শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

গঙ্গার অবতরণ ও গঙ্গাধারায় সগরসন্তানদের তথা মনুর উত্তরসূরীদের বিমুক্ত হওয়ার কাহিনি শুনে বিস্মিত হলেন রামচন্দ্র। এতটাই আকর্ষণীয় ছিল ঋষি বিশ্বামিত্রের এই কাহিনি উপস্থাপনা, যে তাঁর মনে হল যেন এক লহমায় সুদীর্ঘ রাত্রি অতিবাহিত হল। অমল প্রভাতে সেই পুণ্যতোয়া গঙ্গার পরপারে যাওয়ার জন্য উৎসুক হলেন রাঘব রামচন্দ্র। পুণ্যবান মহর্ষিরা নৌকা বেয়ে অরিন্দম রামচন্দ্রকে নিতে এলেন। গঙ্গার উত্তরতীরবর্তী দেশ, দেবলোকের মতো সুরম্য বিশালানগরী, তাঁর দৃষ্টিগোচর হল। অপারকৌতূহলে জিজ্ঞাসু রামচন্দ্র জানতে চাইলেন, কোন রাজবংশীয় রাজা রাজত্ব করছেন ওই বিশাল নগরীতে? আমার যে ভীষণ কৌতূহল, আমি শুনতে চাই তার কথা। কতমো রাজবংশোঽয়ং বিশালায়াং মহামুনে। শ্রোতুমিচ্ছামি ভদ্রং তে পরং কৌতূহলং হি মে।।

মুনিবর বিশ্বামিত্র রাঘব রামচন্দ্রের কৌতূহল নিবৃত্তির লক্ষ্যে, তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ভান্ডার থেকে বিশালনগরী স্থাপনের পুরা ইতিবৃত্ত তুলে ধরলেন। বিশাল নগরীতে লৌকিক রাজাদের রাজত্বের পূর্বে দেবাসুরের সম্পর্কিত ঘটনার সঙ্গে এই প্রদেশের সংযোগ ছিল। সত্যযুগে অদিতি ও দিতির অমিত বলশালী, ভাগ্যবান, ধার্মিক, শৌর্য্যশালী, পুত্ররা জন্ম নিয়েছিলেন। অদিতিপুত্র আদিত্য অর্থাৎ দেবগন ও দিতিপুত্র দৈত্যরা জরামৃত্যুহীন নীরোগ জীবন কামনা করলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষীরোদ সমুদ্র মন্থন করে, মৃত্যুহীন জীবনের আশায়, অমৃতলাভ।
বাসুকিনাগকে রজ্জু করে মন্দার পর্বতকে মন্থন দণ্ডরূপে ব্যবহার করে শুরু হল তাদের অমৃতের অনুসন্ধান। মন্থনের ফলে বাসুকি তার ফণা দিয়ে তীব্র বিষ উদ্গিরণ করতে করতে মন্দার পর্বতের শিলায় দংশন করতে শুরু করলেন। অগ্নিতুল্য সেই হলাহলে দেবদানবমানব সহ সমগ্র জগত দগ্ধ হওয়ার উপক্রম হল। শরণার্থী দেবতারা মহাদেবের উদ্দেশ্যে ত্রাহি ত্রাহীতি পরিত্রান করুন, পরিত্রাণ করুন, বলে স্তব করতে লাগলেন। মহাদেব আবির্ভূত হলেন। দেবশ্রেষ্ঠ বিষ্ণুও প্রকাশমান হলেন সেখানে। দেবাদিদেবকে বললেন, হে দেবশ্রেষ্ঠ, দেবতাদের যা কিছু তাতে,আপনার অগ্রাধিকার। দেবতাদের দ্বারা ক্ষীরসাগর মন্থনজাত এই বিষ, অর্ঘ্য হিসেবে আপনি গ্রহণ করুন। দৈবতৈর্মথ্যমানে তু যৎ পূর্ব্বং সমুপস্থিতম্।। তত্ত্বদীয়ং সুরশ্রেষ্ঠ সুরাণামগ্রতো হি যৎ। অগ্রপূজামিহ স্থিত্বা গৃহাণেদং বিষং প্রভো।। বিষ্ণুর কথায় মান্যতা দিলেন মহাদেব।
দেবতাদের ভয় নিরসনের জন্যে, বিষ যেন অমৃততুল্য, এমন মনোভাব নিয়ে মহাদেব তা পান করলেন। মন্থন দণ্ড দিয়ে মন্থনের উদ্যোগ শুরু করা মাত্রই, মন্থনদণ্ড, মন্দার পর্বত, পাতালে প্রবেশ করল। দেবগন্ধর্বরা সমবেত স্তব শুরু করলেন বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে। মন্থনদণ্ড উদ্ধারে তাঁর সাহায্য প্রয়োজন। বিষ্ণু কচ্ছপরূপ ধারণ করে সমুদ্রে প্রবেশ করলেন। পৃষ্ঠদেশে ধারণ করলেন মন্দার পর্বতকে। হাত দিয়ে পর্বতের অগ্রভাগ ধারণ করে মন্থনে অংশ নিলেন বিষ্ণু। সাগর থেকে উদ্ভূত হলেন ধার্মিক, দণ্ডকমণ্ডলুধারী আয়ুর্বেদবিদ ধন্বন্তরি আর দ্যুতিময়ী বরাঙ্গনারা। অপ অর্থাৎ জল থেকে অর্থাৎ সারভূত রস থেকে তাদের উত্থান তাই তাদের নাম হলো অপ্সরা। অপ্সরাদের সংখ্যা ষাটকোটি। দেব দানব উভয়ই তাঁদের গ্রহণে নিরাসক্ত। তাই তাঁরা হলেন সাধারণী।

