত্তর বছর, খুব বেশি হলে আশি কি পঁচাশি। এত মাছ খেয়েও কিন্তু আমরা আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারছি না, কেবলমাত্র আমাদের রান্নার পদ্ধতির জন্য। পাশাপাশি মাছ হল প্রাণীজ খাবারগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি সহজপাচ্য একটি খাবার, মাছ খেয়ে অন্তত কারওর হজমের সমস্যা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হজমের সমস্যা আমাদের চিরসখা, এই সমস্যা আমাদের ছেড়ে যেতে চাইলেও আমরা কিন্তু মোটেই তাকে যেতে দিই না, তার অন্যতম একটি কারণও কিন্তু এই ছাঁকা তেলে মাছ ভাজার প্রবণতা। আমার ব্যক্তিগত জীবনে বহু দেশে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেই অভিজ্ঞতার সূত্রেই বলছি ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং তুর্কির কিছু মানুষ ব্যতিরেকে কোনও দেশের মানুষই কিন্তু ছাঁকা তেলে মাছ ভেজে খান না যার ফলে মাছের সম্পূর্ণ পুষ্টিগুণটুকু তাঁরা উপভোগ করতে পারেন।

এখন এইক্ষেত্রে অনেকের মনেই এহেন প্রশ্নের উদয় হবে যে ছাঁকা তেলে না ভাজলে মাছ খেয়ে শরীর খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কি না? হ্যাঁ, সম্ভাবনা থাকে যদি না আপনি রান্না পূর্ববর্তী ধোয়াধুয়ির পদ্ধতিটি ঠিকভাবে না করে থাকেন, বা তাড়াহুড়ো করে করেন সেক্ষেত্রে কড়া করে না ভাজলে মাছের মধ্যে থাকা জীবাণু সম্পূর্ণরূপে মাছ থেকে যাবে না। কিন্তু এই সমস্ত জীবাণুর ঐককণাও কিন্তু মাছের নিজস্ব জীবাণু নয়, এই সমস্ত জীবাণুই আমাদের মাছ বাজারগুলির অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার দান। সেক্ষেত্রে আপনি যদি একটু সময় নিয়ে এবং যথাযথভবে মাছ পরিষ্কার করার কাজটি করে থাকেন তাহলে কড়া করে মাছ ভাজার কোনও প্রয়োজনই নেই। ইলিশ মাছের ক্ষেত্রে আমরা যেভাবে ভাপিয়ে মাছটি রান্না করি থাকি বা পাতুরি করার সময়ও কলাপাতায় মাছ ভাপিয়ে রান্না করার যে পদ্ধতিটি চালু আছে ওটাই কিন্তু মাছ রান্না করার যে সহজ পদ্ধতি, ওই পদ্ধতিতে রান্না করলেই একমাত্র আপনি মাছের সমস্ত পুষ্টিগুণটুকু পেতে পারেন, নাহলে কিন্তু পরিশ্রমই সার।

আমরা আশা করব আমাদের আগামী প্রজন্ম এই বিষয়ে সচেতন হবে এবং এই চিরাচরিত প্রথার অবসান ঘটিয়ে সমস্ত পৌষ্টিক উপাদান যাতে বজায় থাকে এমন এক মৎস্য রন্ধনপদ্ধতি প্রচলিত ও প্রচার করে আমাদের মাছ বাবাজির সমস্ত পুষ্টিগুণ আমরা যাতে উপভোগ করতে পারি আমাদের এমন এক অভূতপূর্ব সৌভাগ্যের অধিকারী হতে সাহায্য করবে।

লেখক
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content