ছবি সংগৃহীত।
সেই কাব্য প্রচারে পাঠ ও গানে, দ্রুত মধ্য ও বিলম্বিত এই ত্রিবিধ রূপে, ষড়জ, মধ্যম প্রভৃতি স্বরসপ্তক সংযুক্তিতে, বীণার তন্ত্রীবাদ্যের সঙ্গে শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর রসসংযুক্ত করে গন্ধর্বদের মতো রূপবান দুই কুমার গাইতে লাগলেন। দৃশ্য ও শ্রব্য কাব্যের মেলবন্ধনে কুশ ও লব হলেন দৃশ্য কাব্যের চিরন্তন কুশীলব। কানের ভেতর দিয়ে মরমে পৌঁছোয় যে সুর মূর্ছনা তার আবেদন যে বিশ্বজনীন। জীবন রঙ্গমঞ্চে আনন্দ, বিষাদ, শোক, শৌর্য, গুণগৌরবের অন্যতম প্রচার মাধ্যম সংগীত।
পরিশীলনে সুসংস্কৃত সংগীত যে অনেক বৃহৎ পরিসরে সুরের মার্গদর্শনের পথরেখার সূচনা করে। পিতৃগৌরব, মায়ের স্বচ্ছ জীবনালেখ্য প্রচার করবেন কারা? যোগ্য সুসন্তান। ঋষি কবি বাল্মীকি নান্দনিক বোধের উচ্চতার সঙ্গে বিনোদনেও নিয়ে এলেন রামায়ণকে। প্রাকৃত মনোজগত জয়ের প্রথম সোপান মনে হয় বিনোদন। সেই অনিন্দ্যসুন্দর দুই কুমার যারা সেই রামেরই প্রতিবিম্ব স্বরূপ তারা মুনি ও সাধুসমাগমে প্রথম রাম কথা সুরসংযোগে পরিবেশন করলেন। কী হল তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া? যাঁরা সাংসারিক বন্ধনমুক্ত কোনও নন্দনতত্ত্ব যাঁদের নীরস জীবনে কোনও আবেদনই রাখে না, যাঁরা ধর্ম, অর্থ, কাম এই ত্রিবর্গের থেকেও মোক্ষতেই আপ্লুত হয়ে তপশ্চর্যাকে জীবনের ব্রত হিসেবে মেনে নিয়েছেন তাঁদের মরমে সারা জাগাতে পারল কী সেই সঙ্গীত? ঋষি কবির বর্ণনায়—
তচ্ছ্রুত্বা মুনয়ঃ সর্বে বাষ্পপর্যাকুলেক্ষণাঃ।
সাধুসাধ্বিতি তাবুচুঃ পরমং বিস্ময়মাগতাঃ।।
চিরনিবৃত্তমপ্যেতত্ প্রত্যক্ষমিব দর্শিতম্।
তাঁদের কাছে অতীতের ঘটনাও যেন চোখের সামনে মঞ্চস্থ অভিনয় বলে মনে হল। এ যেন সংগীতবহুল চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্যায়ন। মুনিগণ সন্তুষ্ট চিত্তে বল্কল, কৃষ্ণাজিন, যজ্ঞসূত্র, কমন্ডলু, কৌপীন, আসন কুঠার, কাষায় বস্ত্র, জটা ও কাষ্ঠভার বহনের রজ্জু প্রভৃতি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী উপহার দিলেন দুজনকে। দীর্ঘায়ু কামনায় ও শুভেচ্ছা বার্তায় অভিনন্দিত করলেন দুই কুশীলবকে। এরপর অযোধ্যার পথে পথে রামকথা গাইতে লাগলেন সুন্দরকান্তি দেবশিশুর মতো সেই দুই কুমার লব ও কুশ। ক্রমে ক্রমে মহারাজ রামচন্দ্রেরও কর্ণগোচর হল সেই শ্রুতিসুখকর সঙ্গীত। তপোবনের প্রাজ্ঞমুনিদের বিমুগ্ধতায় যার অনুমোদন তা জনচিত্তকে স্পর্শ করল। যেন জীবনের গীতিকাব্যের সূচনা করলেন দুই রামনন্দন, যার সুর মূর্ছনা এখনও পর্যন্ত বিমোহিত করে রেখেছে ভারতীয় জীবনমঞ্চ তথা নাট্যমঞ্চ।