এরপর সমুদ্র থেকে উঠলেন বরুনকন্যা বারুনী। তিনি মদিরার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। দিতির পুত্ররা তাঁকে গ্রহণ করলেন না তাই অদিতির পুত্ররা অর্থাৎ দেবগন তাকে গ্রহণ করে হৃষ্ট ও আমোদিত হলেন। এরপর সমুদ্র থেকে উঠলেন উচ্চৈশ্রবা নামক ঘোড়া, কৌস্তভ মণি এবং বহুকাঙ্খিত অমৃত। এবার সেই অমৃত গ্রহণের ঘোর দন্দ্ব শুরু হল দেবাসুরের মধ্যে। অসুর ও রাক্ষসেরা দেবতাদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধলেন। বহু শক্তি ক্ষয়ের পর, মহাবলী বিষ্ণু, মোহিনী মায়া বিস্তার করে সেই অমৃত অপহরণ করলেন। দেবতারা যুদ্ধে বহু দৈত্যকে নিধন করলেন। দেবরাজ ইন্দ্র দৈত্যদের বধ করে, মহানন্দে ত্রিলোক শাসন করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৭: শিক্ষায় বা জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রে নিষ্ঠা, ত্যাগ সেবার চমৎকারিত্ব কোথায়?

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৫: হিচককের লন্ডন, হিচককের সিরিয়াল কিলার

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৭: মদ না খেলে ফ্যাটি লিভার হয় না?

নিহত পুত্রদের শোকে দৈত্যমাতা দিতি স্বামী মরীচিসুত কশ্যপের শরণাপন্ন হলেন। তাঁর প্রার্থনা, হতপুত্রাস্মি ভগবংস্তব পুত্রৈর্মহাত্মভিঃ। শত্রুহন্তারমিচ্ছামি পুত্রং দীর্ঘতপোঽর্জিতম্।। হে মহাত্মা আপনার পুত্ররা আমার পুত্রদের হত্যা করেছে। পুত্রহারা মায়ের প্রার্থনা, শুধুমাত্র একটি শত্রুঘাতী পুত্র। মারীচ কশ্যপ আশীর্বাদ করলেন, এবং ভবতু ভদ্রং তে শুচির্ভব তপোধনে। জনয়িষ্যসি পুত্রং ত্বং শত্রুহন্তারমাহবে।। হে ভগবন, আপনার মহান পুত্ররা আমার পুত্রদের হত্যা করেছে। দিতির মঙ্গল কামনা করে কশ্যপমুনি বললেন, তপস্যাই তোমার সম্পদ। তুমি পবিত্র হয়ে বিরাজ কর। তুমি নিশ্চয়ই শত্রুঘাতী পুত্রের জন্ম দিতে পারবে।

কশ্যপ দিতিকে তাঁর নিজের ঔরসে ত্রিলোকাধিপতি ইন্দ্রের হত্যাকারী পুত্রের জন্মদান বিষয়ে নিশ্চিত করলেন। পুত্রং ত্রৈলোক্যহন্তারং মত্তস্ত্বং জনয়িষ্যসি।। কশ্যপপত্নী দিতি কুশপ্লব নামক তপোবনে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। দেবরাজ ইন্দ্র, দিতির পরিচর্যায় নিযুক্ত হলেন। ইন্দ্রের সেবা নিখুঁত। তিনি যা যা প্রয়োজন সবকিছুর যোগান দিতে লাগলেন এবং সেইসঙ্গে ত্রুটিহীন সেবায় নিরত হলেন। তপস্যার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে, সন্তুষ্টচিত্তে, দিতি, খুশিমনে, ইন্দ্রকে বললেন, হে সুরশ্রেষ্ঠ, তোমার বিনাশের জন্য তোমার পিতার কাছে পুত্র প্রার্থনা করেছিলাম। তোমার মঙ্গল হোক, তোমার পিতার প্রদত্ত বর অনুসারে তুমি তোমার ভায়ের দেখা পাবে। ভদ্রং তে ভ্রাতরং দ্রক্ষ্যসে ততঃ।।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬২: মাছের পোনার পুষ্টির গুণমান ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে নিশ্চিত আয় সম্ভব

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪: আমারে তুমি অশেষ করেছ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪১: কান্না হাসির দোল দোলানো ‘একটি রাত’

দিতি পুত্রতুল্য ইন্দ্রকে আশীর্বাদ করে বললেন, তোমার বিনাশের নিমিত্ত যে পুত্র চেয়েছিলাম সেই তোমার হননকারী নয়, তোমার জয়াকাঙ্ক্ষী হবে, যার ফলে নিরুদ্বেগে ত্রিলোক বিজয়সুখ ভোগ করবে তুমি। যমহং ত্বৎকৃতে পুত্র তমাধাস্যে জয়োৎসুকম্। ত্রৈলোক্যবিজয়ং পুত্র সহ ভোক্ষ্যসি বিজ্বরঃ।। এই শুভেচ্ছা বার্তা উচ্চারণ করে দিতি নিদ্রাতুর হলেন। মধ্যাহ্নকালে দিতি মাথার স্থানে পা, আর পায়ের জায়গায় মাথা রেখে শয়ন করে নিদ্রাভিভূত হলেন। দুষ্ট ইন্দ্র এই সুযোগ নিয়ে খুশিমনে তার দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে গর্ভ সাত ভাগে ছিন্ন করলেন। সেই গর্ভ সাত ভাগে ছিন্ন অবস্থায় রোদন করে উঠল। মহাতেজস্বী ইন্দ্র সেই রোরুদ্যমান গর্ভকে মা রুদো মা রুদশ্চেতি গর্ভং শক্রোঽভ্যভাষত। কেঁদনা কেঁদনা বলে আরও ছিন্নভিন্ন করে তুললেন।

জেগে উঠে দিতি ইন্দ্রকে অনুরোধ করলেন,ওদের হত্যা করো না। ন হন্তব্যং ন হন্তব্যমিতি দিতিরব্রবীৎ। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে অকপটে জানালেন, হে দেবী আপনি অশুচি শয্যায় পদযুগল মস্তক স্থানে রেখে নিদ্রামগ্ন ছিলেন। অশুচির্দ্দেবি সুপ্তাসি পাদয়োঃ কৃতমুর্দ্ধজা।। ইন্দ্র স্বীকার করলেন, সেই অনবধানতার সুযোগ নিয়ে তিনি তাঁর হত্যাকারী গর্ভকে সপ্তচ্ছিন্ন করেছেন। কিন্তু আপনি আমায় ক্ষমা করুন। তন্মে ত্বং ক্ষন্তুমর্হসি।। দিতি দুঃখে ভেঙে পড়লেন। তিনি কিন্তু ইন্দ্রের প্রতি ক্রোধান্বিত হলেন না। শুধু একটি ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। তুমি আমার ইচ্ছায় একটি প্রিয় কাজ কর। আমার পুত্ররা তোমার অধীনে সপ্ত মরুল্লোকের অধিপতি হয়ে বাতস্কন্দ নামে সাত ভাগে বিভক্ত গগনমণ্ডলে বিচরণ করুক এবং তোমার “মা রুদ ইতি” এই বচনের জন্য তাদের নাম হোক মারুত।

তিনি এটাও জানালেন এই সাতটি বায়ুর একটি ব্রহ্মলোকে, আরেকটি ইন্দ্রলোকে, অপরটি দিব্যবায়ু নামে খ্যাত হোক। অবশিষ্ট বায়ুপুত্ররা গগন মন্ডলে তোমার আদেশে সঞ্চরণ করুক চতুর্দিকে। দেবরাজ ইন্দ্র নতমস্তকে মাতা দিতির অনুরোধ স্বীকার করলেন। আপনার পুত্ররা দেবরূপেই বিচরণ করবে। দু’ জনে এইভাবে একমত হয়ে সুরলোকে গমন করলেন।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫০: আমার সোনার হরিণ চাই—সীতার চাওয়া কি সত্যি হবে?