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২: রামকথার পটভূমি এবং মহাভারতে কথকের কথাসূত্র
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৯: ঋষির আশীর্বাদে যাত্রা এবার গভীর অরণ্যপথে
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৮: দেবতাদের আশীর্বাদে আর অর্ব্বাবসুর প্রার্থনায় যবক্রীত বেদজ্ঞান লাভ করলেন
মহাভারতের প্রাথমিক প্রচার
নৈমিষারণ্যে এসেছেন সৌতি কথক ঠাকুর। শ্রোতৃমন্ডলী, যে সে নন, তাঁরা প্রজ্ঞাবান, বেদবিদ, স্মৃতিনিষ্ঠ, ব্রতচারী তাত্ত্বিক মুনিঋষিগণ। তপঃক্লিষ্ট মুনি ঋষিরা, মোক্ষ চিন্তাই যাদের উদ্দেশ্য তাঁরা বিচিত্রকথা শ্রবণে আগ্রহী, হয়তো ছেড়ে আসা বিগত জীবনের কিছু রং রূপ আজও ক্ষণিক উঁকি দিয়ে যায় তাঁদের মনে। সুরসিক পেশাগত দিক দিয়ে যিনি গল্প বলায় দক্ষ সেই সৌতির গল্পকথায় তাঁরা আগ্রহী—
চিত্রাঃ শ্রোতুং কথাস্তত্র পরিবব্রুস্তপস্বিনঃ।
গভীর আগ্রহে তাঁকে ঘিরে ধরলেন তাঁরা। কুশলবার্তা বিনিময়ের পর মুনিদের অসীম কৌতূহল না জানি কোন বিচিত্র কথকতার আসর থেকে এসেছেন কথক ঠাকুর। বেশ আকর্ষণীয় চেহারা কথকের। পদ্ম পাতার মতো আয়তনয়ন তাঁর। অনেক সময়ে চোখও কথা বলে যে। হে পদ্মপত্রতুল্য নয়ন, কোথা থেকে আসছেন আপনি? কোথায় এতকাল ছিলেন? দয়া করে বলুন।
কুত্র আগম্যতে সৌতে!ক্ব চায়ং বিহৃতস্ত্বয়া।
কালঃ কমলপত্রাক্ষ!শংসৈতত্ পৃচ্ছতো মম।।
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল
স্বাদে-আহ্লাদে: কুলের আচারের নাম শুনলে জিভে জল আসে? রইল সহজ রেসিপি
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১১: বন থেকে বনান্তরে
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩: ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছিল পঞ্চমের প্রথম অগ্নিপরীক্ষা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৮: পূর্ণ অপূর্ণ-র মাঝে পথ দেখায় ‘দেবত্র’
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১১: লিকার চা খাওয়া কি সত্যই শরীরের পক্ষে ভালো?
ছবি সংগৃহীত।
মহাকালের অব্যাহত গতিতে এখনও সমানভাবে চর্চিত ভরতবংশীয়দের এই ইতিহাস, গম্ভীর তত্ত্বসমৃদ্ধ বিচিত্র বিষয়বস্তু বাহুল্যে অনন্য মহাভারত।
শ্রীবেদব্যাসের মতে—
হ্রদানামুদধিঃ শ্রেষ্ঠো গৌর্বরিষ্ঠা চতুষ্পদাম্।
যথৈতানীতিহাসানাং তথা ভারতমুচ্যতে।।
প্রাকৃতিক জলাশয়ের মধ্যে সমুদ্র শ্রেষ্ঠ, চতুষ্পদ প্রাণীদের মধ্যে গাভিজাতীয় তৃণভোজী প্রাণী সর্বোত্তম, ইতিহাসের মধ্যে মহাভারত মহত্তম।—চলবে