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৮: মনে পড়ে পঞ্চমের কণ্ঠে শোলে ছবির সেই বিখ্যাত ‘মেহবুবা মেহবুবা…’ গানটি?

দশভুজা: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

বিশালা নগরীর স্থানমাহাত্ম্য বর্ণনাপ্রসঙ্গে মহর্ষি বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রকে জানালেন, এই স্থানেই দেবরাজ ইন্দ্র তপস্বিনী দিতির পরিচর্যায় রত ছিলেন। এই নগরী নির্মাণ করেছিলেন রাজা ইক্ষ্বাকুর ঔরসে অলম্বুষনাম্নী অপ্সরার গর্ভজাত বিশাল নামে পরমধার্মিক এক রাজা। রাজা বিশালের নামানুসারেই এই বিশালা নগরীর নামকরণ হয়েছে। অধুনা বিশালা নগরীর কীর্তিমান রাজা সুমতি, রামলক্ষ্মণসহ মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে স্বাগত সম্ভাষণে যথোচিত মর্যাদায় গ্রহণ করলেন। তাঁরা সেই রাত্রিটি সেই বিশালা নগরীতেই রাজার আতিথ্যে অতিবাহিত করলেন।

দেবাসুরের ক্ষীরোদসাগর মন্থনে অমৃত আহরণ— শুভাশুভ উভয়ের চিরন্তন স্থায়িত্বের প্রচেষ্টা যেন। ভালোমন্দ, আলোকালো মিলেমিশে যায় অমৃতত্বলাভ অভিযানে। ভালোর, শুভচেতনার জয় চিরন্তন। কালোকে মুছে দেয় আলো, দৈত্যদের পরাভূত করেন আদিত্যরা।

একই পিতার সন্তান অথচ মতবিরোধ নিরন্তর। জগত ও জীবনে, এমন কি সাংসারিক ক্ষেত্রে, পারিবারিক জীবনেও এই দুয়ের বিরোধের প্রতিফলন। জীবন মন্থনে, আলোড়নে ওঠে অমৃত, গরল। বিষ্ণু কচ্ছপ হয়ে ধারণ করেন মন্থনদণ্ড, মন্দারপর্বত। জীবনের ভরকেন্দ্র যে বিবেকচেতনা, বোধ, অনুভব। মঙ্গলময় শুভবোধ ধারণ করে যত বিষ — আত্মক্ষয়ী অবাঞ্ছিত যা কিছু, যেমন শিব মঙ্গলময়, তাই তিনি ধারণ করেছিলেন গরল, বিষ্ণুর অনুরোধে। চেতনা উজ্জীবিত করে শুভবোধকে, ঠিক তেমনি। অমৃতমন্থন থেকে উঠেছিলেন দণ্ডকমণ্ডলুধারী ধার্মিক ধন্বন্তরি, সর্বরোগহর, নিরাময়বার্তা নিয়ে — হয়তো সব সমস্যার সমাধান রয়েছে ধর্মবোধে, বিবেকচেতনায়, এই দ্বন্দ্বদীর্ণ জীবনে — এই আশা নিয়ে। রস থেকে উদ্ভূত সাধারণ নারীই যে জীবনের রূপ, রস, আনন্দ ধরে রেখেছেন।

তাই তাঁরা অপ্সরারা সাধারণ হয়েও অনেক অসাধারণ জীবনালেখ্য রচনায় অংশ নেন, উদাহরণ মহাকাব্যে, পুরাণে ছড়িয়ে আছে। মদিরার সুধারসে আচ্ছন্ন জীবন। রঙ, রূপ, রসের আবেশ সৃষ্টি করে বারুণী বা মদিরা, তাঁকেও জীবনের প্রয়োজন। বারুণীকে প্রত্যাখ্যান করলেন দৈত্যরা, তাদের ঐকান্তিক লক্ষ্য শুধুমাত্র অমৃত বা মৃত্যুহীনতা। জীবনকে জেনে রূপ, রস, গন্ধ আহরণেই যে সৃজনী শক্তি জেগে ওঠে,মানুষ মেতে ওঠে জীবনানন্দে, সৃষ্টি হয় কালজয়ী অমৃত সৃজন, তাই তাঁরা জীবনে গ্রাহ্য হলেন হয়তো।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

এরপর সমুদ্রের থেকে উত্থান উচ্চশ্রবা অশ্বের। অশ্বশক্তি বেগময়ী গতির প্রতীক। গতিময়তা ছাড়া যে পৃথিবীই অচল, জীবনের কথা, বলাই বাহুল্য। স্মরণাতীত কাল থেকে গতির বেগ ধরে রেখেছে এই পৃথিবী, ঋতুচক্র, বাৎসরিক আবর্তন, জীবন, মহাবিশ্বকে। তার বেগকে অস্বীকার করা যায় না। উচ্চশ্রবার উত্থান সেই গতিময়তার দ্যোতক হয়তো।

দৈত্যরাক্ষসদের অশুভ জোট প্রতিহত হয় শুভচৈতন্যময়তায়। তাঁর সেই মোহিনী, অমোঘ মায়ার বিস্তার আছে বলেই হয়তো অশুভচিন্তার, কালোর চিরন্তন পরাজয়। দিতিমায়ের ক্রোধ স্নেহের করুণাধারায় পরিবর্ত্তিত হয়। মা কী সন্তানঘাতী পুত্রসম কোন মানুষের বিনাশ চাইতে পারেন? তাহলে যে, বিধ্বংসী চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে যাবে।

দৈত্যমাতা দিতি পুত্রঘাতকের বিনাশে কঠোর তপস্যায় রত অবস্থায় পুত্রসম দেবরাজ ইন্দ্রের নিরলস পরিচর্যায় খুশি হয়েছেন। তাঁর মনের সমস্ত ক্লেদ, ঘৃণা, প্রতিহিংসার আগুণ, জ্বালাময় বিষবাষ্প, ক্ষমায় দ্রবীভূত হয়েছে। তাঁর গর্ভের পুত্রটি যে ইন্দ্রের ভাই, সে যে ভায়ের শুভাকাঙ্খী হয়েই রইবে, উদ্বেগের কারণ হবে না। ইন্দ্রের ত্রিলোকের আধিপত্য নিশ্চিত করলেন মা দিতি। মায়েরা এমনটাই হয়ে থাকেন, পুত্রহারা মায়ের হাহাকার ক্ষমার স্পর্শে প্রশমিত হয়ে ওঠে যখন, তখন উদারতায় মহান হয়ে ওঠে তাঁদের হৃদয়। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র?

ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বদের বৈশিষ্ট্য হল নিরাপত্তাহীনতার অনিশ্চিত জীবন। এই বুঝি গদিচ্যুত হলেন — এই ভয় নানা অন্যায় কাজে প্ররোচিত করে তাঁদের। এছাড়াও ক্ষমতা কুক্ষীগত করে রাখবার একটা ভীষণ উন্মাদনা কাজ করে সর্বদাই। প্রাকৃত জীবনে এ দৃষ্টান্ত কে না উপলব্ধি করেছে? শুভ অশুভের দ্বন্দ্বে ইন্দ্রের এই আপাত অনৈতিক আচরণের নৈতিক সমর্থন আছেই, সেখানে রয়েছে অসুরশক্তিকে পরাভূত করবার তাগিদ। দিতির গর্ভস্থ সন্তান বিনষ্টকারী ইন্দ্র, দিতির গর্ভের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন পুত্রদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে, নিজের সম্মানীয় স্থানের উত্তরণ ঘটিয়েছেন, সেইসঙ্গে বায়ুদের দেবত্বে উন্নীত করেছেন। বায়ুরা প্রাণবায়ু যোগান, তাঁদের অমৃতের ভাগীদার করতেই হবে যে, নাহলে বিপন্ন হবে ত্রিলোক। রোরুদ্যমান দিতি পুত্রদের প্রতি ইন্দ্রের অনুরোধ ”মা রুদ ইতি” (কেঁদোনা) থেকে মারুত, অভিনব শব্দের উদ্ভব।

যে কোনও সংক্ষোভ, আলোড়ন, বিলোড়নেই একটি জীবনজিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থন একটি অনন্ত প্রশ্নের দিকদর্শন যেন।পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শুভাশুভের দ্বন্দ্বে যে সংক্ষোভ বা আলোড়ন সৃষ্টি হয় তাতে উঠে আসে, হলাহল, নিরাময়, সমাধান, অবশেষে জীবনামৃতলাভ, হয়তো তাতেও বিতর্ক, সংশয়, দ্বিধাময় কিছু বিসংবাদ থেকেই যায়, যেমনটি হয়েছিল দেবাসুরের সমুদ্রমন্থন এবং অমৃতলাভে। কিন্তু এসব থাকা সত্ত্বেও অশ্বশক্তির গতিময়তায় এগিয়ে যায় দেশ, সময়, কাল। পৌরাণিক অতিকথা এক অনন্যমাত্রা পায় কল্পনায়।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

আপনার রায়

রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে দফা বৃদ্ধি করা জরুরি?

Skip to content